কিন্ডারগার্টেনে নীতিমালা ভীতি

মাছুম বিল্লাহ |

গত ১১ নভেম্বর বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নিবন্ধন নীতিমালা-২০২৩ এর গেজেট প্রকাশ করেছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। এই নিবন্ধন নীতিমালার মাধ্যমে সরকার বেসরকারি প্রাথমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ কিন্ডারগার্টেনগুলোকে নীতিমালার আওতায় আনার উদ্যোগ নিয়েছে। উদ্যোগটা ভালো, তবে এর কয়েকটি শর্ত, বিশেষ করে তিনটি শর্ত মেনে প্রতিষ্ঠান পরিচালনা অসম্ভব বলে মন্তব্য করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

আশঙ্কা করা হচ্ছে, প্রায় অর্ধ লাখ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যেতে পারে। প্রত্যন্ত অঞ্চলের এ ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়া মানে অত্র এলাকার শিশু শিক্ষার্থীদের শিক্ষা গ্রহণে এক ধরনের ধাক্কা লাগা। শুধু তাই নয়, এর সঙ্গে জড়িত শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেকারত্বের খাতায় নাম লেখানোরও একটি হুমকি হতে চলেছে, যদি এটি বাস্তবায়ন করা হয়। যদিও শিক্ষার উন্নয়নে, সুষ্ঠ শিক্ষা প্রশাসন উপহার হিসেবে পাওয়ার নিমিত্তে ছোটখাট ক্ষয়-ক্ষতি মেনে নেয়ার মধ্যে একটি যুক্তি আছে। কিন্তু তারপরেও কথা থেকে যাচ্ছে। 

অবশ্য প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) এ বিষয়ে বলেন, এই নীতিমালা বাধা নয়, একটি কাঠামো ও শৃঙ্খলার মধ্যে নিয়ে আসার উদ্যোগ। যেখানে সেখানে কিন্ডারগার্টেন নামে স্কুল খুলবেন আর যাচ্ছেতাইভাবে চালাবেন তা হতে পারে না। বিধিমালাটি এতোটা সহজ যে, নিজ জেলা বসেই বিদ্যালয় নিবন্ধনের করা যাবে। তাদের যতোটুকু সহযোগিতা দরকার আমরা দেবো। তবে সরকারির সব নির্দেশ, সব শর্তই মানতে হবে। এটি একটি চিত্র যা স্বভাবতই শিক্ষাসংশ্লিষ্ট এবং শিক্ষা প্রশাসনের মেনে নেয়ার মতো নয়। সেটি হচ্ছে যত্রতত্র প্রাথমিক বিদ্যালয় খুলে প্রশিক্ষণবিহীন শিক্ষক, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে, শিশুদের অনুপযোগী পরিবেশের মধ্যে শিক্ষাদান করা।

তারপর অনিয়ন্ত্রিতভাবে শিক্ষা ফি আদায় করা। আবার এটিও দেখতে হবে যে, এই বিষয়টি এমনি এমনি গড়ে ওঠেনি। এ ধরনের পরিবেশ তৈরি হয়েছে বলেই অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের বিনা বেতনের স্কুল বাদ দিয়ে এ ধরনের ছোট ঘরের মধ্যে বিদ্যালয়ে পাঠাতে বাধ্য হচ্ছেন। অর্থ খরচ করতে বাধ্য হচ্ছেন। সেই বিষয়টি কিন্তু আমাদের খেয়াল রাখতে হবে। 

বার্ষিক প্রাথমিক বিদ্যালয় শুমারি (এপিএসসি)-২০২৩ এর তথ্য মতে, দেশে ৬৫ হাজার ৫৬৫টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে। এ ছাড়াও ছয় হাজার ১৪০টি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে। কিন্ডারগার্টেনের সংখ্যা ২৬ হাজার ৪৭৮। এনজিও ও অন্যান্য প্রাথমিক বিদ্যালয় চালু আছে। তবে বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ঐক্য পরিষদের দাবি, অনিবন্ধিত এমন বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ৫০ হাজার। যেখানে প্রায় দশ লাখ শিক্ষক ও প্রায় এক কোটি শিক্ষার্থী। 

