পাঠাগারের পৃষ্ঠপোষকতায় পিছিয়ে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র

কাজী আলিম-উজ-জামান |

সরকারি প্রতিষ্ঠান জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের অন্যতম কাজ বেসরকারি পাঠাগারগুলোর পৃষ্ঠপোষকতা করা। তবে রাজধানী ঢাকার পাঠাগারগুলোর ভাষ্য, সরকারি প্রতিষ্ঠানটির কাছ থেকে ঠিকমতো সহায়তা মিলছে না। প্রথমত অনুদানের পরিমাণ যথেষ্ট নয়। যতটুকু বা বরাদ্দ, সেটুকুও পেতে গিয়ে ‘খাজনার চেয়ে বাজনা’ বেশি।

গত বছরের জুন থেকে গত আট মাসে ঢাকার অন্তত ৩৫টি পাঠাগার ঘুরে দেখা গেছে, বেশির ভাগই নাজুক অবস্থায়। গুটিকয়েক পাঠাগার কিছুটা মজবুত অবস্থানে আছে।

তবে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র বলছে, সরকারি অনুদান প্রদানের যে নীতি, তা মেনেই তাদের পক্ষে যত দূর সম্ভব পাঠাগার উন্নয়নে কাজ করা হচ্ছে।

জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীন একটি দপ্তর। ১৯৬২ সালে প্রতিষ্ঠিত। নাম ছিল ‘ন্যাশনাল বুক সেন্টার ফর পাকিস্তান’। এর একটি শাখা অফিস ঢাকায়ও ছিল। স্বাধীনতার পরে এই প্রতিষ্ঠানটি ‘জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র বাংলাদেশ’ নামে পরিচিত হয়। গুলিস্তানে নিজস্ব ভবনে কার্যক্রম চলছে ১৯৭৮ সাল থেকে।

গ্রন্থকেন্দ্রের কাজের মধ্যে রয়েছে, ‘বেসরকারি গ্রন্থাগারসমূহের মধ্যে আর্থিক অনুদান ও বই প্রদান করা। বেসরকারি গ্রন্থাগারের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে সংশ্লিষ্ট গ্রন্থাগারের কর্মকর্তা-কর্মচারীকে প্রশিক্ষণ প্রদান করা।’

২০১৪ সালে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র প্রকাশিত ‘বেসরকারি গ্রন্থাগার নির্দেশিকা’য় দেওয়া তথ্যমতে, ঢাকায় বেসরকারি পাঠাগারের সংখ্যা ৩৯টি।

গ্রন্থকেন্দ্র সূত্র জানায়, নিবন্ধিত বেসরকারি পাঠাগারগুলোকে বছরে ২০ হাজার টাকা থেকে এক লাখ টাকা পর্যন্ত অনুদান দিয়ে থাকে গ্রন্থকেন্দ্র। এর মধ্যে অর্ধেক টাকার বই, বাকি অর্ধেক টাকা নগদ দেওয়া হয়।

পাঠাগারগুলো আবেদন করলে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের বাছাই সভায় অনুদানের বিষয়টি চূড়ান্ত হয়। এ ক্ষেত্রে নির্বাচিত পাঠাগারগুলোতে ক খ গ তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়। এই শ্রেণি অনুযায়ী অনুদান দেওয়া হয়।

গ্রন্থকেন্দ্র সূত্র জানায়, গত অর্থবছর (২০১৫-১৬) অনুদান পেয়েছে ঢাকার ১২টি পাঠাগার। এর মধ্যে সিটি করপোরেশনের ভেতর পড়েছে আটটি। গত অর্থবছরে সারা দেশে ৮২৪টি পাঠাগারে অনুদান দিয়েছে গ্রন্থকেন্দ্র। অনুদানের মধ্যে নগদ দেওয়া হয়েছে ১ কোটি ১২ লাখ টাকা। আর প্রায় ১ কোটি ২৩ লাখ টাকার ৫১ হাজার ৭৫০টি বই অনুদান হিসেবে দেওয়া হয়।

চলতি অর্থবছরে (২০১৬-১৭) ৭০০ পাঠাগারকে অনুদান দেওয়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে গ্রন্থকেন্দ্র।

পাঠাগার-সংগঠকদের যত অভিযোগ

৬৪ বছরের পুরোনো পাঠাগার লালবাগের গ্রন্থবিতানের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ জহিরউদ্দিন বললেন, অনুদানের চেক তুলতে হয় জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে। সেখানে এতই দুর্ভোগ পোহাতে হয় যে, বিরক্ত হয়ে অনেকে আবেদনই করেন না।

গ্রন্থবিতান চলে সদস্যদের চাঁদা ও ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্যদের অনুদানে।

দনিয়া পাঠাগারের সভাপতি মো. শাহনেওয়াজ বললেন, অনেক সময় চেক হাতে পেতে পেতে চেকের মেয়াদ ফুরিয়ে যায়। তখন মেয়াদ বাড়াতে আবার দৌড়াদৌড়ি করতে হয়।

বেসরকারি পাঠাগারগুলোর সমস্যা সমাধানের উপায় নিয়ে কয়েক বছর ধরে কাজ করে আসছে বাংলাদেশ গ্রন্থসুহৃদ সমিতি। গত বছরের ২৫ মার্চ ঢাকার বাড্ডা থানার বেরাইদে তাদের উদ্যোগে আয়োজন করা হয় প্রথম জাতীয় গ্রন্থসুহৃদ সম্মেলন। এই সমিতি ও বেরাইদ গণপাঠাগারের সভাপতি এমদাদ হোসেন ভূঁইয়া ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, হয়রানি বন্ধে অনুদানের বিষয়টি ‘ওয়ান স্টপ সার্ভিস সেন্টারের’ আওতায় আনা উচিত। গ্রন্থাগার পরিদর্শন, আবেদনপত্র যাচাই-বাছাই, অনুদান মঞ্জুর ও চেক প্রদান এই চারটি কাজ জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র করতে পারে।

