করোনা প্রতিরোধে শিক্ষার্থীদের বিনোদনমূলক স্বাস্থ্যশিক্ষা প্রয়োজন

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

কভিড-১৯ ও অন্য সংক্রামক রোগ প্রতিরোধে স্কুল শিক্ষার্থীদের বিনোদনমূলক স্বাস্থ্যশিক্ষা প্রদান প্রয়োজন। শিশুদের ক্ষেত্রে করোনাভাইরাস সংক্রমণ নিয়ে অদ্যাবধি যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে। বৈজ্ঞানিক গবেষণা থেকে প্রমাণিত হয় যে কভিড-১৯ প্রাপ্তবয়স্কদের তুলনায় শিশুদের কম হয়। হলেও শিশুদের ক্ষেত্রে রোগের তীব্রতা কম বা লক্ষণবিহীন হয়ে থাকে। আবার লক্ষণহীন শিশুদের থেকে তা অন্যদের সংক্রমিত করতে পারে। তাই শিশুদের ক্ষেত্রে গুরুত্ব কম দেওয়ার কোনো অবকাশ নেই। এ ছাড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা হলে এই ঝুঁকি আরো বেড়ে যেতে পারে বলে বিভিন্ন গবেষণা প্রবন্ধে বলা হচ্ছে। সম্প্রতি এ রকম একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে ‘ইনফেকশাস ডিজিজ অব পোভার্টি’ জার্নালে। সেখানে বলা হচ্ছে, শিশুরা যদিও অপেক্ষাকৃত কম ঝুঁকিপূর্ণ তথাপিও তাদের সংস্পর্শে এসে অভিভাবক বা বয়স্করা আক্রান্ত হতে পারেন এবং এসব বয়স্ক ব্যক্তিরা শ্বাস-প্রশ্বাসজনিত সমস্যায় ভুগে থাকলে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করতে পারেন। বৃহস্পতিবার (৪ মার্চ) কালের কণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত উপসম্পাদকীয়তে এ তথ্য জানা যায়।

উপসম্পাদকীয়তে আরও জানা যায়, করোনা প্রতিরোধে বিশ্বে যত ধরনের তথ্য ও উপাত্ত সরবরাহ করা হচ্ছে তার বেশির ভাগই সাধারণ বা প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের জন্য। শিশুদের জন্য বিশেষ কোনো স্বাস্থ্যশিক্ষামূলক তথ্য-উপাত্ত প্রদান করা হচ্ছে না, যেটি গুরুত্বসহকারে ভাবা দরকার। শিশুরা মা-বাবাদের অনুকরণ করতে পারে; কিন্তু স্বাস্থ্যবিধির সত্যিকার অর্থ বুঝতে না পারায় স্বাস্থ্যবিধি বা সামাজিক প্রটোকলগুলো তাদের জন্য বিভ্রান্তি, ভয় এবং ক্ষতির কারণ হতে পারে। তাই বিশেষ করে শিশুদের জন্য অংশগ্রহণমূলক ও আকর্ষণীয় স্বাস্থ্যকর এবং সামাজিক দূরত্ব শিক্ষার প্রচারে বিশেষ মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন।

স্কুল শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে বিনোদনমূলক স্বাস্থ্যশিক্ষা করোনাভাইরাস প্রতিরোধে যেমন অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে, তেমনি অন্যান্য সংক্রমক রোগ থেকেও সুরক্ষা দিতে পারে। অনেক সংক্রামক রোগ আছে, যেগুলো মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমিত হয়, আবার অনেক রোগ আছে যেগুলো পশুপাখি থেকে মানুষে সংক্রমিত হয়ে থাকে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, মানুষের যেসব রোগবালাই হয় তার প্রায় ৭০ শতাংশ পশুপাখি থেকে আসে। সুতরাং গবাদি পশুপাখির সঙ্গে মেলামেশা, সেবা ও ব্যবস্থাপনা এবং ভক্ষণের ক্ষেত্রে সংক্রমণের বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে। যদিও পশুপাখি থেকে কভিড-১৯ সংক্রমণের কোনো বৈজ্ঞানিক প্রমাণ এখনো মেলেনি, তবে মানুষ থেকে দু-চারটি প্রাণীতে সংক্রমণের ঘটনা ঘটেছে।

