ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে চাই সর্বাত্মক সমন্বিত উদ্যোগ

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

একটি  দৈনিকে ছোট্ট সিঙ্গেল কলামের সংবাদ শিরোনাম ‘মশা কি মন্ত্রীর কথা শোনে’। না, শোনে না। তবে শোনার মতো বলতে পারলে বা কাজ করতে পারলে শোনে। অর্থাৎ ভয়ে অতিদূরে উড়ে চলে যায় অথবা বিষাক্ত ওষুধের ক্রিয়ায় মারা যায়। মশক নিধনের বেড়াজালটা যদি যথাযথভাবে বিস্তৃত করা যায়, তাহলে অন্যত্র উড়ে গিয়েও নিস্তার পায় না। সেখানেও ছিটানো বিষাক্ত মশক নিধনের ওষুধের ক্রিয়ায় মশককুলের মৃত্যু—হোক তা ডেঙ্গি ভাইরাসের বাহক এডিস মশা কিংবা ম্যালেরিয়া প্যারাসাইটবাহক অ্যানোফিলিস মশা বা কিউলেক্স প্রজাতির। বৃহস্পতিবার (৮ আগস্ট) কালের কণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়। নিবন্ধটি লিখেছেন আহমদ রফিক।

ঢাকার ক্ষেত্রে উদাহরণ রয়েছে সেই শেষ চল্লিশের দশক থেকে পঞ্চাশের প্রথম দিকে। কুখ্যাত, প্রতিক্রিয়াশীল মুসলিম লীগ দলের স্বাস্থ্যমন্ত্রী কবি, উদারপন্থী রাজনীতিক হাবীবুল্লাহ বাহার। ঢাকার আশপাশ তখন বন-জঙ্গলে ঝোপঝাড়ে ঢাকা। জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থাও খুব একটা উচ্চমানের নয়। তেমন একটি সামাজিক পরিস্থিতিতে বাহার সাহেবের আন্তরিক প্রচেষ্টায় মূল শহর ঢাকা মশকমুক্ত হয়ে কিংবদন্তি রচনা করেছিল।

তখন দেখেছি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মাঠকর্মীরা কাঁধে টিনের ওষুধ কনটেইনার, এক হাতে স্প্রে মেশিন, অন্য হাতে ওষুধের বোতল নিয়ে ঝোপঝাড়ে, শহরের ড্রেনে, জমা পানিতে মশকনাশক ওষুধ ছিটাচ্ছে, এবং তা নিয়মিত। ওষুধও এখনকার মতো ভেজাল নয়, আদি ও অকৃত্রিম। ফলে রাসায়নিকের প্রভাবে মশক নিধন নিশ্চিত।

স্বাস্থ্যমন্ত্রীর এ সাফল্যের একটি নান্দনিক উদাহরণ টেনে বাহার প্রসঙ্গে ইতি টানব। তখনকার মেডিক্যাল কলেজ ব্যারাক অর্থাৎ হোস্টেলের ছাত্রদের মধ্যে ছিল সাহিত্য-সংস্কৃতিচর্চার প্রতি বেজায় আকর্ষণ এবং তা নানা মাত্রার। কবিতা, গল্প-প্রবন্ধ লেখার চেয়েও বেশি টান গানে ও মঞ্চনাটকে, এমনকি ব্যারাকের বাঁশের বেড়ার চালে গভীর রাতে সাঁটানো দেয়াল পোস্টারের নানা মাত্রিক ভাষ্যে। এতে ছিল যথেষ্ট কৌতুক ও নান্দনিক রসবোধ, থাকত প্রতিযোগিতাও। তাই এক সকালে একটি পোস্টারে দেখা গেল, একটি প্রশ্নের (যত দূর মনে পড়ে স্বাস্থ্যবিষয়ক) জবাবে মোটা মোটা সুশ্রী অক্ষরে লেখা : ‘হামসে না পুছো, পুছো বাহার সে’। অর্থাৎ মন্ত্রী বাহার সাহেবই এ প্রশ্নের জবাব। ঢাকা শহরকে মশকমুক্ত করার ইনাম এভাবে বাহার সাহেবকে দিয়েছিলেন মেডিক্যাল ছাত্ররা। তাই বলতে হয়, সদিচ্ছায় কী না হয়।

দুই.

