প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ, হাতেখড়িতে দুর্নীতি

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

দেশটি জনবহুল কিন্তু সুযোগ সীমিত। কর্মের সুযোগ প্রসারের জন্য প্রয়োজন ব্যাপক কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা; দক্ষ, আধা দক্ষ ও অদক্ষ শ্রমিকদের জন্য সম্মানজনক পেশার দ্বার উন্মুক্ত করা; অন্যদিকে যাঁরা সত্যিকার অর্থে মেধাবী, তাঁদের রাষ্ট্রের কাজে ব্যবহার করা—যার কোনোটাই কিন্তু হচ্ছে না।

প্রাথমিক শিক্ষায় শিক্ষক নিয়োগের ব্যাপারে দুর্নীতির প্রশ্নে আমি একটি লেখা লিখেছিলাম। লেখাটি প্রকাশিত হওয়ার পর, সেই লেখার বিরুদ্ধে প্রাথমিক শিক্ষা মন্ত্রণালয় একটি মৃদু প্রতিবাদও করেছিল। কিন্তু সম্প্রতি প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী কিছু চাকরিপ্রার্থীর কাছ থেকে ঘুষ নেওয়া টাকা ডিবির মাধ্যমে ফেরতও দিয়েছেন। সেই টাকা ফেরত দিয়ে কিছু দালালকে দায়ী করেছেন। বিষয়টি প্রমাণিতই হয়ে গেল যে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে ব্যাপক দুর্নীতি হয়েছে। বৃহস্পতিবার (২১ ডিসেম্বর) আজকের পত্রিকা পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।

নিবন্ধে আরও জানা যায়, আমার প্রশ্নটি অবশ্য ভিন্ন। দুর্নীতির মাধ্যমে চাকরি পাওয়ার পর ওই শিক্ষকদের যে মানসিকতা তৈরি হবে, তাতে তাঁদের জ্ঞানচর্চা, সততা, স্বপ্ন, আকাঙ্ক্ষা, সবই দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে। যে লাখ লাখ টাকা দিয়ে তাঁরা চাকরি নিয়েছেন, সেই জায়গা থেকে তাঁদের সেই টাকাগুলো তুলতেই হবে। তাঁদের সামনে খোলা আছে দুর্নীতিগ্রস্ত কোচিং ব্যবসা এবং প্রতারণা। এই শিক্ষকেরা সেই সব কাজে দ্রুতই দক্ষ হতে থাকেন। তাহলে আগামীতে এই সব শিক্ষকের কাছ থেকে যেসব শিক্ষার্থী শিশুকালে হাতেখড়ি নেবে, তাদের পরিণতি কী হবে? আগামী ৫০ বছরের প্রাথমিক শিক্ষার অবস্থাটাই-বা কী দাঁড়াবে?

আমি অনেক যোগ্য প্রার্থীকে দেখেছি, তাঁরা চাকরি পাননি। আমার পরিচিত একটি পরিবারের দুই বোনের মধ্যে যে বোনটি ভালো ছাত্রী, সে চাকরি পায়নি। কিন্তু যে তুলনামূলক খারাপ ছাত্রী, ঘুষের বিনিময়ে তার চাকরি হয়ে গেছে। এ ঘটনায় তাদের বাবার স্ট্রোকও হয়ে গেছে। ঘুষের নেটওয়ার্কটা এমন বিস্তৃত যে দালালেরা সম্ভাব্য প্রার্থীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে নানানভাবে ঘুষের লেনদেনের ব্যাপারটা নিশ্চিত করে। চাকরি না হলে টাকা ফেরত দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয় এবং সেই প্রতিশ্রুতি তারা রক্ষাও করে।

