গ্যাস-বিদ্যুৎসহ সম্ভাব্য দুর্ঘটনা থেকে সাবধান থাকার উপায়

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

শুক্রবার নারায়ণগঞ্জে মসজিদে বিস্ফোরণের ঘটনার পর এসি ব্যবহার, গ্যাসের লাইনের নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিষয়গুলো নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় আলোচনা করতে দেখা গেছে ব্যবহারকারীদের।

নারায়ণগঞ্জে দুর্ঘটনার খবর প্রকাশিত হওয়ার পর প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছিল যে এসি বিস্ফোরণের কারণে দুর্ঘটনাটি ঘটেছে, তবে পরবর্তীতে ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে জানানো হয় যে মসজিদটির মেঝের নিচ দিয়ে যাওয়া গ্যাসের পাইপে ফুটো থাকায় মসজিদের ভেতরে গ্যাস জমে দুর্ঘটনাটি ঘটে থাকতে পারে। রোববার (৬ সেপ্টেম্বর) বিবিসি অনলাইনে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়।  প্রতিবেদনটি লিখেছেন নাগিব বাহার।

প্রতিবেদনে আরও জানা যায়, বাংলাদেশে গ্যাসের লাইনে লিক থাকা, এসি বিস্ফোরণ, গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ ও বৈদ্যুতিক গোলযোগের কারণে অগ্নিকাণ্ড বা বিস্ফোরণের মত ঘটনা প্রায়ই ঘটে থাকে। আর অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এ ধরণের দুর্ঘটনাগুলো ঘটে থাকে বাসা বাড়িতে।

বাংলাদেশে বাসা বাড়িতে সাধারণত যেসব কারণে আগুন লাগে এবং সেসব দুর্ঘটনা এড়াতে যেসব বিষয়ের দিকে নজর রাখা প্রয়োজন, সেগুলো তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে এই প্রতিবেদনে।


বৈদ্যুতিক গোলযোগ
বাংলাদেশে প্রতিবছর মোট যত অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে তার সিংহভাগের উৎস বৈদ্যুতিক গোলযোগ।

ফায়ার সার্ভিসের তথ্য অনুযায়ী ২০১৯ সালে বাংলাদেশে হওয়া মোট অগ্নিকান্ডের ঘটনার ৩৯ ভাগই ছিল বৈদ্যুতিক গোলযোগের কারণে।

বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট, বিদ্যুতের লোড অনুযায়ী কেবল ব্যবহার না করা, মানসম্পন্ন উপকরণ ব্যবহার না করা, ভবনের নকশায় দুর্বলতা, রক্ষণাবেক্ষণের অভাব ইত্যাদি নানা কারণে একটি ভবনের বৈদ্যুতিক সংযোগ থেকে অগ্নিকাণ্ড সৃষ্টি হতে পারে।

বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স বিভাগের পরিচালক লেফটেন্যন্ট কর্নেল জিল্লুর রহমান বলেন বাংলাদেশে ভবনগুলোতে বৈদ্যুতিক কারণে অগ্নিকান্ডের অন্যতম প্রধান কারণ ভবনের ওয়ারিং সিস্টেমের চেয়ে বেশি লোড দেয়া।

"বাংলাদেশে আশি বা নব্বইয়ের দশকের এরকম বহু পুরনো ভবন রয়েছে যেগুলোর ওয়ারিং সিস্টেম তৈরি করা হয়েছিল সেই সময়কার চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুতের চাপ নেয়ার জন্য। তখন আমাদের জীবনযাত্রা সহজ ছিল, বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতির ব্যবহারও কম ছিল", বলেন মি. রহমান।

"পুরনো ওয়ারিং সিস্টেমের একটি ভবনে যদি এসি, ফ্রিজ, মাইক্রোওয়েভ ওভেন, স্মার্ট টিভির মত যন্ত্র ব্যবহার করা হয় তাহলে স্বাভাবিকভাবেই ঐ ওয়ারিং সিস্টেম লোড নিতে পারবে না এবং শর্ট সার্কিটের ঝুঁকি তৈরি হবে।"

