পড়াশোনার খরচ জোগাতে ফুচকা বেচে দুই ভাই

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

সন্ধ্যা গড়িয়ে এসেছে। হালকা শীতের আমেজে সড়কের পাশের ছোট ছোট খাবার দোকানে ভিড় করছেন পথচারীরা। এর মধ্যে চোখ আটকে গেল দুই শিশুর দিকে। দুজন মিলে দারুণভাবে ক্রেতাদের সামাল দিচ্ছে। দুজনের চার হাত যেন সমানতালে চলছে। একজন ফুচকা বানাচ্ছে, তো আরেকজন ভেলপুরির প্লেট সাজাচ্ছে। আবার কখনো একজন টাকাপয়সার লেনদেন করছে, আর আরেকজন ক্রেতাদের ডাকাডাকি করছে। মঙ্গবার (৬ নভেম্বর) প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়।

প্রতিবেদনে আরও জানা যায়, সিলেট নগরের জিন্দাবাজারের কাজী ম্যানশন বিপণিবিতানের সামনের ‘মামা ভেলপুরি’ নামে ভ্রাম্যমাণ এক দোকানের চিত্র এটি। রনি মিয়া (১২) ও রাহাত মিয়া (১০)—দুই ভাই মিলে দোকানটি চালায়। প্রতিদিন বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত চলে বেচাকেনা। তবে রনি আর রাহাত পুরোদস্তুর ব্যবসায়ী নয়। তারা দুজনই পড়াশোনা করে। 

রনি ও রাহাত জানাল, অন্য শিশুদের মতোই প্রতিদিন সকালে তারা নির্ধারিত পোশাক পরে কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে স্কুলে যায়। তবে স্কুল ছুটির পরের গল্পটা অন্যদের চেয়ে আলাদা। স্কুল শেষে বিকেলে সহপাঠীরা যখন খেলাধুলা আর দুরন্তপনায় ব্যস্ত থাকে, তখন রনি আর রাহাত নেমে পড়ে জীবনসংগ্রামে। দুই ভাই মিলে ভ্যানগাড়িতে ভেলপুরি আর ফুচকা বিক্রি করে জিন্দাবাজারে। বিকেল চারটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত চলে তাদের এই ভ্রাম্যমাণ দোকান।

ফুচকা বিক্রির ফাঁকে ফাঁকে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় রনি ও রাহাতের। তারা দুজনই জিন্দাবাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে। এর মধ্যে রনি বড়। সে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে। অন্যদিকে রাহাত পড়ে তৃতীয় শ্রেণিতে। রাহাত-রনির বাবা তবারক আলী সিলেট শহরে পিঠা বিক্রি করেন। তবারক আলী তাঁর স্ত্রী, দুই ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে নগরের পূর্ব জিন্দাবাজার এলাকায় থাকেন। যদিও তাঁদের আদিনিবাস নেত্রকোনায়। তবে জীবিকার তাগিদে দীর্ঘদিন ধরেই তাঁরা সিলেটে থাকেন। রনির বড় বোন অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছেন। এরপর আর পড়াশোনা হয়নি। এখন রনির বোন আর মা বাসায় পিঠা, ভেলপুরি ও ফুচকা তৈরির উপাদান প্রস্তুত করে দেন।

পড়াশোনার পাশাপাশি ফুচকা বিক্রির কারণ জানতে চাইলে রাহাত বলে, পড়াশোনা ও সংসারের খরচ তার বাবার পক্ষে চালানো কঠিন। এ জন্য তারা দুই ভাই ফুচকা বিক্রি করছে। এতে তার বাবা কিছুটা স্বস্তি পেয়েছেন। সব মিলিয়ে প্রতিদিন এক থেকে দেড় হাজার টাকার ফুচকা আর ভেলপুরি বিক্রি হয়। বিপণিবিতানে কেনাকাটা করতে আসা লোকজনই মূলত তাদের ক্রেতা। রনি ও রাহাতের দোকান থেকে আনুমানিক ৪০ গজ সামনে গেলেই তাদের বাবার দোকান। সেখানে বাহারি স্বাদের পিঠা বিক্রি করেন তবারক আলী।

