ঝরে পড়া হ্রাসের জন্য প্রয়োজন সমন্বিত উদ্যোগ

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

‘শিক্ষার শেকড়ের স্বাদ তেতো হলেও এর ফল মিষ্টি’—কথাটি বলেছিলেন জগদ্বিখ্যাত বিজ্ঞানী আইনস্টাইন। প্রতিটি জাতির উন্নয়নের পেছনে যে হাতিয়ারটি প্রধান ভূমিকা পালন করেছে সেটি হলো উন্নতমানের শিক্ষা। বাংলাদেশের শিক্ষার দিকে তাকালে দেখতে পাই এ দেশ শিক্ষাক্ষেত্রে এগিয়ে যাচ্ছে, বেড়েছে শিক্ষার হার, প্রাথমিকে ঝরে পড়ার হারও কিছুটা কমেছে এবং বর্তমান সরকারও শিক্ষাখাতকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে এবং বাংলাদেশ দ্রুতগতিতে উন্নয়নের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এই সফলতার পাশাপাশি আমাদের শিক্ষাক্ষেত্রে অনেক দুর্বলতাও বিদ্যমান রয়েছে সেগুলোর দিকে তাকানো এবং সমাধান করার এখনই যথোপযুক্ত সময়। শুক্রবার (১৬ আগস্ট) ইত্তেফাক পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়। নিবন্ধটি লিখেছেন ইব্রাহিম বিন আমজাদ।

সে সমস্যাগুলোর অন্যতম হলো—মাধ্যমিকে ক্রমবর্ধমান হারে ঝরে পড়া। আমরা যদি পরিসংখ্যানের দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাব, সরকারের সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে মাধ্যমিকে ঝরে পড়ার হার ৪০ শতাংশের মতো। এর মধ্যে ছাত্রদের তুলনায় ছাত্রীদের ঝরে পড়ার হারই বেশি। মাধ্যমিক স্তরে ছাত্রদের তুলনায় বেশি ভর্তি হয় ছাত্রীরা অথচ ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হওয়া ৪০ দশমিক ১৯ শতাংশ ছাত্রী ঝরে পড়ছে দশম শ্রেণি শেষ করার আগেই, যা খুবই উদ্বেগজনক।

অন্য এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, যেখানে মাধ্যমিকে ২০১৯ সালে পাশ করেছে ১৭ লাখ ৪৯ হাজার ১৬৫ জন শিক্ষার্থী সেখানে এইচএসসিতে ভর্তির জন্য আবেদন করেছে ১৪ লাখ ১৫ হাজার ৮২৫ জন শিক্ষার্থী। অর্থাত্ প্রায় সাড়ে ৩ লাখ শিক্ষার্থী এইচএসসিতে ভর্তি হচ্ছে না বরং ঝরে পড়ছে।

২০১৮ সালের দিকে তাকালেও অনেকটা একই চিত্র দেখতে পাব। সে বছর এসএসসিতে পাশ করেছে ১৫ লাখ ৭৬ হাজার ১০৪ জন শিক্ষার্থী। সেখান থেকে এইচএসসিতে ভর্তির জন্য আবেদন করেছে ১২ লাখ ৫৬ হাজার ৫০০ জন। অর্থাত্ ৩ লাখেরও অধিক শিক্ষার্থী ঝরে পড়ছে।

এই বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার বিষয়টি এখন উদ্বেগজনক আকার ধারণ করেছে। এভাবে ঝরে পড়ার পেছনে যেমন একাধিক কারণ রয়েছে তেমনি এর ফলাফলও দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে।

এই ঝরে পড়ার পেছনে যে কারণগুলো সবচেয়ে বেশি দায়ী তার অন্যতম হলো দারিদ্র্য। যে যা-ই বলুক না কেন, এখনো বাংলাদেশে নিম্ন-আয়ের মানুষের সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি। যেখানে তিনবেলা খেতেই অনেক পরিবারের হিমশিম খেতে হয়, সেখানে তারা তাদের ছেলেমেয়েকে পড়াশুনার জন্য স্কুলে ভর্তি করলেও একটা পর্যায়ে তারা কুলাতে না পেরে ছেলেদেরকে অর্থ উপার্জনের জন্য বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে লাগিয়ে দেয়, ফলে শিক্ষার জগত্ থেকে তারা ছিটকে পড়ছে। তাছাড়া আমরা জানি যে শিক্ষার ফল রাতারাতি পাওয়া যায় না, এটি সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। সেজন্যও অনেকে শিক্ষার দ্বার থেকেই ফিরে আসে।