ডায়রিয়া, আমাশয়, জ্বর, সর্দি, কাশিসহ অনেক রোগের জীবাণু পশুপাখি থেকে মানুষে সংক্রমিত হয়। এমনকি কিছু জীবাণু আছে, যা গর্ভবতী মা-বোনদের গর্ভপাত ঘটাতে পারে। এ ছাড়া বাচ্চাদের মস্তিষ্কের ক্ষতি করতে পারে। শিশু, বয়স্ক, কম রোগ প্রতিরোধক্ষমতা ব্যক্তি, গর্ভবতী মহিলারা এসব সংক্রামক রোগ দ্বারা আক্রান্ত হলে মৃত্যুঝুঁকি বেড়ে যায়। অথচ সামান্য একটু সচেতন হলেই এসব রোগজীবাণু থেকে সহজেই রেহাই পাওয়া সম্ভব।

করোনাভাইরাসসহ সংক্রমণযোগ্য এসব রোগবালাই সম্পর্কে স্কুলে শিক্ষার্থী, শিক্ষক, স্টাফ ও অভিভাকেদের সাধারণ ধারণা প্রদান করা প্রয়োজন। যদিও কিছু অনুষ্ঠান বিভিন্ন প্রচারমাধ্যমে, বিশেষ করে টেলিভিশন ও সামাজিক যোগাযোগ মাধমে প্রচারিত হচ্ছে। কিন্তু শিশুদের এসব মাধ্যমে দেখার সুযোগ ও আগ্রহ দুটিই কম থাকে। স্কুলে যদি বিশেষ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তাদের উপযোগী করে বিভিন্ন ভিডিও চিত্র, কার্টুন বা ডকুমেন্টারি দেখানো যায়, তাহলে স্বাস্থ্যবিধির বিষয়গুলো বুঝতে ও অনুশীলনে সহজ হবে।

উন্নত বিশ্বে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিশুদের উপযোগী স্বাস্থ্যসচেতনমূলক শিক্ষার উদ্যোগ নেওয়া হয়। বিশেষ করে মেডিক্যাল ও ভেটেরিনারি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বিভিন্ন সংক্রমিত রোগ সম্পর্কে ধারণা দিয়ে থাকে স্কুল ও কলেজের শিক্ষার্থীদের। বিভিন্ন ডকুমেন্টারি, চিত্র, কার্টুন ও লিফলেটের মাধ্যমে সহজ ও সাবলীলভাবে তারা এসব রোগের জীবনচক্র, ক্ষতিকারক দিক এবং সংক্রমণ ও প্রতিরোধের উপায় সম্পর্কে সম্যক ধারণা দিয়ে থাকে। এ ছাড়া ব্যাবহারিক শিক্ষার মাধ্যমে অনুশীলনের ব্যবস্থা করা হয়ে থাকে।

করোনাসহ অন্যান্য সংক্রামক রোগের জীবনচক্র, প্রকৃতি ও পরিবেশে এদের অবস্থান ও সংক্রমণের উপায় সহজভাবে ভিডিওচিত্র, কার্টুন বা বিভিন্ন প্রদর্শনীর মাধ্যমে বোঝানো যেতে পারে। যেমন—শিশুরা পরিবেশ ও প্রকৃতি থেকে কিভাবে জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হতে পারে। পোষা প্রাণী কুকুর, বিড়ালের সংস্পর্শে এসে কিভাবে ক্ষতিকারক জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হতে পারে। মশা-মাছি কিভাবে জীবাণু ছড়ায়। শিশু বা অন্যরা মাটি থেকে কৃমি দ্বারা কিভাবে আক্রান্ত হতে পারে। মাটি ও পানি কিভাবে এসব জীবাণু দ্বারা দূষিত হয় এবং এসব দূষিত মাটি বা পানি থেকে কিভাবে জীবাণুতে মানুষ সংক্রমিত হয়—এসব বিষয়ে বিনোদনমূলক শিক্ষা প্রদান করা যেতে পারে। এ ছাড়া ঋতু পরিবর্তনে যেসব রোগবালাইয়ের ঝুঁকি থাকতে পারে, সেগুলো সম্পর্কে ধারণা ও সতর্কতা প্রদান করা যেতে পারে। জ্বর বা কোনো সংক্রামক রোগ দ্বারা আক্রান্ত হলে স্কুল কর্তৃপক্ষকে জানানো, আক্রান্ত অবস্থায় অন্যের সঙ্গে হাত মেলানো, কোলাকুলি বা সংস্পর্শে যাওয়া থেকে নিজেকে বিরত থাকার শিক্ষা প্রদান করতে হবে। হাঁচি দেওয়ার সময় অন্যদের কাছ থেকে দূরে সরে যাওয়া, মুখে হাত বা অন্য কিছু দেওয়ার অভ্যাস করাতে হবে। এ ছাড়া শারীরিক কিছু ব্যায়ামও নিয়মিত শেখানো দরকার। শুধু কভিড-১৯ নয়, যেকোনো ধরনের সংক্রামক রোগের ক্ষেত্রে বছরজুড়ে বিভিন্ন স্বাস্থ্যশিক্ষা প্রদান করা প্রয়োজন। প্রয়োজনে পুরস্কার ও সার্টিফিকেট দিয়ে তাদের উৎসাহিত করা যেতে পারে। শিশুরা এসব শিখে অন্যকে শেখাতে পারবে এবং পরিবার ও সমাজ উপকৃত হবে।

