তাহলে কি আপনারা হজও বর্জন করবেন?

মনোয়ারুল হক |

সম্প্রতি যে নারীরা ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে উপস্থিত হয়ে এই দাবি তুললেন যে জাতীয় পরিচয়পত্রে ছবি ব্যবহার না করার। তারা কি তাহলে বিবাহ রেজিস্ট্রেশনেরও বাইরে থাকতে চান? আর তারা যদি হজে যেতে চান, তাহলেও তাদেরকে পাসপোর্ট গ্রহণ করতে হবে এবং সেই পাসপোর্টে তাদের ছবি সংযুক্ত করতে হবে। তা না হলে সৌদি আরব তাদেরকে সেদেশে প্রবেশের অনুমতি দেবে না। তাহলে কি আপনারা হজও বর্জন করবেন?

পৃথিবীর সকল সমাজের বিভাজনের বড় সামাজিক কারণ হচ্ছে ধর্ম। ধর্মীয় মতদ্বৈততাই সমাজকে সবচেয়ে বেশি বিভক্ত করে। তার অসংখ্য উদাহরণ পৃথিবীর নানা সমাজে বিদ্যমান। আমাদের দেশও তার থেকে বাইরে নয়।

অনেক দিন ধরেই মুখ আচ্ছাদিত করে বোরকা পরা নিয়ে নানান আলোচনা চলছিলো। দেশের বিভিন্ন অংশে, পরীক্ষার হলে ছাত্রীরা নেকাব (মুখ আচ্ছাদন) অপসারণ করতে রাজি হচ্ছিলেন না। পরীক্ষার হলে তারা সরাসরি অস্বীকৃতি জানালে বিব্রতকর অবস্থা চলছিলো। ক্ষেত্রবিশেষে দেখা যাচ্ছিলো, তারা এই বোরকার সহযোগিতায় ব্লুটুথ ব্যবহার করে নকল করছে। পরীক্ষা হলের এসব বিষয় যখন সামনে এলো, তখন হাইকোর্ট একটি নির্দেশনা জারি করলো। হাইকোর্ট সুস্পষ্ট আদেশ দিলো, পরীক্ষার হলে তাদের মুখের আইডেন্টিটি প্রকাশ করতে হবে।

এই আদেশ হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের কয়েকজন ছাত্রীর করা রিট মামলায়। আদালতে তারা পরীক্ষার হলে মুখ প্রদর্শন করতে চান না। তাদের আইডেন্টিটি নেয়ার ব্যবস্থা রোধ করতেই ছিলো রিট। সেই আবেদন নিষ্পত্তি করতে গিয়েই আদালত উপরে উল্লেখিত আদেশ প্রদান করেছিলেন।

এরপরেও ব্যাপারটা থেমে থাকেনি, এই উগ্র ধর্মীয় গোষ্ঠী নতুন করে আন্দোলন করার ঘোষণা দিয়ে সংবাদ সম্মেলন করেছে। কয়েক দিন আগে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি সভাকক্ষে সমবেত হলেন কিছু নারী। যারা দাবি করলেন, তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। নিজেদের কোনো পরিচয়পত্র তারা দেখালেন না। তারা সেখানে দাবি করলেন, জাতীয় পরিচয়পত্র করার জন্য ছবি বাধ্যতামূলক রাখা যাবে না। তাদের ছবি তারা লাগাবেন না। অথচ এই নারীরা জানেন, পাসপোর্ট নিতে হলে তাদেরকে অবশ্যই ছবি যুক্ত করতে হবে।

শুধু তাই নয়, বাংলাদেশে বিয়ে রেজিস্ট্রিও বাধ্যতামূলক। তবুও কিছু কিছু ক্ষেত্রে গোপনে অথবা প্রকাশ্যেই বিয়ে সম্পাদন হচ্ছে, রেজিস্ট্রেশন ছাড়াই। কাকরাইল মসজিদের অনুসারীরা অধিকাংশই বিয়ে রেজিস্ট্রি মানতে রাজি নন। রাষ্ট্রীয় আইনে অনেক ক্ষেত্রেই এদের বিবাহ রেজিস্ট্রেশন করা হয় না। আমরা সেই মামুনুল হকের কথা জানি, তিনি যাকে তার দ্বিতীয় স্ত্রী বলে উল্লেখ করেছিলেন, তার পক্ষে তিনি তথ্যপ্রমাণ হাজির করতে পারেননি। 

যে নারীরা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে উপস্থিত হয়ে এই দাবি তুললেন, তারা কি তাহলে বিবাহ রেজিস্ট্রেশনেরও বাইরে থাকতে চান? আর তারা যদি হজ যেতে চান, তাহলেও তাদেরকে পাসপোর্ট গ্রহণ করতে হবে এবং সেই পাসপোর্টে তাদের ছবি সংযুক্ত করতে হবে। না হলে সৌদি আরব তাদেরকে সেদেশে প্রবেশের অনুমতি দেবে না। রিপোর্টার্স ইউনিটির সেই সভায় কোনো সাংবাদিক এই প্রশ্নটি তাদেরকে করেননি, তাহলে কি আপনারা হজও বর্জন করবেন? আপনারা কি হজ করবেন না জীবনে কখনো?