চিকিৎসাশাস্ত্রে একটি অসাধারণ আপ্তবাক্য ‘প্রিভেনশন ইজ বেটার দ্যান কিউর’। অর্থাৎ চিকিৎসার চেয়ে, প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ অনেক উত্তম ব্যবস্থা। অবশ্য যদি প্রতিরোধের উপায় থাকে। এ আপ্তবাক্যটির সাফল্য যুগ-যুগান্তরের। আমাদের দেশেও বড় উদাহরণ কালান্তক রোগ গুটিবসন্ত অর্থাৎ স্মলপক্স রোগের নিরসন। এবং তা প্রতিষেধক ভ্যাকসিন ব্যবহার করে, অবশ্য যথাযথ নিয়মে। যেমন পোলিও ও সংশ্লিষ্ট একাধিক রোগ।

মশকবাহিত রোগগুলোও এই প্রতিরোধক ব্যবস্থার অন্তর্গত। ম্যালেরিয়া থেকে ডেঙ্গুর মতো মশকবাহিত রোগ নির্মূল করার একমাত্র সহজ উপায় সঠিক মশকবিরোধী বিষাক্ত রাসায়নিক নিয়মনিষ্ঠভাবে ব্যবস্থাপত্রমাফিক সঠিক মাত্রায় ব্যবহার করা যথাস্থানে, যাতে মশককুলের নির্মূল অভিযান সফল হয়। অবশ্য এ ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা রয়েছে নাগরিকদের, যাতে প্রচারিত নিয়ম-কানুনগুলো মেনে চলে। মশক উৎপাদনে সহায়ক না হয়।

কিন্তু বসন্ত বা পোলিওর মতো সাফল্য এ ক্ষেত্রে আমরা অর্জন করতে পারিনি। এ ব্যর্থতার মূল দায় যতটা নাগরিকদের, তার চেয়ে অনেক বেশি সংশ্লিষ্ট স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের—হোক তা মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর কিংবা প্রত্যক্ষভাবে সিটি করপোরেশন প্রশাসন। তত্ত্বগত ও বস্তুগত এই দুই দিককার ঘাটতিই এই ব্যর্থতার জন্য দায়ী।

আমাদের স্বভাবে গতানুগতিকতার এবং আলস্য-অবহেলার একটি প্রবল প্রভাব বিদ্যমান। দামামা না বাজলে আমাদের ঘুম ভাঙে না। নিত্যদিনের নিয়মিত কাজের কথা মনে পড়ে না। ম্যালেরিয়া থেকে ডেঙ্গুর প্রতিরোধে মশক নিধন কর্মসূচি যে আমাদের নিয়মিত দায়িত্ব ও কর্মসূচির অংশ, সে কথা আমরা মনে রাখিনি। সে জন্যই বিপর্যয়।

তিন.

আমাদের এ দায়িত্বহীনতার উদাহরণ অনেক। ডেঙ্গুর প্রকোপ সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোকে সতর্ক করেছিল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০১২ সালে, আজ থেকে সাত বছর আগে। ভারতীয় উপমহাদেশের অন্তর্গত বাংলাদেশ রাষ্ট্র ডেঙ্গু উপদ্রুত অঞ্চলের অন্তর্গত। সাত বছর প্রতিরোধ-সংক্রান্ত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য যথেষ্ট সময়।

কিন্তু ওই সতর্কতার ঘণ্টাধ্বনিতে আমাদের ঘুম ভাঙেনি। এরই মধ্যে ডেঙ্গু ও অনুরূপ রোগ চিকুনগুনিয়া এসেছে, গেছে, এই তো বছর দুই আগেকার কথা। শেষোক্ত রোগের বিশেষ প্রকোপ এবং তা এই মশকবাহিত রোগই বটে। তা সত্ত্বেও মশক নিধনের সার্বিক ব্যবস্থাপনার কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি। উদ্যোগ নেওয়া হলে আজ ডেঙ্গুর ভয়ংকর রূপ দেখতে হতো না।

শুধু তা-ই নয়, মশক নিধন কর্মসূচিতে এরই মধ্যে ঢুকে গেছে দুর্নীতি, সর্ষের মধ্যে ভূত। বিশেষ করে তা বোঝা গেল যখন ডেঙ্গু এ বছর ভয়াবহ রূপ নিয়ে হাজির, মহানগর ঢাকাতেই নয়, একাধিক দূর জেলায় পর্যন্ত এর বিস্তার, হাসপাতালগুলো ডেঙ্গু রোগীতে সয়লাব। যখন সংবাদপত্রে শিরোনাম : ‘১৮ বছরের রেকর্ড ভাঙল/ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা’। তখন অন্যান্য দৈনিকের অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের কল্যাণে ভয়ংকর সংবাদ প্রকাশিত হলো যে ব্যবহৃত ওষুধে মশা মরছে না, ওষুধ অকার্যকর, সহজে কার্যকর ওষুধ পাওয়ার সম্ভাবনা কম; তখন মানুষের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার জোগাড়।