কারা এই দালাল? এসব খবর প্রচারিত হওয়ার পর, এসব জানার ও দেখার পর দুদক কর্তৃপক্ষ কি তাদের হাতেনাতে গ্রেপ্তার করছে? ৬৮ হাজার গ্রামে একজন দুর্নীতিবাজ দালালকেও তারা গ্রেপ্তার করতে পারেনি। এদিকে কলকাতার হাইকোর্ট অনেক কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। মাত্র কয়েকটি নিয়োগের ক্ষেত্রে দুর্নীতি প্রমাণিত হওয়ার পর সেখানকার শিক্ষামন্ত্রী সাড়ে তিন বছর যাবৎ জেল খাটছেন। শুধু তা-ই নয়, একজন শিক্ষয়িত্রী যিনি দুর্নীতির মাধ্যমে চাকরি নেওয়ার কারণে তাঁর প্রাপ্য সব বেতন বাবদ ২৭ লাখ টাকা সরকারের কোষাগারে ফেরত দিতে হয়েছে। আর শিক্ষা বিভাগের দুর্নীতিবাজ শত শত কর্মকর্তা ও কর্মচারী গ্রেপ্তার হয়ে জেলে জীবন যাপন করছেন।

কিন্তু এই যে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী টাকা ফেরত দিলেন, এরপর কি কোনো প্রমাণের অপেক্ষা রাখে? তবু তো দুদক নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে। আশা করছি হাইকোর্টের কোনো বিচারক বিষয়টি সুয়োমোটোর আওতায় এনে ঘটনাটির বিচারের ব্যবস্থা করবেন। বিষয়টি অনুগ্রহ করে সবাই ভেবে দেখবেন—আপনার সন্তানের শিক্ষক দুর্নীতির মাধ্যমে চাকরি নিয়েছেন, তাতে আপনার সন্তান যদি সেই দুর্নীতিবাজ শিক্ষককে শ্রদ্ধার চোখে না দেখে, তাহলে কি অপরাধ হবে?

স্কুলের ম্যানেজিং কমিটি বলে একটা বিষয় আছে, সেটাও রাজনৈতিক বিবেচনায় নির্ধারিত হয় এবং গ্রামের প্রভাবশালী ব্যক্তিরা এখানকার দায়িত্বে থাকেন। বেসরকারি মাধ্যমিক স্কুলগুলোর শিক্ষকেরা নানা অবৈধ উপায়ে নিয়োগ পেয়েছেন। সৎ শিক্ষকেরা কোণঠাসা। যাঁরা কোচিং করান না, দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত নন, তাঁদের পক্ষে টিকে থাকা অসম্ভব। নানান ধরনের অপমান সহ্য করে তাঁরা শিক্ষকতার কাজটি করে যাচ্ছেন। দুর্নীতির মাধ্যমে যাঁরা চাকরি নিয়েছেন, তাঁদের পক্ষে কি ম্যানেজিং কমিটির প্রভাবশালী ব্যক্তির সন্তানকে ফেল করানো সম্ভব? অন্যদিকে নীতিমান শিক্ষকেরা চিহ্নিত হবেন, চাকরি হারাবেন এবং অপমানিত হবেন। শিক্ষাব্যবস্থা যাঁরা প্রণয়ন করেন, তাঁরা সম্ভবত এ দেশটিকে জানেন না, অথবা বিদেশি প্রভাবে বিশ্বব্যাংকের কিছু টাকার বিনিময়ে নিজেদের আত্মাকে বিক্রি করে দিয়েছেন। যেমন করে আমাদের বনভূমিতে ইউক্যালিপটাস জোর করে চাষ করা হয়েছে। এই ইউক্যালিপটাস বা আকাশিগাছ এ দেশের উর্বর ভূমি ও বনকে শেষ করে দিচ্ছে।

বহুদিন ধরেই আমাদের দেশের মেধা অতি অল্প মূল্যে সাম্রাজ্যবাদের কাছে বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। প্রথম থেকেই স্বাধীনতার পরে শিক্ষাব্যবস্থা, স্বাস্থ্য ও অর্থনীতি নিয়ে যে কথা উঠেছিল, তা নানা কারণে ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। ড. কুদরাত-এ-খুদাকে দিয়ে একটি শিক্ষা কমিশন করা হয়েছিল, সেটাও কার্যকর করা হয়নি; বরং কার্যকর হয়েছে পরবর্তীকালে স্বৈরাচারের আমলে মজিদ খানের শিক্ষানীতি। শিক্ষা নিয়ে এ দেশে এক্সপেরিমেন্টের শেষ নেই। সৃজনশীল শিক্ষানীতির এক নতুন শিক্ষাব্যবস্থা শুরু করল, যেখানে সৃজনশীলতা নেই আছে শুধু মুখস্থবিদ্যা!

