করোনাকালে অনলাইন শিক্ষার বাস্তবতা

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

২০২০ সালের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাস। পৃথিবী জুড়ে সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক দুটো শব্দ তখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ‘ডোনাল্ড ট্রাম্প’, এবং চীনের উহান থেকে ছড়িয়ে পড়া ‘করোনা ভাইরাস’। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার হালের নেমেসিস চায়না আরো এক দফা মুখোমুখি; কিন্তু তার প্রেক্ষাপট অভূতপূর্ব। ট্রাম্প ততদিনে করোনাকে ‘চায়নিজ ভাইরাস’ নামকরণ করে এক দফা তোপ দাগিয়ে ফেলেছেন। আমরা, আমজনতা উত্কণ্ঠার সঙ্গে তখন তাকিয়ে আছি বিশ্ব গণমাধ্যমগুলোতে প্রচারকৃত করোনা-সংক্রান্ত হালনাগাদ তথ্যের জন্য। নিজের অজান্তে শিখে চলেছি ‘সোশ্যাল ডিসটেন্সিং’ বা সামাজিক দূরত্বের মতো নতুন শব্দগুচ্ছ। স্প্যানিশ ফ্লুয়ের শতবর্ষবাদে পুনরায় প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে ‘কোয়ারেন্টাইন’ বা ‘সঙ্গরোধ’ শব্দটি। বাংলাদেশে আমরা তখনো উত্কণ্ঠিত; কিন্তু স্থবির হয়ে পড়েনি জনজীবন। অফিস-আদালত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ব্যাংক, মসজিদ—খোলা আছে সবই। সোমবার (১৯ এপ্রিল) ইত্তেফাত পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।

নিবন্ধে আরও জানা যায়, পেশাগতভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করি। পরীক্ষার হলে শিক্ষার্থীদের হালকা সিরিয়াস টোনে বলি ‘সোশ্যাল ডিসটেন্সিং’ বজায় রাখতে, নইলে জায়গা বদলে ‘কোয়ারেন্টাইনে’ পাঠিয়ে দেব। শুনে শিক্ষার্থীরাও হাসে, সঙ্গে কখনোসখনো আমিও। গত বছরের মার্চ মাসের প্রায় মাঝামাঝিতে যখন সরকারিভাবে সমস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়, ধারণা ছিল—এ হয়তো এক সাময়িক স্থবিরতা। এক সপ্তাহ কি সর্বোচ্চ দুই সপ্তাহ। তারপর যে অভূতপূর্ব এক অবস্থার মধ্য দিয়ে আমরা যাই, তার সঙ্গে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার অতীতকালীন কোনো অভিজ্ঞতা মেলে না। ডোনাল্ড ট্রাম্প এখন আর আমাদের জন্য প্রাসঙ্গিক নয়; কিন্তু করোনা ভাইরাস রয়ে গেছে আমাদের জনজীবন ও শিক্ষাব্যবস্থায় এক চরম দুর্ভোগ হিসেবে।

গত বছর সরকারিভাবে সর্বস্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহ বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর, প্রথম একটা মাস বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সংযুক্ত আমাদের সবার সময় কাটে অস্বস্তি ও অনিশ্চয়তায়। সহূদয় মালিকপক্ষের তরফ থেকে বেতন-ভাতার নিশ্চয়তা প্রদানের পর সে মানসিক কষ্ট থেকে মুক্তি মেলে। এরপর বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের তরফ থেকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সমূহকে অনলাইনে শিক্ষাকার্যক্রম চালিয়ে নেওয়ার অনুমতি দিলে আপাতস্থায়ী এক স্বস্তি নেমে আসে আমাদের মনে।