সবার মুখে ও মনে প্রশ্ন : ‘এবার কী হবে।’ এরই মধ্যে বিভিন্ন মাধ্যমে ক্রমাগত সংবাদ প্রকাশ—ডেঙ্গুর ক্রমবর্ধমান সংখ্যা নিয়ে একের পর এক পরিসংখ্যান। হাসপাতালগুলোয় প্রতিকার তথা চিকিৎসাব্যবস্থা যথারীতি চলছে। তবু মাঝেমধ্যে বিপরীত ধারার সংবাদ, কখনো সংবাদ ডেঙ্গু পরীক্ষার ‘কিট’-এর অভাব, অভাব কখনো রক্তের, এর মধ্যে জনাকয়েক চিকিৎসকের মৃত্যু ডেঙ্গুতে।

স্বভাবতই আতঙ্ক মানুষের মনে, যেমন রাজধানী ঢাকায়, তেমনি দেশের অন্যত্র। কারণ এরই মধ্যে খবরে প্রকাশ, ডেঙ্গু দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে কিন্তু মশা মারার ঘাটতি পূরণ হচ্ছে না, পূরণ করা যাচ্ছে না।

সংগত কারণে দৈনিক পত্রিকায় সংবাদ শিরোনাম : কর্তৃপক্ষের অবহেলায় ডেঙ্গুর প্রকোপ’। তথ্য পরিবেশিত এভাবে : ‘২০০১-এর পর ঢাকায় এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে বড় কোনো উদ্যোগ নেই’। বড় সত্য হলো, এডিস মশা মরছে না, ডেঙ্গু কমছে না, বরং বাড়ছে। ক্রমে তা মহামারির রূপ ধারণ করতে যাচ্ছে।

স্বভাবতই ডেঙ্গু নিয়ে নানা প্রশ্নের জন্ম, সংগত বা অসংগত। এমন প্রশ্নও উঠছে, প্রায় অনুরূপ আবহাওয়া সত্ত্বেও সীমান্তসংলগ্ন পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতায় ঢাকার মতো এত বিস্তার নেই কেন? উত্তর আমাদের অনেকের জানা না থাকলেও এই সংবাদ প্রতিবেদকের ভাষ্যমতে, এডিস মশার প্রাদুর্ভাবের পর থেকে সেখানে মশক নিধনের সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

আর আমাদের মশক নিধন বা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচিতে প্রাধান্য পেয়েছে কখনো অবহেলা, কখনো দুর্নীতি। একটি উপসম্পাদকীয় কলামে একজন অধ্যাপক এ বিষয়ে জানতে চেয়েছেন—সিটি করপোরেশনের ৩২ কোটি টাকা বাজেটের অর্থ কোথায় ও কিভাবে খরচ করা হয়েছে। অর্থাৎ মশক নিধনে কত ব্যয়? আদৌ কোনো ব্যয় হয়েছে কি না।

আলোচনা দীর্ঘায়িত না করে বলি, পরিস্থিতি বিপজ্জনক, ডেঙ্গুতে মৃতের সংখ্যাও কম নয়। এ অবস্থায় প্রধান কর্তব্য, আপাতত দায়-নির্ধারণ নয় (সেটা পরে করা উচিত), সর্বাত্মক সমন্বিত উদ্যোগে ডেঙ্গু প্রতিরোধের একনিষ্ঠ ব্যবস্থা, এডিস মশা নিধন আমাদের একমাত্র লক্ষ্য হওয়া উচিত। চিকিৎসকরা তাঁদের কর্তব্য করতে থাকুন কিন্তু সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো সর্বোচ্চ সততা, নিষ্ঠা ও সতর্কতায় এডিস মশা নিধনের কাজ সম্পন্ন করা। আবারও বলি, প্রতিরোধ কর্মসূচির বিকল্প নেই।

লেখক : কবি, গবেষক, ভাষাসংগ্রামী


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
শুক্রবার স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত হয়নি, জানালো শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha শুক্রবার স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত হয়নি, জানালো শিক্ষা মন্ত্রণালয় স্কুল-কলেজ শিক্ষকদের এপ্রিল মাসের এমপিওর চেক ছাড় - dainik shiksha স্কুল-কলেজ শিক্ষকদের এপ্রিল মাসের এমপিওর চেক ছাড় গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটে প্রথম লামিয়া - dainik shiksha গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটে প্রথম লামিয়া প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে দ্বিতীয় ধাপের চূড়ান্ত ফল আগামী সপ্তাহ - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে দ্বিতীয় ধাপের চূড়ান্ত ফল আগামী সপ্তাহ ছাত্রলীগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিলিস্তিনের পতাকা উড়াবে কাল - dainik shiksha ছাত্রলীগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিলিস্তিনের পতাকা উড়াবে কাল চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ করার বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রী যা জানালেন - dainik shiksha চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ করার বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রী যা জানালেন গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ, পাস ৩৬.৩৩ শতাংশ - dainik shiksha গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ, পাস ৩৬.৩৩ শতাংশ কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0032308101654053