করোনা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কার ও শিশুদের অমানবিক চাপ কমানোর জন্য সুযোগ করে দিয়েছে। সুযোগ করে দিয়েছে স্বাস্থ্য সুরক্ষায় সচেতন হওয়ার। শিশুদের মানসিক চাপ কমাতে পুঁথিগত বিদ্যা কমিয়ে বিনোদনমূলক শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড বাড়ানো প্রয়োজন।

প্রতিটি স্কুলে স্বল্প পরিসরে হলেও স্বাস্থ্যসেবার জন্য একটি কক্ষ থাকা প্রয়োজন, যেখানে থাকবে একজন প্রশিক্ষিত নার্স। প্রত্যেক শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও স্টাফদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় প্রয়োজনীয় উপাদান সরবরাহ, নিয়মিত টিকাদান এবং কৃমিনাশক খাওয়ানোর কর্মসূচি চালু রাখা প্রয়োজন। প্রয়োজন তথ্য-উপাত্তসহ মনিটরিং ব্যবস্থা চালু রাখা।

শিক্ষার বৈষম্য ও বেগ কমাতে অভিভাবক ও শিশুদের অসুস্থ প্রতিযোগিতা থেকে বের করে আনতে হবে। নৈতিক, সামাজিক ও চারিত্রিক শিক্ষার দিকে জোর দিতে হবে। তাহলে শিশুদের মানসিক বিকাশের পাশাপাশি নৈতিক ভিত্তির মাধ্যমেও স্বাস্থ্য সুরক্ষা সাধিত হবে। মনে রাখতে হবে, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললে শুধু কভিড-১৯ নয়, যেকোনো সংক্রামক রোগ থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব।

 

লেখক : ড. মো. সহিদুজ্জামান, গবেষক ও অধ্যাপক, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
কাল খুলছে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শনিবারও চালু ক্লাস - dainik shiksha কাল খুলছে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শনিবারও চালু ক্লাস সরকারি কলেজ মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও খাদিমের চাকরি জাতীয়করণ দাবি - dainik shiksha সরকারি কলেজ মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও খাদিমের চাকরি জাতীয়করণ দাবি উপবৃত্তির সব অ্যাকাউন্ট নগদ-এ রূপান্তরের সময় বৃদ্ধি - dainik shiksha উপবৃত্তির সব অ্যাকাউন্ট নগদ-এ রূপান্তরের সময় বৃদ্ধি শিক্ষকের বেতন ও শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া রোধে কাজ চলছে: শিক্ষামন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষকের বেতন ও শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া রোধে কাজ চলছে: শিক্ষামন্ত্রী বিএসসি মর্যাদার দাবিতে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের মাসব্যাপী কর্মসূচি - dainik shiksha বিএসসি মর্যাদার দাবিতে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের মাসব্যাপী কর্মসূচি কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে ১৩ বছরের কম বয়সী শিশুদের হাতে স্মার্টফোন নয় - dainik shiksha ১৩ বছরের কম বয়সী শিশুদের হাতে স্মার্টফোন নয় একই স্কুলের দুই ছাত্রীকে বিয়ের পর আরেক ছাত্রীকে ল্যাব সহকারীর অনৈতিক প্রস্তাব - dainik shiksha একই স্কুলের দুই ছাত্রীকে বিয়ের পর আরেক ছাত্রীকে ল্যাব সহকারীর অনৈতিক প্রস্তাব দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশ ১২ মে - dainik shiksha এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশ ১২ মে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0028741359710693