প্রাথমিকভাবে এক দুর্ভাগ্যজনক প্রবণতা লক্ষ্য করি স্বল্পসংখ্যক শিক্ষার্থীর মধ্যে, যারা করোনাকালে অনলাইন শিক্ষাকার্যক্রম পরিচালনার প্রক্রিয়াটিকে সম্পূর্ণরূপে একটি ব্যবসায়ী-বেনিয়াবৃত্তিক প্রকল্প হিসেবে চিহ্নিত করার চেষ্টা করেন। নিজের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, তার শিক্ষক-স্টাফদের সঙ্গে যে স্বতঃস্ফূর্ত আবেগী সম্পর্ক তাকে সম্পূর্ণরূপে ব্যাবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গীতে চিহ্নিত করতে চাইলে নিজেকেও যে মনের অজান্তেই সে ব্যবসার অংশীদার বলা হয়ে যায়, তা তাদের কেউ অনুধাবন করেছিলেন বলে মনে হয় না। তদুপরি, বিশ্ববিদ্যালয়ভেদে করোনা উপদ্রুতকাল বিবেচনায়, মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে মূল টিউশন ফির ওপর ১০ শতাংশ থেকে সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ পর্যন্ত ছাড়, শিক্ষক-স্টাফদের বেতন থেকে স্বেচ্ছায় এক দিনের বেতন করোনার শিকার দুস্থ শিক্ষার্থীদের জন্য ডোনেশনের মানবিক প্রয়াসগুলোকেও খাটো করে দেখা হয়। অবশ্য অনলাইন কার্যক্রম একবার পুরোদমে শুরু হয়ে যাবার পর তার প্রায়োগিক বাস্তবতা বুঝে যখন বিপুলসংখ্যক ছাত্রছাত্রী অনলাইন সেমিস্টারে রেজিস্ট্রেশন করা আরম্ভ করে, উপর্যুক্ত অভিযোগ আপনাতেই স্তিমিত হয়ে যায়।

সোশ্যাল মিডিয়ায় অভ্যস্ত প্রজন্মের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের অনলাইন ক্লাসের পুরো প্রক্রিয়ায় অভ্যস্ত হতে এক সপ্তাহও লাগেনি । যে সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফ থেকে আগেই গুগোল থেকে ডোমেইন ক্রয় করা ছিল, তাদের গুগোল ক্লাসরুম—মিট লিংক তৈরি করতে কোনো সমস্যাই হয়নি। তবে করোনা আক্রান্ত সময়ের কষ্টার্জিত অর্থে অনলাইন শিক্ষাকার্যক্রমে কতটুকু শেখা যাবে, এটাই ছিল শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের মনে মূল প্রশ্ন। অপরদিকে, আমরা শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের যে অ্যাসাইনমেন্ট অনলাইনে দিচ্ছি এবং তা মূল্যায়ন করছি—তাতে শিক্ষার্থীর তরফ থেকে কতটুকু সততা অবলম্বন করা হয়েছে, এ নিয়ে প্রশ্ন ছিল আমাদের তরফ থেকে। অনলাইন ক্লাসের একদম শুরুর দিকের ঘটনা। ইংলিশ ওরাল কমিউনিকেশন স্কিলের চূড়ান্ত প্রেজেন্টেশন দিচ্ছেন আমার একজন শিক্ষার্থী, ফরমাল পোশাকে, ল্যাপটপের ফ্রন্ট ক্যামেরা অন করে। বেচারি খেয়াল করার আগেই হয়তো তার পিতৃস্থানীয় কেউ উঁকি দিলেন, পরিবারের শান্ত ভদ্র কন্যাটি ল্যাপটপের সামনে সেজেগুজে বসে কার সঙ্গে ইংরেজিতে কথা বলছে—তা পরীক্ষা করতে!

ফলিত বিজ্ঞান ও ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টসমূহের ব্যাবহারিক ক্লাসগুলো হাতেকলমে করতে না পারাটা অনলাইন শিক্ষাকার্যক্রমের একটি সমস্যা ছিল। আশা করি বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয় উক্ত কোর্সগুলোকে বিশ্ববিদ্যালয় খোলা পর্যন্ত রহিত করে রেখেছে। একই সঙ্গে সামনাসামনি ক্লাস নিলে শিক্ষার্থীদের মুখ দেখে যেমন বলে দেওয়া যায় বক্তৃতা কে বুঝেছে আর কে বোঝে নি—অনলাইনে এটাও আন্দাজ করা মুশকিল। তবুও, সেশন জটে বা অনির্দিষ্টকালের জন্য শিক্ষাকার্যক্রম মাসের পর মাস, বছরের পর বছর বন্ধ করে বসে থাকার চেয়ে অনলাইনে যে উপায়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষাকার্যক্রম চলছে, তাতে তাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সমস্ত অংশীদার, সরকার এবং ইউজিসির বিশেষ ধন্যবাদ প্রাপ্য।

