ভারত পশ্চিমাদের আগে গণিতে যেভাবে বিপ্লব ঘটিয়েছে

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

চীনের মতো, ভারত অনেক আগে থেকেই "দশমিক" ব্যবহারের সুবিধা খুঁজে পায়। এবং তারা তৃতীয় শতক থেকে এই দশমিক ব্যবহার করে আসছে।

তারা কীভাবে দশমিক পদ্ধতি খুঁজে পেয়েছে সেটা জানা যায়নি। তবে জানা গেছে যে তারা এই পদ্ধতিটি পরবর্তীতে আরও পরিমার্জন এবং নিখুঁত করে তোলে।

তাদের দেখানো নিয়মে আমরা এখনও সংখ্যার অবস্থান বুঝতে একক, দশক, শতক, সহস্র পদ্ধতি ব্যবহার করি।

এছাড়া বিশ্বব্যাপী ব্যবহৃত এক থেকে নয় পর্যন্ত সংখ্যার ভিত্তি স্থাপন এবং নতুন একটি সংখ্যা, শূন্য-এর উদ্ভাবন হয়েছে ভারত থেকেই।


শূন্য:


কাগজে কলমে নবম শতক থেকে শূন্য ব্যবহারের কথা বলা হলেও এটি তারও শত শত বছর আগে থেকে ব্যবহৃত হয়ে আসছে বলে ধারণা করা হয়।

মধ্য ভারতের গোয়ালিয়র দুর্গের ভেতরের একটি ছোট মন্দিরের দেয়ালের ওপর এই অদ্ভুত সংখ্যাটি লিখিত অবস্থায় পাওয়া যায়।

শূন্য সংখ্যাটি সামনে আনার কারণে ভারতের এই অঞ্চলটি এখন গাণিতিক উপাসনার স্থান হয়ে উঠেছে।

অথচ, ভারতের আগে এই সংখ্যাটির কোন অস্তিত্ব ছিল না।

প্রাচীন মিশরে, মেসোপটেমিয়ান সভ্যতা এবং চীনে, শূন্যের অস্তিত্ব থাকলেও সেটি ব্যবহৃত হতো শুধু সংকেত হিসাবে, একটি খালি স্থান বোঝাতে।

ভারতীয়রাই এই শূন্যকে একটি সংখ্যার রূপ দেয়। এবং তাদের এই ধারণা গণিতে বিপ্লব ঘটায়।

তখন থেকে জ্যোতির্বিজ্ঞানের জন্য খুব দক্ষভাবে সংখ্যা গঠন করা সম্ভব হয়ে ওঠে।

শূন্য সংখ্যাটির প্রাচীনতম লিখিত রূপ, যেটা একটি ভারতীয় মন্দির প্রাচীরে পাওয়া গেছে।


কিভাবে তারা শূন্য আবিষ্কার হল?


শূন্য কিভাবে এসেছে সেটা নিশ্চিতভাবে জানা যায়নি, তবে ধারণা করা হয় যে শূন্য সংখ্যাটি লেখার ক্ষেত্রে গোলাকৃতির যে প্রতীক ব্যবহার করা হয় সেটা এসেছে মাটিতে গণনা করার জন্য ব্যবহৃত পাথর খণ্ড থেকে।

এই সংখ্যা আবিষ্কারের পেছনে সাংস্কৃতিক কারণ থাকতে পারে বলেও ধারণা করা হয়।

শূন্যতা ও চিরস্থায়ী/অবিনশ্বর এই ধারণাগুলোর প্রাচীন ভারতীয়দের বিশ্বাসের একটি অংশ।

বৌদ্ধ ও হিন্দু উভয় ধর্ম চিরস্থায়ী বা অবিনশ্বর ধারণাটিকে লালন করে। সেখান থেকেই এসেছে এই শূন্যের ধারণা।

ভারতীয়রা শূন্য শব্দটি খালি বা ফাঁকা বোঝাতে ব্যবহার করে।


শূন্য থেকে অনন্ত


ভারতের বিখ্যাত গণিতবিদ ব্রহ্মগুপ্ত সপ্তম শতকে শূন্যের কিছু প্রয়োজনীয় বৈশিষ্ট্য ব্যাখ্যা করেছিলেন।

