কাউয়ার চরে স্কুল প্রতিষ্ঠার পর বাল্য বিবাহ কমেছে

মিলন কর্মকার রাজু, কলাপাড়া(পটুয়াখালী) |

কলাপাড়ার কাউয়ার চরে বাল্য বিবাহ অনেক কমেছে। বছর ছয়েক আগে গ্রামে ফ্রেন্ডশীফ প্রাথমিক বিদ্যালয় নামে একটি প্রাথমিক স্কুল  প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর গ্রামবাসীরা ধীরে ধীরে সচেতন হয়ে উঠতে শুরু করেছে। তারা এখন অল্প বয়সেই মেয়েদের বিয়ে দেয়ার কথা না ভেবে তাদের একটু পড়াশোনা করানোর কথায় চিন্তা করতে শুরকে করেছেন।

বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা হোসনেয়ারা বেগম বলেন, বয়স ১০ কী ১২ বলেই এই গ্রামের মেয়েদের বিয়ে দেয়া একটা নিয়মে পরিণত হয়েছিল। গোটা গ্রামের ৬০-৭০০ ভাগ মানুষই শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত হওয়ায় এবং পারিবারিক অভাবে অভিভাবকরা মেয়েদের বিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছিল এতোদিন। কিন্তু গত অর্ধ যুগ ধরে এই চরে স্কুল নির্মাণ করার পর গ্রামবাসী অনেকটা সচেতন হয়েছে। এখন কমে গেছে বাল্য বিয়ে।

তবে এই চরে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সচেতনতামূলক কর্মকাণ্ড না থাকায় অনেক মেধাবী মেয়ে তাদের লেখাপড়ার স্বপ্ন তাগ করে এখন অপরিণত বয়সেই গৃহবধু ও মা হয়েছে। লাকী আকতার নামের এটি মেয়ের কথা শোনালেন তিনি।

যেদিন জন্ম হয়েছিলো সেই দিনই বাবার জেলেনৌকায় প্রচুর ইলিশ ধরা পড়েছিলো। খুশি মনে বাবা ঘরে এসে কন্যার মুখ দেখে নাম রেখেছিলো লাকী (মানে সৌভাগ্যবতী)। কিন্তু সেই সৌভাগ্যবতী লাকীর সকল স্বপ্ন শেষ হয়ে যায় সে যখন চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রী। একদিন স্কুল থেকে বাসায় ফিরে জানতে পারে বিকেলে তার বিয়ে। কৈশোরের খেলার পুতুল ও রান্না রান্না খেলার সামগ্রী অন্য সহপাঠীদের দিয়ে তাকে প্রবেশ করতে হয় স্বামীর সংসারে ১১ কি ১২ বছর বয়সে। পটুয়াখালীর কলাপাড়ার ধুলাসার ইউনিয়নের জাফর হাওলাদারের মেয়ে লাকী (১৪) এখন আড়াই বছর বয়সী এক পুত্র সন্তানের মা।

কিন্তু ১৪ তেই তাকে মনে হচ্ছে ৪০ বছর বয়সী গৃহবধু। নিজের উচ্চ শিক্ষার স্বপ্ন বিসর্জন দিয়ে এই মায়ের একটাই স্বপ্ন ছেলেকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করা।  যে বয়সে তার সহপাঠীদের সাথে পুতুল খেলা করার কথা সে এখন সংসার সামলাচ্ছে। কলাপাড়ার ধুলাসার ইউনিয়নের কাউয়ার চর, গঙ্গামতি ও চর ধুলাসার গ্রামে এই লাকী বেগমের মতো শতশত কিশোরী বাল্যবিয়ের কবলে পড়ে এখন গৃহবধু।

কৈশোরেই তাদের বিয়ে দিতে বাধ্য হচ্ছে মা-বাবা। এরা অনেকেই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরোয়নি। অশিক্ষা-দারিদ্র্য এবং সামাজিক অবক্ষয়ে ভীতসন্ত্রস্ত অভিভাবকরা পরিবারের সম্মান বাঁচাতে মেয়েকে বাল্যবিয়ে দিতে বাধ্য হচ্ছেন। কিন্তু অল্প বয়সে মা হওয়ায় উপকূলীয় বাল্যবিয়ের শিকার মায়েদের কৈশোরেই শেষ হয়ে যাচ্ছে তাদের ভবিষৎ স্বপ্ন। স্কুলের গণ্ডি না পেরানো লাকীদের জীবনে খুব একটা উৎসব নেই। নেই উচ্চাকাঙ্ক্ষা। স্বামীর মুখের হাসি, সন্তানের দেখভাল, শ্বশুর-শাশুড়ির মন রক্ষা করতে করতেই তাদের দিন শেষ। কাউকে আবার সকালে ঘুম থেকে উঠে মাঠের কাজ, কাউকে জাল নিয়ে নদীও সাগরে পোনা শিকার করেই তাদের দিনের আলোর বেশিরভাগ সময় কাটাতে হয়।

