ছাত্র রাজনীতির একাল-সেকাল

মো. নাজমুল হুদা |

ছাত্র রাজনীতির ইতিহাস এক গৌরবময় অধ্যায়। সেই গৌরবময় অধ্যায়ে ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলন, ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ৬ দফা, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং ১৯৯০ সালের সৈরাচারী এরশাদ বিরোধী আন্দোলন এবং সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনে ছাত্র সমাজ সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ ও সমন্বয় ঘটিয়ে গণআন্দোলনের মাধ্যমে তারা ইতিহাস সৃষ্টি করে। আর এ আন্দোলনগুলোর ফলেই আজকের এই স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ আমরা পেয়েছি। আজকের নানা রাজনৈতিক দলের কি কেন্দ্রীয় কি আঞ্চলিক- তাবৎ নেতৃত্বের দিকে তাকালেই দেখা যাবে ওই ছাত্র সংগঠনগুলো থেকে উঠে এসেছে বেশির ভাগ নেতানেত্রী। তারা জাতীয় ঐক্য গড়ে তুললেন ষাটের দশকের শেষদিকে। আর এটির সূচনা হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর হাত ধরে।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অসমাপ্ত আত্মজীবনী যেকোনো রাজনীতিবিদ ও ছাত্র সংগঠন গুলোর জন্য পথপ্রদর্শক। বঙ্গবন্ধু অল্প বয়স থেকে রাজনীতি ও অধিকারসচেতন ছিলেন এবং সক্রিয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করেছিলেন। এ ক্ষেত্রে পরিবারের পক্ষ থেকে তিনি পেয়েছিলেন অকুণ্ঠ সমর্থন ও সহযোগিতা। রাজনীতি ও নিজের শারীরিক অসুস্থ্থতার কারণে মাঝে লেখাপড়া ব্যাহত হয়েছিল, কিন্তু রাজনীতি বন্ধ হয়নি। বাবা শেখ লুত্ফুর রহমান একসময় তাঁকে বলেছিলেন, ‘রাজনীতি করো ভালো কথা, কিন্তু লেখাপড়া বন্ধ কোরো না।’ রাজনীতির প্রতি বাবার উত্সাহ ও লেখাপড়ার প্রতি অনুপ্রেরণা তাঁর এ উক্তি থেকে আমরা অনুধাবন করতে পারি। বঙ্গবন্ধু ছাত্ররাজনীতি ও পরে জাতীয় রাজনীতি করতে গিয়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল, কলকাতা, দিল্লিসহ বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেন। এসব ঘটনা এ বইটিতে উল্লেখ রয়েছে। তাঁর আর্থিক সচ্ছলতা খুব ভালো ছিল না, তবু তাঁর বাবা এবং প্রিয়তমা স্ত্রী তাঁকে সব সময় আর্থিক সহায়তা প্রদান করতেন। বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়াতে কখনো তিনি অসচ্ছলতার পরিচয় দেননি। কোথাও কোথাও না খেয়ে থেকেছেন, কিন্তু মুখ ফুটে বলেননি। বয়োজ্যেষ্ঠদের প্রতি তাঁর ছিল শ্রদ্ধা, সম্মান ও আদেশ মানার প্রবণতা। তিনি প্রচণ্ড ধৈর্য ও সাহসিকতার পরিচয় দিতেন। একজন ছাত্রনেতা হিসেবে তাঁকে সবাই শ্রদ্ধা ও সম্মান করত।

বর্তমান সময়ে এমন ছাত্রনেতা পাওয়া আমরা সহজ মনে করি না। অথচ সময়ের ব্যবধান বড়জোর ষাট বছর। আমরা বঙ্গবন্ধুর সময়ের ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে বর্তমান সময়ের ছাত্ররাজনীতির তুলনা করলে বিরাট পার্থক্য খুঁজে পাই। যে ছাত্ররাজনীতি আগামী দিনের জাতীয় রাজনীতি ও রাষ্ট্র পরিচালনার ভিত, কার্যত সেই রাজনীতি আমরা উপহার দিতে পারছি না। এখনকার কোনো মা-বাবা তাঁদের কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছেলেকে আমার বিশ্বাস বলবেন না লেখাপড়ার পাশাপাশি রাজনীতি করতে। বরং উল্টোটাই বলবেন, কোনোক্রমেই যেন রাজনীতিতে না জড়ায়। কেননা মা-বাবা জানেন, বর্তমান ছাত্ররাজনীতি অতীতের মতো নেই। কোনোক্রমে সন্তানটি রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়লে মা-বাবার আতঙ্কে থাকা ছাড়া কোনো পথ থাকে না। এই একটি জায়গায় মা-বাবার ভয় এতটা বেশি, যেখানে পরীক্ষার ফলাফল একটু খারাপ হলেও নিজেকে মানিয়ে নিতে পারেন। রাজনীতিবিমুখ মা-বাবা কষ্ট করে হলেও ছেলেটিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলে না রেখে মেসে কিংবা ভাড়া বাসায় রাখার ব্যবস্থা করেন। সন্তানটিও কলুষিত ছাত্ররাজনীতিতে বীতশ্রদ্ধ হয়ে নিজ থেকে মেস কিংবা অন্য ব্যবস্থায় চার-পাঁচ বছর কোনোভাবে পার করে দেয়। তাদের অভিযোগ, হলে থাকতে হলে কোনো না কোনো রাজনৈতিক দলের অধীনে থাকতে হয়।