ছেলেমেয়েদের কথা জিজ্ঞেস করতেই দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তবরাক আলী। তিনি বলেন, ‘রাস্তায় দাঁড়ায় চার-পাঁচ ঘণ্টায় এসব বিক্রি হয়। এতে দৈনিক ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা আয় হয়। এই সামান্য টাকা দিয়ে সংসার ও ছেলেদের পড়াশোনার খরচ চালানো যায় না। মেয়েটাকে টাকার অভাবে পড়াশোনা করাতে পারিনি। বিয়ের উপযুক্ত হলেও টাকার জন্য মেয়ের বিয়ে দিতে পারছি না।’

তবারক আলী বলেন, তার দুই ছেলে সব সময় ফুচকা বিক্রি করে না। শীত মৌসুম হওয়ায় তিনি পিঠার দোকান দিয়েছেন। বাড়তি আয়ের আশায় সন্তানদের ওই ব্যবসায় লাগিয়েছেন। শীত মৌসুমের পর তিনি নিজেই আবার ভেলপুরি ও ফুচকা বিক্রি করেন। দুই ছেলের আয়ের টাকা তাদের পড়াশোনার পেছনেই খরচের পরিকল্পনা আছে তাঁর।

জিন্দাবাজারের সুরমা ট্রেড অ্যান্ড ট্যুর নামের একটি প্রতিষ্ঠানের মালিক আফজাল হোসেন বলেন, শীত মৌসুম শুরু হতে না হতেই দুই শিশু এখানে দোকান নিয়ে বসেছে। আগে তাদের বাবা এখানে ব্যবসা করতেন। পথচারী ছাড়া আশপাশের বিপণিবিতানের ব্যবসায়ী, কর্মচারী ও ক্রেতারা শিশুদের কাছ থেকে ফুচকা-ভেলপুরি কিনে খান। ব্যবসার পাশাপাশি তারা পড়াশোনা করছে—বিষয়টি জানার পর থেকে সবাই তাদের স্নেহের দৃষ্টিতে দেখেন।

রাত আটটার পর দোকান বন্ধ করে রনি আর রাহাত বাড়ি ফিরে যায়। তবে সারা দিনের ক্লান্তিতে অনেক সময় তখন আর পড়তে বসার আগ্রহ থাকে না। তবে পরীক্ষা কিংবা পড়ার চাপ বেশি থাকলে ওই কয়েক দিন দোকান বন্ধ রাখে। পড়াশোনা করে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করার স্বপ্ন দেখে সংগ্রামী দুই ভাই। এর মধ্যে রনি ভবিষ্যতে ব্যবসায়ী এবং রাহাত সরকারি কর্মকর্তা হতে চায়।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
শুক্রবার স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত হয়নি: শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha শুক্রবার স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত হয়নি: শিক্ষা মন্ত্রণালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় - dainik shiksha অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় দুর্যোগে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছুটিতে বিশেষ কমিটি গঠনে নীতিমালা হবে: শিক্ষামন্ত্রী - dainik shiksha দুর্যোগে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছুটিতে বিশেষ কমিটি গঠনে নীতিমালা হবে: শিক্ষামন্ত্রী জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮ মে’র পরীক্ষা স্থগিত - dainik shiksha জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮ মে’র পরীক্ষা স্থগিত হিটস্ট্রোকে সাতক্ষীরায় শিক্ষকের মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে সাতক্ষীরায় শিক্ষকের মৃত্যু হিটস্ট্রোকের লক্ষণ ও করণীয় - dainik shiksha হিটস্ট্রোকের লক্ষণ ও করণীয় দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে চাকরিতে আবেদনের বয়স ৩৫ করতে শিক্ষামন্ত্রীর সুপারিশ - dainik shiksha চাকরিতে আবেদনের বয়স ৩৫ করতে শিক্ষামন্ত্রীর সুপারিশ শিক্ষিকার উত্যক্তকারীকে ধরতে গিয়ে হামলার শিকার পুলিশ - dainik shiksha শিক্ষিকার উত্যক্তকারীকে ধরতে গিয়ে হামলার শিকার পুলিশ সর্বজনীন পেনশনে অন্তর্ভুক্তির প্রতিবাদে ঢাবি শিক্ষক সমিতির কর্মসূচি - dainik shiksha সর্বজনীন পেনশনে অন্তর্ভুক্তির প্রতিবাদে ঢাবি শিক্ষক সমিতির কর্মসূচি please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0022950172424316