এছাড়া ব্যবহারকারীদের অসচেতনতার জন্যও অনেক সময় বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট হয়ে থাকে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

"ছোট ছোট বৈদ্যুতিক যন্ত্রাংশ, যেমন মাল্টিপ্লাগ বা সকেট কেনার ক্ষেত্রে আমরা টাকা বাঁচাতে কম দামীগুলো কিনে থাকি এবং মাল্টিপ্লাগে ফ্রিজ, ওয়াশিং মেশিনের মত ভারী যন্ত্রপাতি সংযুক্ত করি। এই কমদামী মানহীন মাল্টিপ্লাগ ব্যবহার করা বা একটি প্লাগে একাধিক বৈদ্যুতিক যন্ত্র সংযুক্ত করে চালানো শর্ট সার্কিটের একটি বড় কারণ।"

বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করার ক্ষেত্রেও সচেতনতা বাড়াতে হবে বলে মন্তব্য করেন মি. রহমান। দীর্ঘসময় এসি চালিয়ে রাখার ফলে ভবনের বৈদ্যুতিক সক্ষমতার ওপর চাপ পড়তে পারে, যেখান থেকে অনেকসময় দুর্ঘটনা ঘটে থাকে।

আবার দীর্ঘ সময় লাইট বা ফ্যান অন করে রাখা, কম্পিউটার বা টেলিভিশনের পাওয়ার সোর্স বন্ধ না করার ফলেও শর্ট সার্কিটের সূত্রপাত হতে পারে।

বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি ব্যবহারের ক্ষেত্রে সচেতনতা তৈরির পাশাপাশি ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি কেনার ক্ষেত্রে গ্যারান্টি বা ওয়ারান্টিসহ প্রতিষ্ঠিত ব্র্যান্ডের পণ্য কেনার পরামর্শ দেন মি. রহমান।

"এসি কেনার ক্ষেত্রে টাকা বাঁচাতে গিয়ে আমরা অনেকসময়ই ভালো ব্র্যান্ডের এসি না নিয়ে নন ব্র্যান্ডের সস্তাগুলো নিয়ে থাকি। কিন্তু সেটি আসলে পেশাদার মেকানিক তৈরি করছেন না ধোলাইখালের মত জায়গায় তিন-চারটা নষ্ট এসি থেকে ভালো পার্টসগুলো নিয়ে তৈরি হচ্ছে, তা আমরা জানি না। তাই এরকম যন্ত্র কেনার সময় দাম বেশি হলেও ভালো ব্র্যান্ডের পণ্য কেনা উচিত।"

গ্যাসের লাইনে ত্রুটি
গ্যাসের লাইনে ত্রুটি থাকার কারণে গ্যাস লিক করে বিস্ফোরণ বা অগ্নিকাণ্ডের মত ঘটনা বাংলাদেশে প্রায়ই শোনা যায়।

দীর্ঘসময় যাবত গ্যাস লাইনের রক্ষণাবেক্ষণ না করা, অবৈধভাবে গ্যাসের সংযোগ নেয়া, অপরিকল্পিতভাবে মত বিভিন্ন কারণে গ্যাস বিস্ফোরণের মত ঘটনা ঘটে থাকে।

ফায়ার সার্ভিসের তথ্য অনুযায়ী ২০১৯ সালে বাংলাদেশের মোট অগ্নিকান্ডের অন্তত ১৮ ভাগের উৎস ছিল চুলার আগুন থেকে। তবে সংস্থাটির অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স বিভাগের পরিচালক জিল্লুর রহমানের মতে, এগুলোর সিংহভাগেরই কারণ ছিল ব্যবহারকারীদের অসতর্কতা ও অসচেতনতা।

তবে গ্যাসের লাইনে সমস্যা থাকার কারণেও রান্নাঘর থেকে বাড়িতে আগুন লাগতে পারে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