শূন্যকে ঘিরে গণনার জন্য তার মৌলিক নিয়ম এখনও সারা বিশ্বের স্কুলগুলোতে শেখানো হয়।

১+০ = ১

১-০ = ১

১ x ০= ০

শূন্য দিয়ে কোন সংখ্যা গুণ করলে ফলাফল এক হবে?- এমন একটি প্রশ্নের সমাধান বের করতে গিয়ে উদ্ভব হয় ইনফিনিটি বা অসীম নামের গাণিতিক ধারণাটির।

এবং এই ধারণাটিও এনেছিলেন একজন ভারতীয় গণিতবিদ - ভাস্কর, যিনি ১২ শতকে বিষয়টিকে সামনে আনেন।


সেটা কেমন করে?


আপনি যদি একটি ফলকে অর্ধেক কাটেন তাহলে আপনি দুটি টুকরো পাবেন। যদি আপনি তিন ভাগ কাটেন, আপনি তিন টুকরো পাবেন।

এভাবে ভাগ করতে করতে ছোট ছোট ভগ্নাংশের সৃষ্টি হবে। সবশেষে, আপনি অসীম টুকরা পাবেন।

ভাস্করের মতে, একের সঙ্গে শূন্য ভাগ করলে ফলাফল হবে অসীম।

 

ঋণাত্মক সংখ্যা


কিন্তু গণনার ক্ষেত্রে শূন্যের ব্যবহার আরও বিস্তৃত।

একসময় সমান সমান সংখ্যার বিয়োগফল, যেমন তিন বিয়োগ তিনের ফলাফল হিসেবে শূন্যকে গ্রহণ করা হয়েছিল।

তারপর প্রশ্ন ওঠে তিন বিয়োগ চারের ফলাফল তাহলে কি হবে। এখানেও তো ফলাফল শূন্য হওয়ার কথা।

এমন অবস্থায় নতুন ধরণের শূন্য বা নেগেটিভ নাম্বার অর্থাৎ ঋণাত্মক সংখ্যার উদ্ভব হয়।

ভারতীয়রা ঋণাত্মক সংখ্যা এবং শূন্যের ধারণা পর্যন্ত পৌঁছাতে পেরেছিল কারণ তারা সেগুলোকে বিমূর্ত সত্ত্বা হিসেবে মনে করে।

সংখ্যা যে শুধুমাত্র গণনা বা পরিমাপ করার জন্য ব্যবহার হয় এমনটা নয়। সংখ্যারও জীবন আছে।

যেটা কিনা বাস্তব জগতের সঙ্গে সংযুক্ত। এবং চিন্তার এই রেখা সব ধরণের গাণিতিক ধারনার সৃষ্টি করেছে।

 

এক্স এবং ওয়াই


চতুর্ভুজ সমীকরণ সমাধান করার ক্ষেত্রেও ভারতীয়দের এই পদ্ধতিটি নতুন উপায় প্রকাশ করেছে।

ঋণাত্মক সংখ্যা নিয়ে ব্রহ্মগুপ্তের উপলব্ধি তাকে চতুর্ভুজ সমীকরণ সমাধানে সহায়তা করে।

যেখানে ফলাফল দুটি আসে, তারমধ্যে একটি ফলাফল ঋণাত্মক হতে পারে।

তিনি দুটি ভেরিয়েবল বা অসম সমীকরণ (এক্স এবং ওয়াই) সমাধানের ক্ষেত্রেও অনেক এগিয়ে যান।

অথচ পশ্চিমে গণিতের এই পদক্ষেপগুলো নেয়া হয়েছিল ১৬৫৭ সালে।

 

সে সময় ফরাসি গণিতবিদ পিয়ের ডি ফেরমাত তার এ সংক্রান্ত সমাধানগুলো উপস্থাপন করেছিলেন।

অথচ ভারতীয়রা হাজার বছর আগেই সেগুলো সামনে এনেছিল।

ব্রহ্মগুপ্ত এসব সমীকরণের সমাধান প্রকাশ করতে নতুন একটি ভাষাও গড়ে তুলেছিলেন।

তিনি নিজের এসব গণনা উপস্থাপন করতে বিভিন্ন উপায় নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন।

