মাননীয় প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান প্রথম সারিতে। তার ঠিক পেছনে দ্বিতীয় সারিতে সাবেক শিক্ষা সচিব মো. নজরুল ইসলাম খান। তার পাশে আমি। ১৭ এপ্রিল রাত প্রায় দশটা। ওইদিনই সন্ধ্যা ছয়টায় দিকে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন বড়ভাইতুল্য মনোয়ারুল হক। তাঁর জানাযায় দাঁড়িয়ে আমরা। জানাযা শুরুর আগে মনোয়ার ভাইকে নিয়ে শোকাহত মনে স্মৃতিচারণ চলছে। চিরতরে চলে যাওয়ার আগের দুপুরেই মনোয়ার ভাইয়ের খুব মন খারাপ হয়েছিলো, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের সংবিধান তৈরি ও অন্যান্য কিছু বিষয় নিয়ে কয়েকজন অধ্যাপকের কর্মকাণ্ডে।
আরো পড়ুন: কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে
গেলো রমজানে দেশে দেশে স্কুল ছুটি নিয়ে এবং প্রথম থেকে দ্বাদশ বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের নিয়ে দৈনিক আমাদের বার্তার দুটো সম্পাদকীয় উচ্চ আদালতের দৃষ্টি কেড়েছিলো। সেসব কথা মনোয়ার ভাই আমাকে অনুপুঙ্খ বর্ণনা করেছিলেন। শিক্ষার উন্নতি নিয়ে মনোয়ার ভাই নানা চিন্তা শেয়ার করতেন। শিক্ষা নিয়ে আমাদের বার্তা ও দৈনিক শিক্ষায় তার প্রচুর লেখা প্রকাশ করেছি। ঈদের আগে সর্বশেষ যেদিন মনোয়ার ভাইয়ের রাজধানীর রমনা সেঞ্চুরি টাওয়ারের বাসায় দেখা, সেদিন রাবি অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের জন্য ক্যাম্পাসে নতুন বরাদ্দ পাওয়া জমির ওপরে ভবন নির্মাণসহ নানা বিষয়ে আলোচনার ফাঁকে আমাকে বলছিলেন, ‘দেখিস রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার ব্যবসা চিরতরে বন্ধ করে দেবো। তুই আমাদের সঙ্গে থাকবি।’ আমি বললাম, অবশ্যই ভাই। তারপর বললেন, ভারতের এলাহাবাদ হাইকোর্টের মুসলিমদের মাদরাসা শিক্ষা নিয়ে দেয়া এক রায়ে তোলপাড় হওয়ার কথা ও সেই বিষয়ে তার একটা লেখা। [লেখাটা ছাপা হয়নি এখনও]।
আমি মাঝে মাঝে একান্তে মনোয়ার ভাইকে বলতাম, ‘ভাই আপনার বিশ্ববিদ্যালয়ের অগ্রজ, বন্ধু ও অনুজ বিচারপতি এবং আইনজীবীদের একটু বলতে পারেন না প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়ায় উন্নতদেশের আদলে গাইডলাইন ও বেতনকাঠামো ঠিক করে রায় দিতে।’ আমার এমন আবদারের পর অনেক ব্যাখ্যাসহ মনোয়ার ভাই বলতেন, ‘সেটা তো নির্বাহী বিভাগের আর্থিক সঙ্গতি, কিছু সংসদ সদস্যের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক ব্যবসা ও এক শ্রেণির আমলার কর্ত্বৃত্ব পরায়ণ মানসকিতা---সব মিলিয়ে একটা জটিল অবস্থা। তারপরও যদি বিচারপতিরা মনে করেন, তাহলে হয়তো তেমন রায় কোনো একদিন দিতেও পারেন। আমার পরামর্শ কেন বিচারপতিরা শুনবেন? অপেক্ষা করো হয়তো পাঁচ দশ বছর পরেও তোমার আশা পূরণ হতে পারে।
সেঞ্চুরি টাওয়ারের সামনে রাতের ও প্রথম জানাযা শেষে এন আই খান জানতে চাইলেন শিক্ষক নিবন্ধন কর্তৃপক্ষ ও বর্তমান নিয়োগ প্রসঙ্গে। কথার শুরুতেই পাশে তাকিয়ে দেখি আরেকজন বিচারপতি। মনোয়ার ভাইয়ের সঙ্গে তারও খুবই ভালো সম্পর্ক। কয়েকদিন আগেই শিক্ষা বিষয়ক একটা আলোচিত রায় দিয়েছেন। তাকে সালাম দিয়ে একটু পাশে সরে গিয়ে এন আই খানের সঙ্গে আলাপ শুরু করি। খান সাহেব জানতে চান, তিনি যখন শিক্ষাসচিব ছিলেন এবং বেসরকারি শিক্ষক নিয়োগে নতুন পদ্ধতি চালু করেছিলেন তার কি অবস্থা। সংক্ষেপে বর্ণনা শুনে খুব আফসোস করলেন। মনে করিয়ে দিলাম ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দের নভেম্বরের পর অনেকটা স্থবির করে রাখা হয়েছিলো এনটিআরসিএকে।
