নিজের আঙিনায়ই দৃষ্টি রাখুক নতুন ডাকসু নেতৃত্ব

টিটু দত্ত গুপ্ত |

বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত আনিশা ফারুক অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি স্টুডেন্ট ইউনিয়নে (অক্সইউএসইউ) প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন এ বছর। নির্বাচনী ইশতেহারে আনিশা বলেছিলেন, এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের স্বার্থ রক্ষায় কাজ করাই ছাত্রসংসদের মূল লক্ষ্য। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে তাঁর সাংগঠনিক দক্ষতা, নেতৃত্বগুণ ও সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাকে তিনি শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধিত্ব করার যোগ্য হিসেবে উল্লেখ করেছেন।

শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধিত্ব করা, তাদের সমস্যা সমাধানে প্রশাসনের সঙ্গে দেন-দরবার করা—উন্নত বিশ্বের বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসংসদ এই ভূমিকাই পালন করে, তা সরকারি হোক আর বেসরকারি হোক। ছাত্রসংসদ নির্বাচনকে রাজনীতির মাঠ হিসেবে ব্যবহার করার প্রকাশ্য চর্চা এশিয়া-আফ্রিকার উন্নয়নশীল দেশগুলোর সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েই বেশি দেখা যায়। এসব দেশের জাতীয় রাজনীতির বিভেদ-সংঘাত সঞ্চারিত হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসংসদ নির্বাচনে, রাজনৈতিক দলগুলোর সমর্থক ছাত্রসংগঠনের হাত ধরে। ভারত, শ্রীলঙ্কায়ও এ রকমই চিত্র।

একটি বিশ্ববিদ্যালয়কে ঘিরে একটি জাতীয়তাবাদের উন্মেষ, ভাষার দাবি থেকে স্বাধীনতাযুদ্ধ পর্যন্ত জাতীয় রাজনীতির সমান্তরালে, কখনো কখনো অগ্রগামীর ভূমিকায় ছাত্রসমাজের আন্দোলন ও চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জনের নজির বিশ্বে বিরল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এই ভূমিকা রেখেছিল, তাই এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ ডাকসু নিয়ে উচ্ছ্বাস অনেক। পঞ্চাশ থেকে ষাটের দশকের মতো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দেশের এখন আর একক প্রতিনিধিত্বশীল উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান নয়, জাতীয় রাজনীতিও এখন আর একক লক্ষ্যাভিমুখী নয়। স্বাধীনতা-পূর্ব সময়ে দেশে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ছিল ছয়টি, এগুলোর মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল উচ্চশিক্ষার প্রধান প্রতিষ্ঠান। এখন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৪১, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ১০১টি। ডাকসুর সংগ্রামী ভূমিকা এখন ইতিহাসের পাদটীকায় রূপ নিয়েছে। শিক্ষার্থী কেন, শিক্ষকদেরই একটা বড় অংশের কাছে ডাকসুর সংগ্রামী রূপ এখন কষ্টকল্পনা। তবু ডাকসুকে দ্বিতীয় সংসদ, ছাত্র আন্দোলনের সূতিকাগার হিসেবে একটা ভাবমূর্তি আরোপের প্রবণতা রয়েছে। যার চাপ পড়তে শুরু করে মনোনয়নের আগে থেকেই।

উনষাট থেকে উনসত্তরের তুমুল ছাত্র গণ-আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে ছাত্ররাজনীতির নেতৃত্বের কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসে ডাকসু, যা উননব্বই থেকে নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের ক্ষেত্রেও কিছুটা দেখা যায়। ওই সময় অবশ্য ছাত্রসংগঠনগুলো স্বকীয় অবস্থানেও সক্রিয় ছিল, তাদের ঐক্যবদ্ধ মঞ্চ ছিল ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ। স্বাধীনতার পর আরো যে তিনটি ডাকসু নির্বাচিত হয়েছিল, সামগ্রিক ছাত্র বা জাতীয় রাজনীতিতে তাদের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নেই।

গত ২৮ বছর নির্বাচন না হওয়ায় এমনিতেই ডাকসুর সংগ্রামী ভূমিকার প্রাসঙ্গিকতা খুব জোরালো নয় শিক্ষার্থীদের কাছে। তবু নির্বাচন অনুষ্ঠানকে স্বাগত জানিয়েছে তারা, উত্সাহেরও কমতি ছিল না। নানা অঘটনের কালিমা থাকলেও তিন দশকের অচলায়তন ভেঙে শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধিত্বের বন্ধ্যত্ব ঘুঁচেছে। নির্বাচনের ত্রুটি-বিচ্যুতি দূর করার উদ্যোগ নিশ্চয়ই নেবে বিশ্ববিদ্যালয়। নিয়মিত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে ভবিষ্যতে এসব অনিয়মের পুনরাবৃত্তি ঘটবে না।