"শহরের বস্তি এলাকাগুলোতে প্রায়ই দেখা যায় চুরি করে অবৈধভাবে গ্যাসের সংযোগ নেয়া হয়। আবার অনেক ক্ষেত্রে হয়তো গ্যাসের সংযোগ ত্রুটিপূর্ণ থাকে। এরকম সংযোগ থেকে নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি হয়।"

নিয়মিতভাবে বাসার গ্যাসের সংযোগ মেকানিকের মাধ্যমে পরীক্ষা করার পাশাপাশি লাইনে কোনো সমস্যা দেখা দিলে অতিসত্বর যথাযথ কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা উচিত বলে মন্তব্য করেন মি. রহমান।


গ্যাস সিলিন্ডার
বাংলাদেশে গত কয়েকবছরে রান্না করার জন্য গ্যাস সিলিন্ডারের ব্যবহার যেমন বেড়েছে, তেমনি গ্যাস সিলিন্ডারের কারণে অগ্নিকান্ড বা বিস্ফোরণের মত দুর্ঘটনার হারও বেড়েছে।

বাংলাদেশে বিস্ফোরক অধিদপ্তরের ২০১৬ সালের হিসেব অনুযায়ী রান্নার কাজে ব্যবহার করা গ্যাস সিলিন্ডারের সংখ্যা প্রায় ৫০ লাখ।

যেসব গ্রাহক সিলিন্ডার ব্যবহার করেন কিংবা মাঠ পর্যায়ে যারা ডিলার তাদের, তাদের অনেকেই সিলিন্ডারের ভালো-মন্দ বুঝতে পারেন না।

বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতির মত রান্নার কাজে ব্যবহৃত গ্যাস সিলিন্ডারের ক্ষেত্রেও কমদামী এবং মানহীন সিলিন্ডার কেনার ফলে দুর্ঘটনার ঝুঁকি বেড়ে যায় বলে মন্তব্য করেন গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহারের ক্ষেত্রে সচেতনতা তৈরির কাজ করা একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান 'সেইফ সিলিন্ডার ক্যাম্পেইন'এর প্রধান মশিউর খন্দকার।

তিনি বলেন, "বাংলাদেশে যেসব গ্যাস সিলিন্ডার পাওয়া যায়, সেগুলোর অনেকগুলো যথাযথ নিয়ম মেনে তৈরি করা হলেও অনেক সিলিন্ডারই নকল হয়ে থাকে। এই নকল সিলিন্ডারগুলোর ক্ষেত্রে অগ্নিকান্ডের ঝুঁকি তৈরি হয়।"

"আবার অনেকসময়ই মেয়াদোত্তীর্ণ সিলিন্ডার ব্যবহার করার ফলে দুর্ঘটনা ঘটে থাকে। সিলিন্ডারগুলোর সাধারণত ১০ বা ১৫ বছরের মেয়াদ থাকে। ঐ মেয়াদের পরেও সেগুলো ব্যবহার করা হলে বিস্ফোরণের সম্ভাবনা থাকে।"

আবার অনেকসময় সিলিন্ডার পরিবহণও যথাযথ নিয়ম অনুযায়ী না করায় সেগুলোতে ত্রুটি দেখা যেতে পারে।

এছাড়া ব্যবহারকারীদের কিছু ভুলের কারণেও গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ হয়ে থাকে বলে মন্তব্য করেন মি. খন্দকার।

"অধিকাংশ সময়ই দেখা যায় গ্যাস সিলিন্ডার রান্নাঘরে চুলার নিচে বদ্ধ অবস্থায় রাখা হয়। বদ্ধ পরিবেশে না রেখে খোলামেলা জায়গায় সিলিন্ডার রাখলে দুর্ঘটনার ঝুঁকি কম থাকে।"

তিনি বলেন একটু লম্বা পাইপ ব্যবহার করে বারান্দায় সিলিন্ডার রাখার চেষ্টা করা উচিত ব্যবহারকারীদের।

এছাড়া সিলিন্ডার কাত করা বা সোজা করে না রাখার ফলেও দুর্ঘটনার ঝুঁকি তৈরি হতে পারে বলে বলেন তিনি।