পৃথিবীতে এমন কোনো দেশের সন্ধান পাওয়া যাবে না যেখানে এ ধরনের ব্যবস্থা আছে যে, পাসপোর্ট কিংবা জাতীয় পরিচয়পত্রে ছবির সংযোজন না করলেও চলে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে নারী বিরোধী নানা আইন বিদ্যমান থাকলেও বর্তমানে সৌদি আরব সেখান থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছে। দেশটিতে এক সময় নারীদের গাড়ি চালানো নিষিদ্ধ ছিলো, এখন তারা এই আইন তুলে নিয়েছে।

যে নারীরা ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে গিয়ে ছবি ব্যবহার না করার দাবি তুলেছেন, তারা কাদের প্রতিনিধিত্ব করছেন? ভেবে দেখেছেন? আফগানিস্তানের তালেবানি সমাজের? যে সমাজে নারীশিক্ষা নিষিদ্ধ। নারীরা ঘরের বাইরে চাকরিতে যেতে পারেন না। আমাদের এই নারীরা কি সেই পথেই হাঁটছেন?

বর্তমান সরকারের নারীর ক্ষমতায়নের নানান কার্যক্রমের বিপক্ষে জনমত সৃষ্টির চেষ্টা করছে এই নারীরা? বর্তমানে দেশে বহু ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থা বিদ্যমান। তবে এ উপমহাদেশের তিনটি দেশেরই প্রায় একই অবস্থা। মধ্যে কিছুটা পার্থক্য ভারতে আছে। ভারতের প্রাথমিক শিক্ষা প্রতিটি রাজ্যের নিজস্ব সুনির্দিষ্ট পাঠ্য কার্যক্রমে পরিচালিত হয়। ভারতের কয়েকটি রাজ্যে মাদরাসা শিক্ষার গভীরতা সৃষ্টি হয়েছে; ফলে এই মাদ্রাসা শিক্ষায় শিক্ষিতদের জীবন অর্থনৈতিকভাবে পর্যুদস্ত; তার উদাহরণ-ভারতের পশ্চিমবাংলা। আর আমাদের এখানেও মাদরাসা শিক্ষাকে প্রাধান্য দিয়ে অজস্র মাদরাসা গড়ে উঠেছে। আর মাদরাসার শিক্ষাব্যবস্থা দুর্বল ভিত্তি থাকা সত্ত্বেও মাদরাসা শিক্ষা থেকে অর্জিত ডিগ্রির মাধ্যমে এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আসনে অংশ নেয়া যায়। 

ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে সমঝোতার ফসলই ব্যাপকভাবে মাদ্রাসা শিক্ষার বিকাশ। এ অবস্থার তৈরি হয়েছে বিভিন্ন ধর্মীয় গোষ্ঠীর নানান মতবাদ অবাধে প্রচার করার সুযোগ রাষ্ট্র দীর্ঘকাল বহাল রাখায়। অথচ ছবি সংক্রান্ত এ অদ্ভুত দাবির সঙ্গে সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থায় যারা প্রতিনিধিত্ব করছেন তাদের প্রায় শতভাগ পরিবারের সঙ্গে এই দাবির কোনো মিল নেই। এই দর্শনকে শক্তভাবে মোকাবিলা করতে হবে। নয়তো আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। 

লেখক : মনোয়ারুল হক, রাজনীতি বিশ্লেষক ও কলামিস্ট 

 


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
প্রধানমন্ত্রীর কাছে এসএসসির ফল হস্তান্তর - dainik shiksha প্রধানমন্ত্রীর কাছে এসএসসির ফল হস্তান্তর এসএসসি পরীক্ষার ফল জানবেন যেভাবে - dainik shiksha এসএসসি পরীক্ষার ফল জানবেন যেভাবে এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের জন্য সুখবর - dainik shiksha এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের জন্য সুখবর চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের অভিযুক্ত নারায়ণ চন্দ্র নাথের কাহিনী - dainik shiksha চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের অভিযুক্ত নারায়ণ চন্দ্র নাথের কাহিনী সনদ জালিয়াতিতে জড়িত সবাইকে আইনের আওতায় আনা হবে - dainik shiksha সনদ জালিয়াতিতে জড়িত সবাইকে আইনের আওতায় আনা হবে শিক্ষার্থীদের প্রযুক্তির উদ্ভাবক হওয়ার আহ্বান শিক্ষামন্ত্রীর - dainik shiksha শিক্ষার্থীদের প্রযুক্তির উদ্ভাবক হওয়ার আহ্বান শিক্ষামন্ত্রীর শিক্ষকদের বেতন আটকে সর্বজনীন পেনশন যোগ দিতে চাপের অভিযোগ - dainik shiksha শিক্ষকদের বেতন আটকে সর্বজনীন পেনশন যোগ দিতে চাপের অভিযোগ কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে উপবৃত্তির সব অ্যাকাউন্ট নগদ-এ রূপান্তরের সময় ফের বৃদ্ধি - dainik shiksha উপবৃত্তির সব অ্যাকাউন্ট নগদ-এ রূপান্তরের সময় ফের বৃদ্ধি দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0030419826507568