তবে তার আগে ডাকসুর ওপর থেকে জাতীয় রাজনীতির শ্যেনদৃষ্টি সরিয়ে আনা উচিত। ডাকসু রাজনীতির মহড়ার মাঠ...এ ধারণা অমূলক। ডাকসুর সংগ্রামী ঐতিহ্য এখন গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস, তা এখন আবার মঞ্চায়ন করা যাবে না। ডাকসু এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধি, জাতির রাজনীতির দায়িত্ব তার নয়। রাজনৈতিক দলগুলোর অসমাপ্ত কাজের ভার বহন করবে না ডাকসু। সাধারণ শিক্ষার্থীরাও যে তা চায় না, ফলাফল বিশ্লেষণ করলেই তা স্পষ্ট হবে।

ডাকসুর নতুন নেতৃত্বকে প্রথমত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকেই দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখা উচিত। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় ৪৪ হাজার শিক্ষার্থী ভোটারের প্রতিনিধি তাঁরা। এই শিক্ষার্থীদের হলের সমস্যা, যাতায়াতের সমস্যা, ডাইনিং-ক্যান্টিনে খাওয়ার মান নিয়ে অনুযোগ, শিক্ষকদের আচরণ নিয়ে অসন্তোষ, বেকারত্ব, শিক্ষার পড়ন্ত মান—এসব নিয়ে কথা বলবে ডাকসু। শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধি না থাকার কারণে দীর্ঘদিন তাদের দাবি নিয়ে কথা বলার কোনো স্বীকৃত কাঠামো ছিল না। এই ডাকসু শিক্ষার্থীদের হয়ে কথা বলবে, তাদের অনেক হতাশা, অভিযোগ, অনুযোগের প্রতিকারে সক্রিয় থাকবে। জাতীয় দুর্যোগে মানবতার সেবায় এগিয়ে আসবে। সারা দেশের শিক্ষার্থীদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে তারা অগ্রণী ভূমিকা রাখবে। সমাজের অগ্রসর সচেতন তরুণদের প্রতিনিধি হিসেবে তারা ন্যায়ের পক্ষে সোচ্চার হবে।

নটিংহাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রসংসদ শিক্ষাসহায়ক নানা কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের খণ্ডকালীন চাকরি, তাদের গবেষণা প্রকাশ, স্বেচ্ছাসেবামূলক উদ্যোগেও সহায়তা দিয়ে থাকে। গবেষণা লাইব্রেরি, কনসার্টের আয়োজন, তহবিল সংগ্রহের অনুষ্ঠান, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক কার্যক্রম তাদের নৈমিত্তিক ভূমিকার অংশ। তাদের ওয়েবসাইটে ক্যাম্পাস জীবন নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানাতে পারে শিক্ষার্থীরা, প্রতিকারের উদ্যোগ নেয় সংসদ।

কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় ৮০০ বছর পুরনো হলেও সেখানে ছাত্রসংসদ অনুমোদন পায় ১৯৭১ সালে। তাদের ওয়েবসাইটে রয়েছে নানা কর্মকাণ্ডের বিবরণ। বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন হয়রানির শিকারদের সুবিচার নিশ্চিত করতে শৃঙ্খলাবিষয়ক নীতি কী হবে তা নিয়ে মতামত আহ্বান করেছে সংসদের নারীবিষয়ক কর্মকর্তা। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসংসদ সে প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী-কর্মীর অধিকার নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে দেন-দরবার করে। দেশি-বিদেশি শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত থাকে, তাদের মজুরি, সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো, বৈষম্য ও যৌন হয়রানি রোধে তৎপর থাকে ছাত্রসংসদ।

দুর্ব্যবহার, হতাশা, হয়রানির কারণে অনেক শিক্ষার্থীর মধ্যে আত্মহত্যাপ্রবণতা তৈরি হয়। অনেকে প্রকাশ করতে পারে না। শিক্ষার্থীদের আবাসন সুবিধা, পরিবহন সুবিধা অপ্রতুল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত শিক্ষার্থীদের বেশির ভাগ মেস ভাড়া করে থাকে, থাকা-খাওয়ায় তাদের অনেক খরচ হয়। গণপরিবহনে ‘হাফ ভাড়া’ নিয়ে সুস্পষ্ট নীতিমালা না থাকায় প্রতিনিয়ত গ্লানিকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয় তাদের। পড়ার পাশাপাশি খণ্ডকালীন কাজের সুযোগ খোঁজে অনেক শিক্ষার্থী। এদের পাশে দাঁড়াতে পারে ডাকসু। জাতীয় বিষয়ে ডাকসু নিশ্চয়ই মুখ বুজে থাকবে না, তবে তাদের প্রথম লক্ষ্য হওয়া উচিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কল্যাণ, তারপর সার্বিকভাবে দেশের শিক্ষার্থীদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়।