"অনেকসময়ই দেখা যায় গ্যাস শেষ হয়ে গেলে সিলিন্ডারের পুরো গ্যাস ব্যবহার করার জন্য মানুষ সিলিন্ডার কাত করে, ঝাঁকিয়ে আবার সেটি ব্যবহার করে। কাত করলে তরল গ্যাস সিলিন্ডারের মুখে চলে আসতে পারে, যার ফলে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।"

তিনি বলেন সিলিন্ডার থেকে গ্যাস লিক করছে কি না, তা বোঝার জন্য পাইপের কাছে নাক নিয়ে গন্ধ নেয়ার চেষ্টা করা যেতে পারে।


পানির ট্যাংক ও সেপটিক ট্যাংক
বাংলাদেশে পানির ট্যাংকে বিস্ফোরণ বা সেপটিক ট্যাংকের বিষাক্ত গ্যাসের কারণে হতাহতের ঘটনা খুব বেশি শোনা না গেলেও এই ধরণের দুর্ঘটনা মাঝে মধ্যে ঘটে থাকে।

২০১৮ সালে ঢাকার মিরপুরে পানির রিজার্ভ ট্যাংক পরিষ্কার করতে গিয়ে বিস্ফোরণে অগ্নিদগ্ধ হয়ে একই ভবনের পাঁচজনের মৃত্যুর ঘটনার পর ট্যাংকের নিরাপত্তার বিষয়টি আলোচনা তৈরি করে।

এর আগেও পানির ট্যাংক পরিষ্কার করতে গিয়ে আগুন বা বৈদ্যুতিক টর্চ জালানোর পর জমে থাকা গ্যাসের সংস্পর্শে এসে বিস্ফোরণ ও আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে।

এছাড়া সেপটিক ট্যাংকে জমে থাকা বিষাক্ত গ্যাসের কারণে ট্যাংক পরিষ্কার করতে নামা ব্যক্তিদের মৃত্যুর বেশ কয়েকটি ঘটনা গত কয়েকবছরে ঘটেছে।

এই ধরণের দুর্ঘটনার ঝুঁকি এড়াতে এই কাজে পেশাদার ব্যক্তি বা সংস্থাকে ট্যাংক পরিষ্কার করার দায়িত্ব দেয়া উচিত বলে মন্তব্য করেন বিশেষজ্ঞরা।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
কাল খুলছে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শনিবারও চালু ক্লাস - dainik shiksha কাল খুলছে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শনিবারও চালু ক্লাস সরকারি কলেজ মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও খাদিমের চাকরি জাতীয়করণ দাবি - dainik shiksha সরকারি কলেজ মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও খাদিমের চাকরি জাতীয়করণ দাবি উপবৃত্তির সব অ্যাকাউন্ট নগদ-এ রূপান্তরের সময় বৃদ্ধি - dainik shiksha উপবৃত্তির সব অ্যাকাউন্ট নগদ-এ রূপান্তরের সময় বৃদ্ধি শিক্ষকের বেতন ও শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া রোধে কাজ চলছে: শিক্ষামন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষকের বেতন ও শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া রোধে কাজ চলছে: শিক্ষামন্ত্রী বিএসসি মর্যাদার দাবিতে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের মাসব্যাপী কর্মসূচি - dainik shiksha বিএসসি মর্যাদার দাবিতে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের মাসব্যাপী কর্মসূচি কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে ১৩ বছরের কম বয়সী শিশুদের হাতে স্মার্টফোন নয় - dainik shiksha ১৩ বছরের কম বয়সী শিশুদের হাতে স্মার্টফোন নয় একই স্কুলের দুই ছাত্রীকে বিয়ের পর আরেক ছাত্রীকে ল্যাব সহকারীর অনৈতিক প্রস্তাব - dainik shiksha একই স্কুলের দুই ছাত্রীকে বিয়ের পর আরেক ছাত্রীকে ল্যাব সহকারীর অনৈতিক প্রস্তাব দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশ ১২ মে - dainik shiksha এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশ ১২ মে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.002284049987793