সম্প্রতি সরকারি বিভিন্ন সংস্থার জরিপে উঠে এসেছে প্রাথমিক শিক্ষার চিত্র। গত আগস্টে প্রকাশিত প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর ও ইউনিসেফের এক গবেষণায় বলা হয়, তৃতীয় শ্রেণির প্রায় ৬১ শতাংশ ও পঞ্চম শ্রেণির ৭০ শতাংশ শিক্ষার্থী গণিতে শিক্ষাক্রম অনুযায়ী যোগ্যতা অর্জন করতে পারেনি। তৃতীয় শ্রেণির ৫১ শতাংশ ও পঞ্চম শ্রেণির ৫০ শতাংশ বাংলায়ও দুর্বল। ২০২২ খ্রিষ্টাব্দে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের গবেষণায় বলা হয়েছিলো, করোনা সংক্রমণের আগে পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা ইংরেজি যতোটা শিখতো, করোনাকালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় তা সাড়ে ১২ শতাংশ কমে গেছে। 

ডিজি বলেছেন, শিক্ষার্থীদের পাঠদান ব্যাহত হওয়ার সুযোগ নেই। কারণ, সারা দেশে যথেষ্ট পরিমাণ সরকারি স্কুলসহ পর্যাপ্ত শিক্ষক আছেন। এরই মধ্যে ৩৭ হাজার শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়েছে, আরো শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়াধীন। দুর্গম এলাকায় বা কোথাও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংকট থাকলে সেখানে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপনে সরকার উদ্যোগ নেবে। এটি সত্য যে, সংখ্যার দিক থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা কিন্তু আমাদের দেশে কম নেই, কিন্তু সেগুলো কি জনসংখ্যার অনুপাতে আছে? উত্তর হবে একটি বড় ’না’। দ্বিতীয় আর একটি বিষয় হচ্ছে, জেলা শহর, বিভাগীয় শহর ও রাজধানীর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো কি কোনোভাবে বেসরকারিগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় আসতে পারে? যদি তাই হয় তাহলে শহরাঞ্চলে তো এতো কিন্ডারগার্টেন নামক বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন হতো না।

শহরাঞ্চলে তো সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় খুঁজে পাওয়া খুব একটা সহজ নয়। আমরা নিজেদেরকেই প্রশ্ন করতে পারি, আমরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে কী ধরনের শিক্ষা দিচ্ছি যে, একটু সচ্ছল হলেই অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের আর সরকারি প্রাথমিকে পাঠাতে চাচ্ছেন না। এমনকি একজন রিকশাওয়ালা আমাকে বললেন, তার দুটো সন্তানই কিন্ডারগার্টেনে পড়েন, খরচ চালাতে খুব কষ্ট হয় তবুও তিনি সরকারি বিদ্যালয়ে পাঠাচ্ছেন না। কারণ, সেখানে নাকি খুব একটা কিছু শেখানো হয়না। এটিতো এক ধরনের দৃশ্যমান বাস্তবতা। এটি কি আমরা অস্বীকার করতে পারি?

সংশিষ্টরা বলেছেন, নির্ধারিত জমি বা ভাড়া করা বাড়িতে বিদ্যালয় পরিচালনা, পার্শ্ববর্তী সরকারি প্রাথমিকে প্রধান শিক্ষককে ব্যবস্থাপনা কমিটিতে রাখা এবং পাঠদান ও নিবন্ধন অনুমতির জন্য পৃথক আবেদন ও অর্থ খরচের শর্ত দেয়া হয়েছে বিধিমালায়। প্রায় সব বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তিন শর্তের প্রতিটি পূরণ করতে ব্যর্থ হবে। ফলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধের পাশাপাশি বেকার হবেন শিক্ষক কর্মচারী, পাঠদান কার্যক্রম ব্যাহত হবে শিক্ষার্থীদের। আর প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় বলছে, ধীরে ধীরে সবাইকে নিবন্ধন নিতে হবে। আমরাও এটি সমর্থন করি। কারণ, রাষ্ট্রের মধ্যে থেকে সম্পূর্ণ নিজ মতে বা নিজেদের ইচ্ছায় প্রতিষ্ঠান চালানো সমীচীন নয়। 

