নিন্নমানের কাগজে ছাপানোয় বাতিল সাড়ে ৬ লাখের বেশি পাঠ্যবই

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

প্রাক্কলিত দরের যে অস্বাভাবিক কম দামে কাজ নেওয়ায় দরপত্রের সময়ই আশঙ্কা করা হয়েছিল, এবার নিম্নমানের কাগজে বই ছাপতে পারেন মুদ্রণকারীদের অনেকে। এখন বছরের শেষ সময়ে এসে সেটিই করছেন কেউ কেউ। নিম্নমানের কাগজে বই ছাপানোয় ইতিমধ্যে বাতিল করা হয়েছে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের সাড়ে ৬ লাখের বেশি বই। বাতিল করা হয়েছে প্রায় ৪০টি প্রতিষ্ঠানের প্রায় ৩ হাজার মেট্রিক টন কাগজও। বৃহস্পতিবার (১৭ ডিসেম্বর) প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়।  প্রতিবেদনটি লিখেছেন মোশতাক আহমেদ।

প্রতিবেদনে আরও জানা যায়, এ ছাড়া নিম্নমানের কাগজে বই ছাপানোর অনুমতির জন্য মান যাচাইয়ে নিযুক্ত প্রতিষ্ঠানকে ‘পীড়াপীড়ি’ করায় একটি মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডে (এনসিটিবি) লিখিত অভিযোগ দেওয়া হয়েছে।

মন্ত্রণালয়, এনসিটিবি, মান যাচাইকারী প্রতিষ্ঠান ও মুদ্রণকারীদের সঙ্গে কথা বলে পাওয়া গেছে এসব তথ্য। অবশ্য এনসিটিবির চেয়ারম্যান নারায়ণ চন্দ্র সাহার কথা, অনিয়ম করে কেউ ছাড় পাবে না। যা যা ব্যবস্থা নেওয়ার, তাই নেওয়া হবে। এবার কম দামে ছাপার কাজ দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তার উত্তর, দরপত্র জমার সময় কাগজের দাম কম ছিল। এ ছাড়া করোনার কারণে প্রতিযোগিতা থাকায় মুদ্রণকারীরা কম দামে কাজ নিয়েছেন। তবে তাঁরা মানের বিষয়ে ছাড় দেবেন না।

নতুন শিক্ষাবর্ষে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের ৪ কোটি ১৬ লাখ ৫৫ হাজার ২২৬ জন শিক্ষার্থীর জন্য মোট ৩৪ কোটি ৩৬ লাখ ৬২ হাজার ৩৯৪টি বই ছাপছে এনসিটিবি। এর মধ্যে মাধ্যমিকের বই প্রায় ২৪ কোটি ১১ লাখ। এবার প্রাক্কলিত দরের চেয়ে ৩৭ থেকে ৪৫ শতাংশ পর্যন্ত কম দর দিয়ে কাজ নিয়েছিলেন মুদ্রাকরেরা।

এনসিটিবি, মান যাচাইকারী প্রতিষ্ঠান এবং মুদ্রণকারীদের সূত্রগুলো বলছে, শেষ সময়ে সরকারের লক্ষ্য থাকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মুদ্রণকারীদের কাছ থেকে বই আদায় করা। এমন অবস্থায় নিন্নমানের কাগজে বই দেওয়ার অপতৎপরতা চালাচ্ছেন এক শ্রেণির মুদ্রণকারী। 

এনসিটিবির  সূত্রমতে, বগুড়ার  ‘মা সিষ্টেম কম্পিউটার প্রিন্টার্স অ্যান্ড প্যাকেজিং’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান এবার ৩০ লাখ ২২ হাজার ১৭৪টি বই ছাপার কাজ পেয়েছে। কিন্তু মাধ্যমিক স্তরের বই ছাপার মান যাচাইয়ে সরকার নিযুক্ত প্রতিষ্ঠান গিয়ে দেখতে পায়, ৩ লাখ ৩৫ হাজার ২০৪টি বইয়ে বেশ কিছুসংখ্যক পৃষ্ঠায় নির্ধারিত মানের কাগজের চেয়ে নিম্নমানের কাগজ দিয়ে ছাপা হয়েছে। শর্ত অনুযায়ী, ৬০ জিএসএমের (প্রতি বর্গমিটার কাগজের ওজন ৬০ গ্রাম) কাগজ দিয়ে ছাপার কথা থাকলেও এসব বইয়ের অনৈকগুলোতে ৫৫ থেকে ৫৬ জিএসএমের কাগজে ছাপার প্রমাণ পাওয়া গেছে। এ ছাড়া গত মঙ্গলবার আরেকটি প্রতিষ্ঠানের ২ লাখ ৬৩ হাজার বই বাতিল করা হয়েছে।

প্রাথমিক স্তরের পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণ ও বিতরণ বিষয়ে গত ২৪ নভেম্বর অনুষ্ঠিত প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক সভার কার্যবিবরণী থেকে জানা যায়, সভায় প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেন জানান, সরবরাহ করা বইয়ের মধ্যে কিছুসংখ্যক বই মানসম্মত নয় বলে মাঠ পর্যায় থেকে জানা গেছে। যেমন কোনো বইয়ের কাগজের মান ভালো নয়, আবার কোনো কোনো বইয়ের মুদ্রণ সঠিকভাবে হয়নি। ওই সভায় প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আলমগীর মুহম্মদ মনসুরুল আলম জানান, ইতিমধ্যে ৬০ হাজার বই বাতিল করা হয়েছে।