এমদাদ হোসেনের দাবি, বেসরকারি পাঠাগারগুলোকে পর্যায়ক্রমে এমপিওভুক্ত করা উচিত। অন্তত গ্রন্থাগারিকের বেতনটা সরকারের তরফ থেকে দেওয়া হোক।

গ্রন্থকেন্দ্র থেকে অনুদান হিসেবে যে বইগুলো দেওয়া হয়, তা নিয়েও কোনো কোনো পাঠাগারের আপত্তি রয়েছে। তাঁরা বলছেন, কিছু বই পাঠকেরা ধরতেই চায় না। এ জন্য নামি ও জনপ্রিয় লেখকদের বই পাঠাগারে দেওয়া উচিত।

একটি গ্রন্থাগারের সভাপতি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বই নির্বাচনের ক্ষেত্রে প্রায়ই রাজনৈতিক বিবেচনা প্রাধান্য পায়। আগেও এ ধারা ছিল। এখনো তা বজায় রয়েছে।

পাঠাগারগুলোর চিত্র

গত বছরের জুন থেকে এই প্রতিবেদক ঢাকার অন্তত ৩৫টি পাঠাগারে পরিদর্শন করেন। এ সময় বেশির ভাগ পাঠাগারই সংকটাপন্ন দেখা যায়। এর মধ্যে একটি আজিমপুর এস্টেট জনকল্যাণ সমিতি পাঠাগার। এই পাঠাগারের ৩ হাজার ৩৬৭টি বইয়ের বেশির ভাগই নাজুক অবস্থায় রয়েছে। কাঠের আলমারির ভেতর বইগুলো রাখা আছে বটে, কিন্তু তা যেন উইপোকার বসতবাড়ি! ছিঁড়ে গেছে, ফেটে গেছে বই। জানা গেল, এই পাঠাগারটি একসময় অনুদান পেত। কিন্তু কয়েক বছর ধরে পায় না।

জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের পরিচালক মো. আখতারুজ্জামান  বলেন, ‘আমাদের একটাই অফিস। এ দিয়েই ঢাকাসহ সারা দেশের প্রায় এক হাজার পাঠাগারকে পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছি।’ তিনি বলেন, তৃণমূল পর্যায়ের ৬৫ জন গ্রন্থাগারিককে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।

চেক পেতে দেরি হওয়ার বিষয়ে আখতারুজ্জামান বলেন, ‘সরকারি অর্থ দেওয়ার কিছু নিয়ম আছে। সেই প্রক্রিয়া আমাদের অনুসরণ করতে হয়। আমরা সরাসরি কোনো পাঠাগারকে চেক দিই না। এটা স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে দেওয়া হয়। তারা চেক দেওয়ার আগে সরেজমিনে খোঁজখবর করে। অনেক সময় পাঠাগারের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া না গেলে চেক ফেরতও আসে।’

জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের পরিচালনা বোর্ডের সদস্য ছিলেন প্রকাশক ওসমান গনি। তিনি বলেন, মূল সমস্যা হচ্ছে বাজেটের অভাব। সারা দেশের বেসরকারি পাঠাগার ও সরকারি গ্রন্থাগারের উন্নয়নে বাজেট বরাদ্দ ১০ গুণ বাড়ানো দরকার।

সৌজন্যে: প্রথম আলো।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
কাল খুলছে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শনিবারও চালু ক্লাস - dainik shiksha কাল খুলছে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শনিবারও চালু ক্লাস সরকারি কলেজ মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও খাদিমের চাকরি জাতীয়করণ দাবি - dainik shiksha সরকারি কলেজ মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও খাদিমের চাকরি জাতীয়করণ দাবি উপবৃত্তির সব অ্যাকাউন্ট নগদ-এ রূপান্তরের সময় বৃদ্ধি - dainik shiksha উপবৃত্তির সব অ্যাকাউন্ট নগদ-এ রূপান্তরের সময় বৃদ্ধি শিক্ষকের বেতন ও শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া রোধে কাজ চলছে: শিক্ষামন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষকের বেতন ও শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া রোধে কাজ চলছে: শিক্ষামন্ত্রী বিএসসি মর্যাদার দাবিতে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের মাসব্যাপী কর্মসূচি - dainik shiksha বিএসসি মর্যাদার দাবিতে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের মাসব্যাপী কর্মসূচি কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে ১৩ বছরের কম বয়সী শিশুদের হাতে স্মার্টফোন নয় - dainik shiksha ১৩ বছরের কম বয়সী শিশুদের হাতে স্মার্টফোন নয় একই স্কুলের দুই ছাত্রীকে বিয়ের পর আরেক ছাত্রীকে ল্যাব সহকারীর অনৈতিক প্রস্তাব - dainik shiksha একই স্কুলের দুই ছাত্রীকে বিয়ের পর আরেক ছাত্রীকে ল্যাব সহকারীর অনৈতিক প্রস্তাব দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশ ১২ মে - dainik shiksha এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশ ১২ মে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0049088001251221