নেতৃত্ব বলতে শুধু রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব নয়। উন্নত দেশে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রসংসদ কর্মজীবনের সব ক্ষেত্রেই নেতৃত্ব বিকাশকে গুরুত্ব দেয়। তবে তাদের অগ্রাধিকার শিক্ষার্থীদের স্বার্থ রক্ষায় সোচ্চার হওয়া। ডাকসুর গঠনতন্ত্রেও রয়েছে, শিক্ষার্থীদের সাংস্কৃৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক সহযোগিতা, একাডেমিক ও সহশিক্ষামূলক অর্জন, সুনাগরিকরূপে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের প্রস্তুত করা এবং তাদের মধ্যে নেতৃত্বের গুণাবলি সৃষ্টি করার জন্য কাজ করবে।

ভিসি কেন ডাকসুর প্রধান?

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ছাত্রসংসদের প্রধান হন প্রেসিডেন্ট। ডাকসুর ক্ষেত্রে ভাইস প্রেসিডেন্ট। সম্ভবত ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ ছাত্র প্রতিনিধিদের তাদের কবজায় রাখার জন্য ভাইস চ্যান্সেলরকে ডাকসুর প্রেসিডেন্ট রাখার রেওয়াজ করেছিল। এ ধারা পাকিস্তানি শাসকরাও বজায় রেখেছিল। আর স্বাধীনতার পরও তার পরিবর্তন হয়নি। ডাকসুর গঠনতন্ত্রে বলা আছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদাধিকারবলে সংসদের সভাপতি হবেন। হল সংসদেরও প্রধান থাকবেন প্রভোস্টরা। শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠনে উপাচার্য বা প্রভোস্ট কেন প্রধান থাকবেন তার ব্যাখ্যা নেই। ফলে গঠনতান্ত্রিকভাবেই ডাকসু বা হল সংসদ শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধিত্বকারী স্বাধীন সংগঠন নয়, এগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণাধীন প্রতিষ্ঠান। ঔপনিবেশিক আমল থেকে চলে আসা এ নিয়ম শিক্ষার্থীদের গণতান্ত্রিকচর্চার অন্তরায় কি না ভেবে দেখতে পারে ডাকসুর নতুন নেতৃত্ব।

লেখক : সাংবাদিক

সৌজন্যে: কালের কণ্ঠ


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
১৮তম প্রিলির ফল প্রকাশ, উত্তীর্ণ ৪ লাখ ৭৯ হাজার ৯৮১ - dainik shiksha ১৮তম প্রিলির ফল প্রকাশ, উত্তীর্ণ ৪ লাখ ৭৯ হাজার ৯৮১ প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগের চূড়ান্ত ফল প্রকাশ, উত্তীর্ণ ৫ হাজার ৪৫৬ - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগের চূড়ান্ত ফল প্রকাশ, উত্তীর্ণ ৫ হাজার ৪৫৬ সাড়ে ৪ মাসে ১৮৮ শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা, বিশেষজ্ঞরা যেসব বিষয়কে দায়ী করছেন - dainik shiksha সাড়ে ৪ মাসে ১৮৮ শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা, বিশেষজ্ঞরা যেসব বিষয়কে দায়ী করছেন শতভাগ ফেল স্কুল-মাদরাসার বিরুদ্ধে ব্যবস্থার উদ্যোগ - dainik shiksha শতভাগ ফেল স্কুল-মাদরাসার বিরুদ্ধে ব্যবস্থার উদ্যোগ দুর্নীতির অভিযোগে বরখাস্ত শিক্ষা কর্মকর্তা - dainik shiksha দুর্নীতির অভিযোগে বরখাস্ত শিক্ষা কর্মকর্তা কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে শ্রীপুরে গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রীর ভাইয়ের প্রার্থিতা বাতিল - dainik shiksha শ্রীপুরে গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রীর ভাইয়ের প্রার্থিতা বাতিল এসএসসির খাতা চ্যালেঞ্জের আবেদন যেভাবে - dainik shiksha এসএসসির খাতা চ্যালেঞ্জের আবেদন যেভাবে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে বিএনপি-জামায়াত মানুষের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা বন্ধ করে দেয় : প্রধানমন্ত্রী - dainik shiksha বিএনপি-জামায়াত মানুষের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা বন্ধ করে দেয় : প্রধানমন্ত্রী please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0050649642944336