তাঁকে সংক্ষেপে বললাম। দুচারজন সৎ ও দক্ষ ব্যাতিক্রম ছাড়া শুরু থেকে নিবন্ধন কর্তৃপক্ষের বড় পদগুলোতে পেডাগজি, অ্যান্ড্রাগজি ও মন্টেসেরি সম্পর্কিত শূন্য ধারণার ক্যাডার কর্মকর্তাদের পদায়নের আধিক্য দেখা গেছে। প্রথম থেকে ১২তম নিবন্ধন পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের শুধু প্রাকযোগ্যতা নির্ধারণী সনদ দেয়া হয়েছিলো। ওই সনদ মানেই শিক্ষক পদে চাকরি নয়। আর ১৩তম থেকে বর্তমান পর্যন্ত সব পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের শিক্ষক পদে নিয়োগের জন্য মনোনয়ন প্রাপ্য। কারণ, এন্ট্রি লেভেলে শিক্ষক নিয়োগের প্রার্থী বাছাইয়ের পুরো দায়িত্বই এনটিআরসিএর। কিন্তু কয়েকবছর ধরে এনটিআরসিএর কিছু ভুল পদক্ষেপের পাশাপাশি প্রথম থেকে বারোতম পরীক্ষায় উত্তীর্ণরা রিট ব্যবসায়ীদের খপ্পরে খাবি খাচ্ছেন।
কয়েক বছর আগের এক রায়ে সম্মিলিত মেধা তালিকা তৈরির নির্দেশনা পালন ও মানবিক কারণে অনেককে নিয়োগের রায় দেয়া হয়েছিলো। এনটিআরসিএ এখন একটা চিরস্থায়ী জটিলতায় পড়েছে। পদ শূন্য থাকলেও নিয়োগের সুপারিশ করতে পারছে না। শিক্ষক নিয়োগে ডজন ডজন না, হাজার হাজার রিট। মেধায় নয়, রিট করে শিক্ষক পদে নিয়োগ চান প্রাক-যোগ্যতা নির্ধারণী পরীক্ষার সনদধারীরা। যেটাকে আমি জনপ্রিয় লেখক ও শিক্ষাবিদ ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল স্যারকে সহজে উদাহরণ হিসেবে বোঝাতে সদরঘাটের টার্মিনাল টিকিটের প্রসঙ্গ টেনেছিলাম। আমার ওই লেখার শিরোনাম ছিলো, ‘প্রসঙ্গ শিক্ষক নিবন্ধন : টার্মিনাল আর লঞ্চের টিকিট এক নয়।’
এন আই খানকে বললাম। ভাবছি একটা লেখা লিখবো। শিরোনাম দেবো মনোয়ার ভাইয়ের জানাযা শেষে শিক্ষা ভাবনা।
গত বছরের নভেম্বর মাসের কথা। ‘যোগ্য শিক্ষকেই সুযোগ্য বিচারক’ শিরোনামে আমি একটা সম্পাদকীয় লিখেছিলাম। সেখানে বেসরকারি শিক্ষক নিয়োগ : মামলায় না মেধায়-এমন শিরোনামেও একটা লেখার তথ্য-উপাত্ত খুঁজছিলাম। এমন সময় একজন নারী কিছু কাগজ নিয়ে আমাদের বার্তার অফিসে এলেন। একজন সহকর্মী জানালেন, একজন আইনজীবী এসেছেন। আর একই সময়ে আরেক সহকর্মী জানালেন, একজন হবু শিক্ষক আমার সঙ্গে কথা বলতে এসেছেন। দেখলাম ব্যক্তি একই। তিনি আমার কাছে এসেছেন উচ্চ আদালতের একটা রায় নিয়ে। ইংরেজিতে লেখা রায়টি রিটকারী শিক্ষকদের পক্ষে না বিপক্ষে, নাকি কোনোটিই না এটাই তিনি জানতে চান। ওই নারী হবু শিক্ষক জানালেন, তাদের আইনজীবী তাদেরকে বলেছেন, রায়টি তাদের [শিক্ষকদের] পক্ষে। অর্থাৎ এখন এনটিআরসিএ তাদেরকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিতে বাধ্য। আর এনটিআরসিএ বলেছে, রায়টি পক্ষে নয়। সুতরাং তারা নিয়োগ পাবেন না। এ নিয়ে ক্ষোভ ঝাড়লেন তিনি। বললাম, তাহলে রায় নিয়ে আপনি একটা ভিডিয়ো বা অডিও ইন্টারভিউ দেন আমাদেরকে। আমরা সেটা প্রচার করে দেই। কিন্তু তিনি তা করতে চাননি। কারণ, হিসেবে অস্ফুটে জানালেন, ‘সামনে আমার বার কাউন্সিলে তালিকাভুক্তির বিষয় আছে, আমার মতামত যদি বিচারপতি বা আমার আইনজীবীর বিপক্ষে যায় তাহলে ক্ষতি হবে।’ পঁয়ত্রিশোর্ধ সেই নারীর কাছে জানতে চাইলাম, তাহলে রিট করে শিক্ষক পদে নিয়োগ না পেলে আইনজীবী হবেন? তিনি হ্যাঁ সুচক জবাব দিলেন। কোথাও শিক্ষকতা করছেন প্রশ্নে চুপ থেকে বললেন, ‘শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেতে আদালতে দৌড়াচ্ছি, যদি শিক্ষক হতে পারি তাহলে আর আইনজীবীর দিকে যাবো না’।
বাইচান্স নয় বাই চয়েস শিক্ষক নিয়োগের জন্য মনোয়ারুল হক ভাই বেশি বেশি বলতেন ও লিখতেন। খুবই ভালো হতো যদি আমাদের বিচারপতিরা এমন কোনো গাইডলাইন দিতেন, ‘বাইচান্স কেউ শিক্ষক হতে পারবেন না। মনেপ্রাণে এবং ব্রত হিসেবে নিয়ে উন্নত বেতন-ভাতা পেয়ে শিক্ষকরা জাতির মেররুদণ্ড তৈরিতে নিরত থাকবেন।’