ব্যক্তি মালিকানায় গড়ে ওঠা শহর কিংবা গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলের কয়েক হাজার কিন্ডারগার্টেন এখানো সরকারের কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা করে না। ইচ্ছেমতো কারিকুলাম, অতিরিক্ত বই পাঠ্য করা, এমনকি কোমলমতি শিশুদের ওজনের চেয়েও বেশি ওজনের বই ক্লাসে নিয়ে এসে পড়ানো থেকে শুরু করে নানা অসংগতির কথা প্রায়ই শোনা যায়। শিক্ষার্থীদের পাঠপরিকল্পনা, পরীক্ষা পদ্ধতি, মূল্যায়নের ধরনসহ বেশ কিছু বিষয়ে কিন্ডারগার্টেন মালিকরা বা পরিচালকরা, নিজেদের মতো করেই সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু সরকারের সিদ্ধান্ত হচ্ছে এখন থেকে কিন্ডারগার্টেন স্কুলগুলোকে শুধু বিনামূল্যের পাঠ্যবই সরবরাহই করবে না বরং এর সঙ্গে পাঠসূচি তৈরি ও কারিকুলাম অনুযায়ী পাঠদানেও বাধ্য করা হবে। এসব বিষয়ে একটি জাতীয় নীতিমালা প্রয়োগ দরকার। 

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় বলছে, দেশে যতো প্রাইভেট কিন্ডারগার্টেন আছে, বেসরকারি প্রাথমিক আছে এবং অন্যান্য স্কুল আছে সেগুলো সব একই নিয়মে পরিচালিত হবে। একীভূত শিক্ষানীতির আলোকে একই বই, একই কারিকুলাম বাস্তবায়ন করা হবে। কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, শিশুদের ওপর বইয়ের চাপ কমানো। এসব প্রতিষ্ঠানে যাতে নির্ধারিত বইয়ের বাইরে ভিন্ন বই, ভিন্ন রাইমস না পড়ানো হয়। শিশুদের দশ থেকে বার বছর পর্যন্ত মস্তিস্ক বর্ধনশীল। সেহেতু আমরা তাদের এমন কোনো চাপে বা এমন কোনো বিষয়ের মধ্যে ফেলতে চাই না, এমনকি পৃথক ডিজিটাল ডিভাইস হাতে ব্যবহার করাও নিরুৎসাহিত করার কথা বলা হচ্ছে। তবে বাসায় স্মার্ট টেলিভিশন, কম্পিউটার ব্যবহার করতে পারবে। তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত এটা করতে না করার পক্ষে মন্ত্রণালয়। প্রয়োজনে কিন্ডারগার্টেনের মালিক, পরিচালকদের সঙ্গে বসে সিদ্ধান্ত নেয়ার কথা বলা হয়েছে। এটি একটি যথার্থ প্রস্তাব। আমরা সরকারি ও বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর মধ্যে এক ধরনের সুস্থ্য প্রতিযোগিতা দেখতে চাই, যার মাধ্যমে আমাদের শিশুরা প্রকৃত ও মানসম্মত শিক্ষা পাবে। 

 

 


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
প্রধানমন্ত্রীর কাছে এসএসসির ফল হস্তান্তর - dainik shiksha প্রধানমন্ত্রীর কাছে এসএসসির ফল হস্তান্তর এসএসসি পরীক্ষার ফল জানবেন যেভাবে - dainik shiksha এসএসসি পরীক্ষার ফল জানবেন যেভাবে এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের জন্য সুখবর - dainik shiksha এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের জন্য সুখবর চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের অভিযুক্ত নারায়ণ চন্দ্র নাথের কাহিনী - dainik shiksha চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের অভিযুক্ত নারায়ণ চন্দ্র নাথের কাহিনী সনদ জালিয়াতিতে জড়িত সবাইকে আইনের আওতায় আনা হবে - dainik shiksha সনদ জালিয়াতিতে জড়িত সবাইকে আইনের আওতায় আনা হবে শিক্ষার্থীদের প্রযুক্তির উদ্ভাবক হওয়ার আহ্বান শিক্ষামন্ত্রীর - dainik shiksha শিক্ষার্থীদের প্রযুক্তির উদ্ভাবক হওয়ার আহ্বান শিক্ষামন্ত্রীর শিক্ষকদের বেতন আটকে সর্বজনীন পেনশন যোগ দিতে চাপের অভিযোগ - dainik shiksha শিক্ষকদের বেতন আটকে সর্বজনীন পেনশন যোগ দিতে চাপের অভিযোগ কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে উপবৃত্তির সব অ্যাকাউন্ট নগদ-এ রূপান্তরের সময় ফের বৃদ্ধি - dainik shiksha উপবৃত্তির সব অ্যাকাউন্ট নগদ-এ রূপান্তরের সময় ফের বৃদ্ধি দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0030059814453125