লাকী বলেন, স্বামী রাসেল ভূইয়া সারাদিন নদীতে মাছ শিকার করেন। তাই ছেলে রাশিদুলকে নিয়ে তাকে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ঘর ও বাইর সামলাতে হয়। অতীত স্মৃতি মনে করে বলেন, যখন ক্লাস ফোরে পড়তাম, তহন মোর রোল নম্বর ছিলো ২৬। সারাদিন ঘুরতাম, খেলতাম। ধানের ছড়্ কুড়াতাম।

নদী ও পুকুরে ডুব দিয়ে মাছ ধরতাম। গাছের পেয়ারা, আম পাড়তাম। বিকালে সবাই এক সাথে বসে সেই আম,পেয়ারা মাইখ্যা খাইতাম। পুতুলের বিয়া দেতাম। মোর মনে আছে, যেদিন মোর বিয়া হইছে হেইয়ার কয়দিন আগেই একটা পুতুলের বিয়া দিছি। কিন্তু ভাগ্য দ্যাহেন সংসারের কিছু বুইজ্জা ওডার আগেই মোরই বিয়া হইয়া গ্যাছে।

এখন পোলাডারে মানুষ করাই মোর স্বপ্ন। মোর স্বপ্নপূরণ না হলেও চেষ্টা করবো ওর স্বপ্নপূরণের। কাউয়ার চরের এই লাকীর মতো শতশত স্কুল ছাত্রী এখন গৃহিনী। স্বামী, সন্তান নিয়ে এখন তিনি সফল মায়ের দায়িত্ব পালন করছে।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
আপিলে যাবে না শিক্ষা মন্ত্রণালয়, মাধ্যমিকে বৃহস্পতিবারও ছুটি - dainik shiksha আপিলে যাবে না শিক্ষা মন্ত্রণালয়, মাধ্যমিকে বৃহস্পতিবারও ছুটি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮ মে’র পরীক্ষা স্থগিত - dainik shiksha জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮ মে’র পরীক্ষা স্থগিত শিক্ষার্থীদের শাস্তি কোনো সমাধান নয় - dainik shiksha শিক্ষার্থীদের শাস্তি কোনো সমাধান নয় হিটস্ট্রোকের লক্ষণ ও করণীয় - dainik shiksha হিটস্ট্রোকের লক্ষণ ও করণীয় দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে সেশনজটের শঙ্কা বুয়েটে - dainik shiksha সেশনজটের শঙ্কা বুয়েটে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে মাধ্যমিক প্রজন্মের উপার্জন কমবে ৩১ বিলিয়ন পাউন্ড - dainik shiksha মাধ্যমিক প্রজন্মের উপার্জন কমবে ৩১ বিলিয়ন পাউন্ড ফিলিস্তিনিদের পক্ষে নির্মিত তাঁবু গুটাতে কলাম্বিয়া শিক্ষার্থীদের অস্বীকৃতি - dainik shiksha ফিলিস্তিনিদের পক্ষে নির্মিত তাঁবু গুটাতে কলাম্বিয়া শিক্ষার্থীদের অস্বীকৃতি শিক্ষিকার উত্যক্তকারীকে ধরতে গিয়ে হামলার শিকার পুলিশ - dainik shiksha শিক্ষিকার উত্যক্তকারীকে ধরতে গিয়ে হামলার শিকার পুলিশ সর্বজনীন পেনশনে অন্তর্ভুক্তির প্রতিবাদে ঢাবি শিক্ষক সমিতির কর্মসূচি - dainik shiksha সর্বজনীন পেনশনে অন্তর্ভুক্তির প্রতিবাদে ঢাবি শিক্ষক সমিতির কর্মসূচি please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0054712295532227