ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর নিজস্ব ভাষায় শিক্ষা ও করণীয়

শরীফুল্লাহ মুক্তি |

চার থেকে দশ বছর বয়সের উপজাতি শিশুর সংখ্যা প্রায় পাঁচ লাখ। এদের মধ্যে বড় একটি অংশ বিদ্যালয়ে ভর্তি হচ্ছে না বা ভর্তি হলেও ঝরে পড়ছে। এর একটি অন্যতম কারণ হলো তাদের নিজস্ব ভাষায় পড়ালেখা করার সুযোগ না থাকা। এ অবস্থার উন্নতি না ঘটিয়ে ‘সবার জন্য শিক্ষা’ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা কঠিন।

প্রায় সব নৃ-গোষ্ঠীর রয়েছে নিজস্ব ভাষা। কারো নিজস্ব বর্ণমালা আছে। অনেকের নিজস্ব বর্ণমালা হারিয়ে গেছে। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সকল ভাষায় লিপি নেই, সাহিত্য নেই, লেখা নেই। তাদের নিজস্ব মাতৃভাষায় সরকারি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার কোনো সুযোগও ছিল না। ফলে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর শিশুরা বাংলাভাষায় শিক্ষা নিতে বাধ্য হতো। কিন্তু স্কুলে আসার পর প্রথমে তারা বাংলাভাষা বুঝতে পারে না। পরিবারের সদস্যদের কাছে মাতৃভাষায় কথা শেখে শিশুরা। তাদের জন্য স্কুলে গিয়ে বাংলা বর্ণমালায় পাঠ নেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। বাংলায় ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মাতৃভাষার উচ্চারণও বিকৃতি হয়ে যায়। তাই সরকার পাঁচটি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর শিশুদের মাতৃভাষায় পাঠদানের সিদ্ধান্ত নেয়। তারই পরিপ্রেক্ষিতে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, ওঁরাও, গারো জনগোষ্ঠীর শিশুদের জন্য তাদের মাতৃভাষায় প্রস্তুত করা হচ্ছে প্রাক-প্রাথমিক পর্যায়ের পাঠ্যবই ও শিক্ষা-উপকরণ (ফ্লিপ-চার্ট, ফ্লাশ-কার্ড, স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণের চার্ট ইত্যাদি)। শিক্ষকদের জন্য পাঠদান নির্দেশিকাও তৈরি করা হচ্ছে।

চাকমা ও মারমা ভাষার বইগুলো তাদের নিজস্ব লিপিতে লেখা। বাকি তিনটি ক্ষুদ্র জাতিসত্তার বইয়ের কোনোটি বাংলা লিপিতে কোনোটি রোমান হরফে। চাকমা ভাষা ও বর্ণমালা আছে। কিন্তু এই বর্ণমালা দিয়ে চাকমা ভাষা লেখা হয় না। চাকমা ভাষা বিষয়ে প্রাতষ্ঠানিক শিক্ষারও সুযোগ নেই। যে কারণে চাকমা ভাষা সম্পর্কে অনেক চাকমারই যথাযথ ধারণা নেই। কাজেই চাকমা ভাষা বাংলায় লিখতে গিয়ে অনেক ভুল হয় এবং অনেক শব্দ বিকৃতভাবে প্রকাশ পায়। সরকারি উদ্যোগের কারণে চাকমারা মাতৃভাষায় লেখাপড়ার মাধ্যমে নিজেদের ভাষা শিখবে। উপজাতিদের মধ্যে ত্রিপুরার সংখ্যা অনেক কম। প্রায় ২ লাখ ত্রিপুরা বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। ফলে ত্রিপুরারা মাতৃভাষায় শেখার সুযোগ পায় না। যতটুকু সুযোগ আছে তা ব্যক্তি উদ্যোগে। ত্রিপুরা ভাষা রক্ষার জন্য ত্রিপুরাদের মাতৃভাষায় শিক্ষাদান বহুদিনের দাবি।

শিক্ষাক্রম বিশেষজ্ঞদের মতে, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর শিশুদের মাতৃভাষা সঠিক উচ্চারণের মাধ্যমে শিক্ষা না দিলে আসল উদ্দেশ্য ব্যাহত হবে। ঠিকভাবে পাঠদান করা হচ্ছে কি না এজন্য ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানুষদের নিয়ে একটি কমিটি গঠন করা উচিত। এ ছাড়া সারা দেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর শিশুদের মাতৃভাষায় পাঠদানের জন্য উপযোগিতা যাচাই করে পরবর্তী কর্মপরিকল্পনা তৈরিরও পরামর্শ আছে তাদের। এ বছর শুধু প্রাক-প্রাথমিকের শিক্ষার্থীদের মাতৃভাষায় বই দেওয়া হয়েছে। ২০১৮ সালে প্রথম শ্রেণি ও এর পরের বছর দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থীদের বইও মাতৃভাষায় ছাপিয়ে বিনামূল্যে বিতরণ করা হবে।

সরকারের এ উদ্যোগের ফলে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ভাষা বিকৃতি ও হারিয়ে যাওয়া থেকে রক্ষা পাবে। তবে শুধু পাঠ্যবই রচনা করলে এর উদ্দেশ্য সফল হবে না; যথাযথভাবে শিক্ষার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।  একটি কাজ শুরু করলে প্রথম প্রথম কিছু সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। কিন্তু সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে সব সমস্যার সমাধান করা সম্ভব। সরকারকে এজন্য  ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বিভিন্ন ভাষাভাষীর শিক্ষক নিয়োগ এবং প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। বর্তমানে এইসব ভাষায় পাঠদানের জন্য পর্যাপ্ত শিক্ষক নেই। যেখানে নৃ-গোষ্ঠীর শিক্ষক নেই, সাময়িকভাবে অন্যত্র থেকে বদলি করে এনে পাঠদানের ব্যবস্থা করা যায়। প্রয়োজনে আউটসোর্সিং-এর মাধ্যমে নিয়োগ বা স্থানীয় প্যারা শিক্ষক নিয়োগ করা যেতে পারে।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
সব মাদরাসার ওয়েবসাইট ও তথ্য হালনাগাদের নির্দেশ - dainik shiksha সব মাদরাসার ওয়েবসাইট ও তথ্য হালনাগাদের নির্দেশ অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা অবৈতনিক : দুই মন্ত্রণালয় যা করবে - dainik shiksha অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা অবৈতনিক : দুই মন্ত্রণালয় যা করবে নার্সিং-মিডওয়াইফারি ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ - dainik shiksha নার্সিং-মিডওয়াইফারি ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ শুক্রবার স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত হয়নি, জানালো শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha শুক্রবার স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত হয়নি, জানালো শিক্ষা মন্ত্রণালয় চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ করার বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রী যা জানালেন - dainik shiksha চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ করার বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রী যা জানালেন গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ, পাস ৩৬.৩৩ শতাংশ - dainik shiksha গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ, পাস ৩৬.৩৩ শতাংশ দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে বেসরকারি শিক্ষকদের বদলির উদ্যোগ স্থগিতের নেপথ্যে - dainik shiksha বেসরকারি শিক্ষকদের বদলির উদ্যোগ স্থগিতের নেপথ্যে শিক্ষাখাতে অপপ্রচারে ভূয়া অভিভাবক ফোরাম, জাল সনদের অধ্যক্ষ - dainik shiksha শিক্ষাখাতে অপপ্রচারে ভূয়া অভিভাবক ফোরাম, জাল সনদের অধ্যক্ষ please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0026500225067139