দাবি, আন্দোলন এবং আন্দোলনের প্রক্রিয়া: জাফর ইকবাল

নিজস্ব প্রতিবেদক |

আমি ইউনিভার্সিটিতে ছেলে-মেয়েদের পড়াই, তারা পাস করে চাকরিবাকরি পাবে কি পাবে না, সেটা নিয়ে কখনো মাথা ঘামাইনি। দেখেছি সবচেয়ে ফাঁকিবাজ ছেলে বা মেয়েটাও কোথাও না কোথাও ঢুকে পড়ছে। তাই দুর্ভাবনা করার কোনো কারণও ছিল না। তবে ইদানীং সহকর্মীদের কেউ কেউ ছেলে-মেয়েদের বিসিএস নিয়ে বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়া নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে শুরু করেছেন। তাঁদের মতে, ক্লাসের লেখাপড়া নিয়ে তাদের মনোযোগ নেই, তারা নাকি দিনরাত বিসিএস গাইড বই মুখস্থ করে! সত্যি-মিথ্যা যাচাই করার কোনো উপায় নেই। তাই আমি সেটা নিয়ে মাথা ঘামাইনি। পত্রপত্রিকায় দেখেছি বিসিএসের কোটা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, বিষয়টা গভীরে ঢোকার চেষ্টা করিনি।

চার দিন আগে ভোরবেলা উঠে খবরে দেখলাম আগের রাতে সরকারি চাকরির কোটার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রীতিমতো রণক্ষেত্র হয়েছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মহোদয়ের এ ব্যাপারে কী করার আছে কে জানে। কিন্তু তাঁর বাসাটা চূর্ণবিচূর্ণ করে দেওয়া হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই ডিপার্টমেন্টে সবাই বিষয়টা নিয়ে আলাপ-আলোচনা করেছেন এবং আমার তরুণ সহকর্মীরা তখন আমাকে কোটা-সংক্রান্ত জটিলতা বুঝিয়ে দিলেন। মূল চাকরির ৫৬ শতাংশ নানা ধরনের কোটা থেকে আসে শুনে আমি বেশ অবাক হলাম, কেউ অস্বীকার করবে না সংখ্যাটা যথেষ্ট বেশি। সেদিন দুপুর বেলায়ই আমাকে একজন সাংবাদিক কোটা-সংক্রান্ত বিষয়ে আমার কী ভাবনা জানতে চাইলেন। আমি মোটেও এ বিষয়ের বিশেষজ্ঞ নই। তার পরও আমার ভাবনাটুকু বললাম, আমার ধারণা ছাত্র-ছাত্রীদের কোটা সংস্কারের দাবিটি যৌক্তিক একটা দাবি। তার পরই আমার কাছে যে কথাটি আরো অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে, সেটাও তাঁকে জানিয়ে দিলাম। আমি বললাম, যেহেতু এই কোটাগুলোর মাঝে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান-সন্ততির জন্য একটা অংশ আছে, তাই আমাদের খুব সতর্ক থাকতে হবে যেন কোনোভাবেই কোটার সংস্কারের দাবিতে ভুলেও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি বিন্দুমাত্র অসম্মান প্রকাশিত না হয়। মুক্তিযোদ্ধারা তাঁদের ছেলে-মেয়েরা চাকরি পাবে সেই আশায় মুক্তিযুদ্ধ করেননি, আমরা তাঁদের যথাযথ সম্মান দিইনি, তাঁদের সেভাবে সাহায্য করিনি। কাজেই কোনোভাবেই যেন মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি অসম্মান দেখানো না হয়।

পরদিন ক্লাস নিতে গিয়ে আবিষ্কার করলাম ছাত্র-ছাত্রী বিশেষ নেই। এই সেমিস্টারে আমার অনেক কোর্স নিতে হচ্ছে, মাঝখানে পুরো এক মাস ক্লাস নিতে পারিনি, তাই ক্লাস নেওয়ার ভীষণ চাপ। কিন্তু ছাত্র-ছাত্রীরা জানাল, তারা কোটা নিয়ে যে আন্দোলন হচ্ছে সেই আন্দোলনে যোগ দিচ্ছে। তাই এখন ক্লাস করবে না। আন্দোলন মানেই কাজকর্ম বন্ধ করে দেওয়া। কাজেই মেনে নেওয়া ছাড়া গতি কী? আন্দোলন শেষ হওয়ার পর শুক্র ও শনিবার বাড়তি ক্লাস নিয়ে কোর্স শেষ করতে হবে সেভাবে চিন্তাভাবনা করছি। একটা যৌক্তিক দাবি নিয়ে ছেলে-মেয়েরা যদি ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ করে আন্দোলন করতে চায়, কে তাদের বাধা দেবে?