এনসিটিবির সূত্র জানায়, নোয়াখালীর চৌমুহনীর অগ্রণী প্রিন্টিং প্রেস এবার কেবল মাধ্যমিক স্তরেই প্রায় ৭৮ লাখ বই ছাপার কাজ পেয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি মাধ্যমিকে নিম্নমানের কাগজ ইসপেকশনের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে গত ২৮ নভেম্বর ১২০ মেট্রিক টন কাগজ বাতিল করেছে

এনসিটিবিকে দেওয়া লিখিত অভিযোগে ইনডিপেনডেন্ট ইসপেকশন বলছে, ‘অগ্রণী প্রিন্টিং প্রেসের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের প্রতিনিধি (পরিদর্শক) ২ ডিসেম্বর দৈবচয়নের ভিত্তিতে কাগজের নমুনা সংগ্রহ করে। কিন্তু ওই প্রেস আমাদের সংগ্রহ করা কাগজের নমুনা পরিবর্তন করে তাদের পছন্দমতো কাগজের নমুনা নিতে পীড়াপীড়ি করে। এ অবস্থায় কাগজের মান যাচাই কার্যক্রম সম্পন্ন করতে ব্যর্থ হই।"

এনসিটিবি ও মান যাচাইকারী প্রতিষ্ঠানের সূত্রমতে, অগ্রণী প্রিন্টিং প্রেস মাধ্যমিকে বিরাটসংখ্যক বই ছাপার কাজ পেলেও ৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত মাধ্যমিকের কোনো বই উপজেলায় পাঠানোর ছাড়পত্র পায়নি।

এ বিষয়ে মন্তব্য করতে চায়নি ইনডিপেনডেন্ট ইসপেকশন কর্তৃপক্ষ। প্রতিষ্ঠানটির দায়িত্বশীল একজন ব্যক্তি বলেন, তাঁরা সবকিছু এনসিটিবিকে জানিয়েছেন। অবশ্য অগ্রণী প্রিন্টিং প্রেসের অন্যতম স্বত্বাধিকারী মো. হাসান-উজ-জ্জামান যেভাবে নমুনা নিতে চেয়েছে, তাতে কাগজ রাখতে হলে বিরাট জায়গার দরকার। এ নিয়ে তাদের সঙ্গে মনোমালিন্য হয়েছিল।

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সুত্রমতে, দরপত্র অনুযায়ী না হওয়ায় রাজধানীর মাতুয়াইলের অনুপম প্রিন্টার্সের ৩০ টন হোয়াইট প্রিন্টিং পেপার বাতিল করা হয়েছে।

এনসিটিবি ও মান যাচাইকারী প্রতিষ্ঠানের সূত্রমতে, সব মিলিয়ে এখন পর্যন্ত প্রায় ৩ হাজার মেট্রিক টন কাগজ বাতিল করা হয়েছে, যেগুলোর মান খারাপ। এসব বাতিল হওয়া কাগজ কেউ কেউ কৌশলে ছাপার কাজে ব্যবহার করতে পারে বলে আশঙ্কা ।

এর আগে ২০১৬ সালে বই ছাপার সময়েও সংকট হয়েছিল। তখন প্রাথমিকের পাঠ্যবই ছাপতে বিদেশি প্রকাশনা সংস্থার অংশগ্রহণ ঠেকাতে জোট বেঁধেছিলেন দেশের ২২ মুদ্রাকর ও প্রকাশক। তখন তারা ৩২ থেকে ৪১ শতাংশ কম দরে দরপত্র জমা দিয়ে বই ছাপার কাজ পান। পরে বছরের শুরুতে শিক্ষার্থীদের হাতে বই দেওয়ার পর দেখা যায় মান খারাপ।

এসব বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে এনসিটিবির সাবেক চেয়ারম্যান মো. শফিকুর রহমান বলেন, ব্যবসায়ীদের বেশির ভাগই অল্পতেই বেশি লাভ করতে চান। এই মুহুর্তে এনসিটিবিরও একসঙ্গে সব কাগজ কিনে দেওয়ার সামর্থ্য নেই। মান যাচাইয়ের কাজটিও খুব উন্নয়ন হয়নি। ফলে সমস্যাটি যাচ্ছে না। এনসিটিবির সামর্থ্য বাড়িয়ে এই সমস্যার অনেকটা সমাধান করা সম্ভব।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশ ১২ মে - dainik shiksha এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশ ১২ মে খাড়িয়া ভাষা সংরক্ষণে উদ্যোগ গ্রহণের আহবান প্রধান বিচারপতির - dainik shiksha খাড়িয়া ভাষা সংরক্ষণে উদ্যোগ গ্রহণের আহবান প্রধান বিচারপতির উপবৃত্তির সব অ্যাকাউন্ট নগদ-এ রূপান্তরের সময় বৃদ্ধি - dainik shiksha উপবৃত্তির সব অ্যাকাউন্ট নগদ-এ রূপান্তরের সময় বৃদ্ধি শিক্ষক হতে চান না শিক্ষক দম্পতিদের কৃতী সন্তানরা - dainik shiksha শিক্ষক হতে চান না শিক্ষক দম্পতিদের কৃতী সন্তানরা কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে শিক্ষার্থী বিক্ষোভের মধ্যে ইহুদিবিদ্বেষ নিয়ে বিল পাস - dainik shiksha শিক্ষার্থী বিক্ষোভের মধ্যে ইহুদিবিদ্বেষ নিয়ে বিল পাস দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0044510364532471