শিক্ষানীতি প্রণয়নকারীরা পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের শিক্ষানীতিকে যদি অনুসরণ করেন, তাহলেই যুগোপযোগী শিক্ষাক্রম তৈরি হয়, শিক্ষাটা বেঁচে যায়। কিন্তু পুরো শিক্ষাব্যবস্থা চলছে বিদেশি প্রেসক্রিপশন এবং গড্ডলিকা প্রবাহে। আর তাতে তৈরি হচ্ছে দুর্নীতির বিভিন্ন সুযোগ। এখন নতুন শিক্ষাক্রম যেমনভাবে তৈরি হয়েছে, যেখানে শিক্ষকেরা ব্যাপক দুর্নীতি করার আরও সুযোগ পাবেন কি না, সেটাও ভাবার বিষয়। সুযোগ পেলে ফুলেফেঁপে উঠবে কোচিং ব্যবসা। বেতন বাড়ার পরেও অনেক শিক্ষক সন্তুষ্ট নন। তাঁরা কোচিং-বাণিজ্য দিয়ে ফুলেফেঁপে উঠছেন। তাঁদের এত টাকা হয়েছে, যে ঢাকা শহরে একাধিক ফ্ল্যাট কেনাও সম্ভব হচ্ছে। তাই পেঁয়াজ-কাঁচা মরিচের দাম বাড়লে তাঁদের কিছু যায়-আসে না।

আমরা যে শিক্ষকদের দেখেছি, তাঁরা শুধু ডাল-ভাত খেয়ে পড়াতেন। সেটাও কোনো আদর্শ ব্যবস্থা নয়; যেখানে পৃথিবীর অনেক জায়গায় প্রাথমিক শিক্ষকেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সমান বেতন পান, কখনো বেশিও পান। প্রতিবেশী দেশ ভারতে একজন মাধ্যমিক শিক্ষক ৫০ থেকে ৮০ হাজার টাকা পর্যন্ত বেতন পান। বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় খরচে অনেক অপচয়ী খাত আছে, সেগুলো পরিহার করে শিক্ষকদের জন্য একটা ভালো বেতনকাঠামো তৈরি করা সম্ভব। শুধু তা-ই নয়, শিক্ষা-বাণিজ্য করার জন্য যেসব স্কুল-কলেজ চালানো হয়, সেগুলো বন্ধ করে দেওয়া যায়। দেশে মাদ্রাসা শিক্ষাকে গুরুত্ব দিয়ে সরকারিভাবে যেসব প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়েছে, তা একেবারে অপ্রয়োজনীয় এবং রাষ্ট্রীয় কাজে তা নিরর্থক। কিন্তু রাজনৈতিক স্বার্থে এসব প্রতিষ্ঠান দেশের কোনো কাজে লাগছে না। দেশে কওমি মাদ্রাসা আছে, যে মাদ্রাসাগুলোর শিক্ষা কার্যক্রমের ওপর সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। দেশের উচ্চশিক্ষা এবং এ ধরনের ধর্মভিত্তিক শিক্ষা থেকে দেশ কোনোভাবেই উপকৃত হচ্ছে না।

একজন শিক্ষাবিদ বলছিলেন, আমরা যদি একজন সুইপারের জন্য বিজ্ঞাপন দিই, সেখানেও হাজার হাজার গ্র্যাজুয়েট-মাস্টার্স পাস ছেলে আবেদন করে থাকেন। কী ভয়ংকর ব্যবস্থা! শিক্ষার উচ্চতর ডিগ্রিগুলো সব সময়ই অতি মেধাবীদের জন্য বরাদ্দ থাকা উচিত। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, একেকটি কলেজে শিক্ষার্থী হয়ে দাঁড়াচ্ছে কয়েক হাজার। সারা দেশে লাখ লাখ শিক্ষার্থী এম এ পাস করবেন। কিন্তু চাকরির ব্যবস্থা হয়তো কয়েক হাজার। তখন ডিগ্রিটা বেকারদের কাছে একটা বোঝা এবং কার্যক্ষেত্রে অনিশ্চয়তার প্রতিশ্রুতি। এ নিয়ে রাষ্ট্রের কোনো মাথাব্যথা নেই। এই শিক্ষিত বেকারদের নিয়ে গবেষণা ও ভাবনার কোনো রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান নেই।