লেখাটি শেষ করব একটি গল্প দিয়ে। এ বছরের ফেব্রুয়ারি। বিশ্ববিদ্যালয়ের অনলাইন সেমিস্টার শেষ করে সস্ত্রীক বেড়াতে গেছি সিলেট। রাতারগুল সোয়াম্প ফরেস্টে যে তরুণ ছেলেটি আমাদের নৌকার মাঝি ছিল—তাকে প্রশ্ন করলাম, সে কোথায় থাকে, এই ট্রিপের পর সে কী করবে। উত্তর এলো, সে পার্শ্ববর্তী এক গ্রামে থাকে। নৌকার এই ট্রিপ শেষ করে সে স্থানীয় বাজারে যাবে মোবাইল নিয়ে, অনলাইন ক্লাস করতে। সে ঢাকার এক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। বাসায় ইন্টারনেট কানেকশন দুর্বল। বাজারে একটিমাত্র দোকানে ওয়াই-ফাই আছে, যারা সাশ্রয়ীমূল্যে ইন্টারনেট ব্যবহার করতে দেয় শিক্ষার্থীদের। রাতারগুলের সে নিস্তব্ধ পরিবেশে জলে ভাসতে ভাসতে নৌকার মাঝির এ উত্তর একদম অকল্পনীয় লাগলেও পরক্ষণেই বুঝি—এটাই আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার বর্তমান বাস্তবতা। দেশ জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা শিক্ষক-শিক্ষার্থীবৃন্দ এক প্রতিকূল পরিবেশের বিরুদ্ধ স্রোতে সাঁতার কাটতে কাটতে এগিয়ে চলছে এক আলোকিত ভবিষ্যতের পানে।

স্বাধীনতার ৫০তম বছরে, উচ্চশিক্ষার বৈতরণি পেরিয়ে জীবন গড়ার লড়াইয়ে লিপ্ত আমাদের শিক্ষার্থীদের এই অক্লান্ত পরিশ্রমী মুখগুলোই আমাদের অনুপ্রেরণা হয়ে রইবে!

লেখক :সাজিদ উল হক আবির, প্রভাষক, ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
কাল থেকে শিক্ষা বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী চলবে সব প্রাথমিক বিদ্যালয় - dainik shiksha কাল থেকে শিক্ষা বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী চলবে সব প্রাথমিক বিদ্যালয় বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার মান বাড়ানোর নির্দেশ রাষ্ট্রপতির - dainik shiksha বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার মান বাড়ানোর নির্দেশ রাষ্ট্রপতির ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার দাবিতে দেশজুড়ে সংহতি সমাবেশ - dainik shiksha ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার দাবিতে দেশজুড়ে সংহতি সমাবেশ সব মাদরাসার ওয়েবসাইট ও তথ্য হালনাগাদের নির্দেশ - dainik shiksha সব মাদরাসার ওয়েবসাইট ও তথ্য হালনাগাদের নির্দেশ অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা অবৈতনিক : দুই মন্ত্রণালয় যা করবে - dainik shiksha অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা অবৈতনিক : দুই মন্ত্রণালয় যা করবে নার্সিং-মিডওয়াইফারি ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ - dainik shiksha নার্সিং-মিডওয়াইফারি ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ শুক্রবার স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত হয়নি, জানালো শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha শুক্রবার স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত হয়নি, জানালো শিক্ষা মন্ত্রণালয় সিনিয়র আইনজীবীরা বিচার বিভাগের স্বার্থে কথা বলবেন, আশা প্রধান বিচারপতির - dainik shiksha সিনিয়র আইনজীবীরা বিচার বিভাগের স্বার্থে কথা বলবেন, আশা প্রধান বিচারপতির দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0028300285339355