ভেরিয়েবল উপস্থাপন করতে তিনি দুটি অক্ষর ব্যবহার করেন। এক্স এবং ওয়াই। যেটা এখনও ব্যবহার হচ্ছে।

 

এখানেই শেষ নয়


ত্রিকোণমিতির আবিষ্কারের পেছনেও রয়েছেন ভারতীয় গণিতবিদরা।

এটা সত্য যে গ্রিকরা প্রথম ডিকশনারি বা অভিধানের বিকাশ করেছিল। যেটা কিনা জ্যামিতিকে সংখ্যায় অনুদিত করে।

কিন্তু ভারতীয়রা এই ধারণাটিকে আরও এগিয়ে নিয়ে যায়।

তারা ত্রিকোণমিতি ব্যবহার করে চারপাশের বিশ্বকে অধ্যয়ন করার পদ্ধতি আবিষ্কার করে।

সমুদ্রের চলাচল থেকে শুরু করে মহাকাশে একটি নক্ষত্র থেকে আরেকটি নক্ষত্রের দূরত্ব পরিমাপে তারা প্রয়োগ করে এই ত্রিকোণমিতি।


পাই


ভারতীয় গণিতজ্ঞরা গণিতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংখ্যা 'পাই' এর রহস্যের সমাধান করেছে।

'পাই' হল একটি বৃত্তের পরিধি ও ব্যাসের অনুপাতের সংখ্যাগত মান।

এটি এমন একটি সংখ্যা যেটা সব ধরণের গণনায় ব্যবহার হয়। তবে এর সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হয় প্রকৌশল এবং স্থাপত্যবিদ্যায়।

কেননা, যেকোনো বক্ররেখা পরিমাপের জন্য 'পাই' এর প্রয়োজন।

শত শত বছর ধরে, গণিতজ্ঞরা পাই-এর সুনির্দিষ্ট মান বের করার চেষ্টা করেছেন।

পরে ষষ্ঠ শতকে ভারতীয় গণিতবিদ আর্যভট্ট এ নিয়ে একটি সুনির্দিষ্ট ধারণা দেন। আর সেটা হল ৩.১৪১৬।

পৃথিবীর পরিধি পরিমাপের জন্য তিনি এই সংখ্যা ব্যবহার করেছিলেন। তার গণনা অনুযায়ী পৃথিবীর পরিধি ৩৯,৯৬৮ কিলোমিটার।

যেটা কিনা সর্বশেষ পরিমাপের (৪০,০৭৫ কিলোমিটার) সবচেয়ে কাছাকাছি মান।


তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে বিভিন্ন ভগ্নাংশ যোগ এবং বিয়োগ করে পাই এর জন্য সঠিক সূত্র নির্ধারণ করা সম্ভব।

এই সূত্রটি এখনও বিশ্বজুড়ে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো হয়। তবে শেখানে শেখানো হয় যে এটি ১৭ শতকের জার্মানির গটফ্রাইড উইলহেম লিবনিজ আবিষ্কার করেছেন।

সূত্র: বিবিসি 


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশ ১২ মে - dainik shiksha এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশ ১২ মে খাড়িয়া ভাষা সংরক্ষণে উদ্যোগ গ্রহণের আহবান প্রধান বিচারপতির - dainik shiksha খাড়িয়া ভাষা সংরক্ষণে উদ্যোগ গ্রহণের আহবান প্রধান বিচারপতির উপবৃত্তির সব অ্যাকাউন্ট নগদ-এ রূপান্তরের সময় বৃদ্ধি - dainik shiksha উপবৃত্তির সব অ্যাকাউন্ট নগদ-এ রূপান্তরের সময় বৃদ্ধি শিক্ষক হতে চান না শিক্ষক দম্পতিদের কৃতী সন্তানরা - dainik shiksha শিক্ষক হতে চান না শিক্ষক দম্পতিদের কৃতী সন্তানরা কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে শিক্ষার্থী বিক্ষোভের মধ্যে ইহুদিবিদ্বেষ নিয়ে বিল পাস - dainik shiksha শিক্ষার্থী বিক্ষোভের মধ্যে ইহুদিবিদ্বেষ নিয়ে বিল পাস দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0026309490203857