আজ যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় ছাত্ররাজনীতি চলে, সেখানকার নেতা-কর্মীদের অনেকেই বিবাহিত এবং সন্তানের জনক। কারণ, ছাত্ররাজনীতি থেকে একটা জীবিকা হয়। পরবর্তীকালে রাজনীতিতে এসেও তাঁরা জীবিকার সন্ধান করেন এবং বিপুল পরিমাণ অর্থের মালিক হন। এমন পরিস্থিতিতে দেশের নীতিনির্ধারকেরা কী ভূমিকা রাখবেন? এটি কি একেবারেই বিবেচনার বিষয় নয়?

দেশটি জনবহুল কিন্তু সুযোগ সীমিত। কর্মের সুযোগ প্রসারের করার জন্য প্রয়োজন ব্যাপক কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা; দক্ষ, আধা দক্ষ ও অদক্ষ শ্রমিকদের জন্য সম্মানজনক পেশার দ্বার উন্মুক্ত করা; অন্যদিকে যাঁরা সত্যিকার অর্থে মেধাবী, তাঁদের রাষ্ট্রের কাজে ব্যবহার করা—যার কোনোটাই কিন্তু হচ্ছে না। ফলে মেধাবীরাও দুর্নীতিতে উৎসাহিত হচ্ছেন। বর্তমানে এটাও শোনা যায়, রাজনীতি করাও একটা বড় পেশা। সবচেয়ে বেশি অর্থ নাকি এখান থেকে পাওয়া যায়। কিন্তু সেই অর্থও দুর্নীতির। আমরা যখন ছাত্র ছিলাম, শিক্ষায় দুর্নীতির কথা কখনো কল্পনাও করতে পারিনি।

তাহলে আমরা কি ক্রমাগত সব ক্ষেত্রে দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে এগিয়ে যাব? অন্তত শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে ক্রমাগত দুর্নীতিমুক্ত হয়ে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব নয় কি?

লেখক: মামুনুর রশীদ, নাট্যব্যক্তিত্ব


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
প্রধানমন্ত্রীর কাছে এসএসসির ফল হস্তান্তর - dainik shiksha প্রধানমন্ত্রীর কাছে এসএসসির ফল হস্তান্তর এসএসসি পরীক্ষার ফল জানবেন যেভাবে - dainik shiksha এসএসসি পরীক্ষার ফল জানবেন যেভাবে এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের জন্য সুখবর - dainik shiksha এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের জন্য সুখবর চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের অভিযুক্ত নারায়ণ চন্দ্র নাথের কাহিনী - dainik shiksha চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের অভিযুক্ত নারায়ণ চন্দ্র নাথের কাহিনী সনদ জালিয়াতিতে জড়িত সবাইকে আইনের আওতায় আনা হবে - dainik shiksha সনদ জালিয়াতিতে জড়িত সবাইকে আইনের আওতায় আনা হবে শিক্ষার্থীদের প্রযুক্তির উদ্ভাবক হওয়ার আহ্বান শিক্ষামন্ত্রীর - dainik shiksha শিক্ষার্থীদের প্রযুক্তির উদ্ভাবক হওয়ার আহ্বান শিক্ষামন্ত্রীর শিক্ষকদের বেতন আটকে সর্বজনীন পেনশন যোগ দিতে চাপের অভিযোগ - dainik shiksha শিক্ষকদের বেতন আটকে সর্বজনীন পেনশন যোগ দিতে চাপের অভিযোগ কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে উপবৃত্তির সব অ্যাকাউন্ট নগদ-এ রূপান্তরের সময় ফের বৃদ্ধি - dainik shiksha উপবৃত্তির সব অ্যাকাউন্ট নগদ-এ রূপান্তরের সময় ফের বৃদ্ধি দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0043308734893799