বঙ্গবন্ধুর বাবা এবং তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রী যেভাবে তাঁকে আর্থিক সহায়তা প্রদান করতেন, রাজনীতির প্রতি সেটিও এখনকার সময়ে বিরল। আর্থিক সামর্থ্য থাকলেও এমনটি বর্তমানে পাওয়া দুষ্কর বরং এর উল্টোটাই আমরা লক্ষ করি। ছাত্রনেতা থাকা অবস্থায় বিশাল আর্থিক সম্পদের মালিক হওয়া, বাবার কাছ থেকে টাকা এনে রাজনীতি করার পরিবর্তে উল্টো মা-বাবাকে আর্থিক সহায়তা প্রদান এখন সহজ। হয়তো কোনো কোনো মা-বাবা এর জন্য খুশিও হন। রাজনীতিতে ত্যাগের প্রবণতার বদলে ভোগের চেষ্টা ও প্রবণতা আমাদের পেয়ে বসেছে। কষ্ট ও ত্যাগের এক মহিমা আমরা লক্ষ করি বঙ্গবন্ধুর ছাত্ররাজনীতির মধ্যে।

এ কথা সত্য যে বঙ্গবন্ধুর সময়ের সঙ্গে বর্তমান সময়ের ছাত্ররাজনীতি কিংবা রাজনীতি একই রকম হবে- এমনটি শতভাগ আশা করা ঠিক নয়। অর্থনীতি, সমাজনীতি ও রাজনীতির মধ্যে সময়ের ব্যবধানসহ বহু বিষয়ে পরিবর্তন সূচিত হয়েছে। জীবনযাপনের মান থেকে শুরু করে অন্য অনেক ক্ষেত্রে পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে অন্য অনেক পরিবর্তন হলেও মৌলিক ও কাঠামোগত পরিবর্তন আমরা কেন আশা করব? কেন আমরা বঙ্গবন্ধুর আদর্শ থেকে দূরে সরে যাব? আমরা তা পারি না।

লেখক: শিক্ষার্থী, ৪র্থ বর্ষ , সেশন: ২০১৩-১৪, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
কাল খুলছে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শনিবারও চালু ক্লাস - dainik shiksha কাল খুলছে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শনিবারও চালু ক্লাস সরকারি কলেজ মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও খাদিমের চাকরি জাতীয়করণ দাবি - dainik shiksha সরকারি কলেজ মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও খাদিমের চাকরি জাতীয়করণ দাবি উপবৃত্তির সব অ্যাকাউন্ট নগদ-এ রূপান্তরের সময় বৃদ্ধি - dainik shiksha উপবৃত্তির সব অ্যাকাউন্ট নগদ-এ রূপান্তরের সময় বৃদ্ধি শিক্ষকের বেতন ও শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া রোধে কাজ চলছে: শিক্ষামন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষকের বেতন ও শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া রোধে কাজ চলছে: শিক্ষামন্ত্রী বিএসসি মর্যাদার দাবিতে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের মাসব্যাপী কর্মসূচি - dainik shiksha বিএসসি মর্যাদার দাবিতে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের মাসব্যাপী কর্মসূচি কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে ১৩ বছরের কম বয়সী শিশুদের হাতে স্মার্টফোন নয় - dainik shiksha ১৩ বছরের কম বয়সী শিশুদের হাতে স্মার্টফোন নয় একই স্কুলের দুই ছাত্রীকে বিয়ের পর আরেক ছাত্রীকে ল্যাব সহকারীর অনৈতিক প্রস্তাব - dainik shiksha একই স্কুলের দুই ছাত্রীকে বিয়ের পর আরেক ছাত্রীকে ল্যাব সহকারীর অনৈতিক প্রস্তাব দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশ ১২ মে - dainik shiksha এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশ ১২ মে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0044357776641846