পরদিন খবর পেলাম পুরো ঢাকা শহরকে ছেলে-মেয়েরা অচল করে দিয়েছে। একেকটা বিশ্ববিদ্যালয় তাদের নিজেদের এলাকার রাস্তাঘাট বন্ধ করে ফেলেছে। ঢাকা শহরের অবস্থা আমরা জানি, শহরের এক কোনায় কিছুক্ষণ ট্রাফিক বন্ধ থাকলেই এর মাঝে পুরো শহরে তার প্রভাব পড়ে। কাজেই শহরের বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলে-মেয়েরা সবাই যদি নিজেদের এলাকাকে অচল করে রাখে তার ফল কী ভয়াবহ হবে, সেটা চিন্তা করা যায় না। এই পদ্ধতিটি নতুন নয়, এর আগে একবার প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা একই পদ্ধতিতে তাদের দাবি আদায় করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলে-মেয়েদের সাতখুন মাপ, তারা যখন খুশি পুরো শহর, প্রয়োজন হলে পুরো দেশের মানুষকে জিম্মি করে ফেলতে পারে, তাদের কারো কাছে জবাবদিহি করতে হবে না। তাদের এই কর্মকাণ্ডে যে শিশুটি স্কুলে যেতে পারেনি, যে রোগীটি হাসপাতালে যেতে পারেনি, গার্মেন্টের যে মেয়েটি কাজে যেতে পারেনি, যে রিকশাওয়ালা তার পরিবারের খাবার উপার্জন করতে পারেনি, তাদের কারো জন্য দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের এই ছাত্র-ছাত্রীদের কোনো মায়া নেই। তাদের দাবিটি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বা স্বৈরশাসকের পতনের মতো জাতীয় কোনো দাবি নয়, নিজেদের একটা চাকরি পাওয়ার সুযোগটা বাড়িয়ে দেওয়ার দাবি।

গ্রাম থেকে একটা মেয়ে যদি শহরে এসে গার্মেন্টে একটা চাকরির চেষ্টা করত কিংবা কোনো একজন তার জমি বিক্রি করে মালয়েশিয়ায় চাকরি পাওয়ার চেষ্টা করত, তাহলে তাদের পাশে দেশের বড় বড় অধ্যাপক এসে দাঁড়াতেন না; কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলে-মেয়েদের পাশে তাঁরা এসে দাঁড়িয়েছেন। সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলে-মেয়েরা কিন্তু তাদের পাশে যাঁরা দাঁড়িয়েছেন, তাঁদের সম্মানটুকু রক্ষা করেনি। তারা দেশের মানুষকে জিম্মি করে, যারা তাদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন তাঁদেরও অপরাধী করে দিয়েছে। যদি আমি জানতাম তারা এ রকম করবে, তাহলে তাদের দাবির বিষয়ে মন্তব্য করা থেকে ১০০ হাত দূরে থাকতাম।

বিসিএস পরীক্ষায় কী প্রশ্ন করা হয় কিংবা ভাইভাতে কী জিজ্ঞেস করা হয় আমি জানি না। আমি যদি সেই পরীক্ষা নেওয়ার দায়িত্বে থাকতাম, তাহলে তাদের নিচের প্রশ্নটি করতাম :

তোমার দাবি আদায় করার জন্য তুমি কি সবাইকে নিয়ে রাস্তাঘাট বন্ধ করে পুরো শহরকে জিম্মি করে ফেলার বিষয়টি সমর্থন করো?

যারা এ দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদে চাকরি নেওয়ার স্বপ্ন দেখছে তারা কী উত্তর দিত?

আমার খুব এটি জানার ইচ্ছা।

 

লেখক : অধ্যাপক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
রোববার থেকে সরকারি প্রাথমিকে মর্নিং স্কুল, খোলার প্রজ্ঞাপন জারি - dainik shiksha রোববার থেকে সরকারি প্রাথমিকে মর্নিং স্কুল, খোলার প্রজ্ঞাপন জারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শনিবারের ছুটি বহাল থাকছে - dainik shiksha প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শনিবারের ছুটি বহাল থাকছে ফের আন্দোলনের হুশিয়ারি চুয়েট শিক্ষার্থীদের - dainik shiksha ফের আন্দোলনের হুশিয়ারি চুয়েট শিক্ষার্থীদের গরমে কলেজে কোচিং, দুদিনে অসুস্থ ৮ ছাত্রী - dainik shiksha গরমে কলেজে কোচিং, দুদিনে অসুস্থ ৮ ছাত্রী কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে নিবন্ধিত শিক্ষক নিয়োগে এনটিআরসির নতুন নির্দেশনা - dainik shiksha নিবন্ধিত শিক্ষক নিয়োগে এনটিআরসির নতুন নির্দেশনা দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে জাল সনদে চাকরি করছে কয়েক হাজার হেলথ টেকনোলজিস্ট - dainik shiksha জাল সনদে চাকরি করছে কয়েক হাজার হেলথ টেকনোলজিস্ট ফের আন্দোলনের হুশিয়ারি চুয়েট শিক্ষার্থীদের - dainik shiksha ফের আন্দোলনের হুশিয়ারি চুয়েট শিক্ষার্থীদের আইনি লড়াইয়ে যাচ্ছেন শিক্ষক নেতা কাওছার শেখ - dainik shiksha আইনি লড়াইয়ে যাচ্ছেন শিক্ষক নেতা কাওছার শেখ please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0040950775146484