দ্বিতীয় যে কারণটির কথা বলবো সেটি হলো শিক্ষা সম্পর্কে সচেতনতার অভাব। আমাদের দেশের বাবা-মায়েরা অধিকাংশই অশিক্ষিত। যা তাদের অসচেতনতার জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী। আর তাদের এই অসচেতনতার বিরূপ প্রভাব পড়ে তাদের সন্তানদের শিক্ষার ওপর। তারা শিক্ষার পিছনে বিনিয়োগ করতে রাজি নন কারণ এই বিনিয়োগের মুনাফা সম্পর্কে জ্ঞাত হওয়া তাদের বিচক্ষণতার সীমাবদ্ধতার বাইরে। ফলে তারা জানে না শিক্ষার সুমিষ্ট ফলাফল সম্পর্কে। তাদের এই অসচেতনতা শিক্ষার একটা পর্যায় অতিক্রম করার পর পড়াশোনা চালানোর ওপর অনীহা সৃষ্টি করে এবং ছেলেদেরকে অর্থ উপার্জন করে পরিবারের হাল ধরতে উত্সাহিত করে। যা ছাত্রদের ঝরে পড়ার অন্যতম কারণ। আর ছাত্রীদের ক্ষেত্রে ঝরে পড়ার জন্য সবচেয়ে বেশি যে কারণটি দায়ী তা হলো বাল্যবিবাহ। শহরাঞ্চলে কিছুটা পরিবর্তন দেখা গেলেও বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলসমূহে বাল্যবিবাহ এখনো প্রকট আকারে প্রচলিত রয়েছে। এখনো অনেক বাবা-মা মেয়েদেরকে বোঝা মনে করে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিয়ে দিয়ে বোঝামুক্ত হওয়ার চেষ্টা করে। বিয়ে হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের পড়াশোনাও বন্ধ হয়ে যায় এবং শিক্ষার দ্বার থেকে ঝরে পড়ে।

এছাড়া দেশের শিক্ষাকাঠামো, শিক্ষার প্রতি শিক্ষার্থীদের অনীহা, শিক্ষার্থীদের তুলনায় শিক্ষকদের অপ্রতুলতা, মানসম্মত শিক্ষকের অভাব, শিক্ষার্থীদের পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধার অভাব, শিক্ষায় বাজেটের অপ্রতুলতা ইত্যাদি কারণগুলোও কম দায়ী নয়। এ ঝরে পড়া কমানোর জন্য সর্বপ্রথম যে পদক্ষেপটি নিতে হবে তা হলো প্রতিটি পরিবারকে শিক্ষা সম্পর্কে সচেতন করতে হবে। তাদের বোঝাতে হবে জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান বিনিয়োগ হলো শিক্ষার জন্য বিনিয়োগ।

আশার বাণী হলো দেশে দারিদ্র্যের হার উল্লেখযোগ্যহারে কমছে। আর যদি ইচ্ছে থাকে তাহলে অনেক ক্ষেত্রে দারিদ্র্যকেও জয় করে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব, আর সেজন্য প্রয়োজন শিক্ষার প্রতি ইতিবাচক মনোভাব। যার উদাহরণ আমরা প্রতিনিয়ত দেখতে পাচ্ছি।

বর্তমান সরকার বিদ্যালয়ে ঝরে পড়া কমানোর জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। যেমন বছরের শুরুতে বিনামূল্যে পাঠ্যবই বিতরণ, উপবৃত্তি প্রদান ইত্যাদি। কিন্তু এ সুযোগ-সুবিধাগুলো আমাদের শিক্ষার্থীদের জন্য পর্যাপ্ত নয়। শিক্ষার্থীদের সমস্যাগুলো জেনে নিয়ে এর সমাধানের জন্য সরকারকে আরো দায়িত্বশীল হতে হবে, শিক্ষাখাতে বার্ষিক বাজেটের পরিমাণ বাড়াতে হবে এবং সর্বোপরি মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে ও ঝরে পড়া হ্রাস করতে শিক্ষার্থী, শিক্ষক, অভিভাবক ও সরকারের সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে। তাহলেই আমরা একটি ঝরে পড়া হ্রাস করতে সক্ষম হব এবং বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়তে আরো একধাপ এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ।

লেখক : শিক্ষার্থী, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
শুক্রবার স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত হয়নি, জানালো শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha শুক্রবার স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত হয়নি, জানালো শিক্ষা মন্ত্রণালয় স্কুল-কলেজ শিক্ষকদের এপ্রিল মাসের এমপিওর চেক ছাড় - dainik shiksha স্কুল-কলেজ শিক্ষকদের এপ্রিল মাসের এমপিওর চেক ছাড় গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটে প্রথম লামিয়া - dainik shiksha গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটে প্রথম লামিয়া প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে দ্বিতীয় ধাপের চূড়ান্ত ফল আগামী সপ্তাহ - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে দ্বিতীয় ধাপের চূড়ান্ত ফল আগামী সপ্তাহ ছাত্রলীগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিলিস্তিনের পতাকা উড়াবে কাল - dainik shiksha ছাত্রলীগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিলিস্তিনের পতাকা উড়াবে কাল চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ করার বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রী যা জানালেন - dainik shiksha চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ করার বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রী যা জানালেন গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ, পাস ৩৬.৩৩ শতাংশ - dainik shiksha গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ, পাস ৩৬.৩৩ শতাংশ কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0029671192169189