মানের বালাই নেই বেসরকারি পলিটেকনিকে

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

বেসরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট অনুমোদন দেয় বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ড। এরপর নতুন কোর্স খোলা, পরীক্ষা গ্রহণ, ফল প্রকাশ, ল্যাবরেটরি, শিক্ষকসহ আনুষঙ্গিক বিষয়গুলোর দেখভালের দায়িত্বও তাদের। কিন্তু আগারগাঁওয়ের কারিগরি শিক্ষা বোর্ড থেকে মাত্র চার কিলোমিটার দূরে মিরপুর ১০ নম্বরে মিরপুর ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি (এমআইএসটি)। প্রতিষ্ঠানটিতে ল্যাবরেটরিসহ শিক্ষার ন্যূনতম পরিবেশ নেই। কারিগরি শিক্ষা বোর্ড থেকে এই প্রতিষ্ঠানটিই দেখভাল করা সম্ভব হচ্ছে না, তাহলে তারা কীভাবে দেখভাল করবে ৩৮৭টি বেসরকারি পলিটেকনিক? শুক্রবার (৪ অক্টোবর) কালের কণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন শরীফুল আলম সুমন।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, সম্প্রতি সরেজমিনে এমআইএসটিতে গিয়ে দেখা যায়, পাশাপাশি দুটি ভবনের তৃতীয় ও চতুর্থ তলা ভাড়া নিয়ে প্রতিষ্ঠানটির ক্যাম্পাস। ভবন দুটির নিচতলায় বিভিন্ন ধরনের শোরুম, দ্বিতীয় তলায় ব্যাংকসহ নানা অফিস, তৃতীয় তলার একাংশেও অফিস আর পঞ্চম তলায় আবাসিক হোটেল। মূলত ভবনটির চতুর্থ তলায় প্রতিষ্ঠানটির ক্লাসরুম-ল্যাব, তৃতীয় তলার একাংশে অফিস রুম। সরেজমিনে গিয়ে তিনটি ক্লাসরুম সচল অবস্থায় দেখা গেছে। একটি ক্লাসরুমে তিনজন শিক্ষার্থী, আরেকটিতে পাঁচজন, অন্যটিতে একজন শিক্ষার্থী পাওয়া গেছে।

তিনটি ল্যাবরেটরিতে দেখা গেছে, এলোমেলোভাবে চেয়ার-টেবিল ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। অকেজো দু-চারটি যন্ত্রপাতিও রাখা আছে। ল্যাবরেটরি তিনটিতে যে পরিমাণ ধুলা-ময়লার স্তূপ জমেছে, সহজেই বোঝা যায়, গত কয়েক মাসে সেখানে কেউ প্রবেশ করেনি। তবে তৃতীয় তলায় অফিস রুমের পাশে কম্পিউটার ল্যাব। সেখানে ১৫টি কম্পিউটার রয়েছে। এর মধ্যে কয়টি সচল তা জানা যায়নি।

এমআইএসটিতে ক্লাসরুম ও ল্যাবরেটরির এমন বেহাল হলেও ছয়টি বিষয়ে ডিপ্লোমা-ইন-ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সুযোগ রয়েছে। সেগুলো হলো টেক্সটাইল, কম্পিউটার, ইলেকট্রিক্যাল, অটোমোবাইল, সিভিল ও রিফ্রিজারেশন অ্যান্ড এয়ারকন্ডিশনিং। চার বছরের কোর্সে টেক্সটাইলে ফি নেয়া হয় এক লাখ ১২ হাজার টাকা। অন্যগুলোতে ৯৬ হাজার টাকা। ওই ইনস্টিটিউটে ছয়টি বিষয়ের জন্য মোট ৯ জন শিক্ষক এবং ৩০০ শিক্ষার্থী রয়েছে বলে জানা গেছে।

শিক্ষার্থী ভর্তির কথা বলে অফিস রুমে কথা হয় প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা নাহার আক্তারের সঙ্গে। ল্যাবরেটরি কোথায় জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘টেক্সটাইলের শিক্ষার্থীদের আমরা সাধারণত কারখানায় নিয়েই হাতে-কলমে শেখাই। কারণ অত বড় মেশিনপত্র আমাদের প্রতিষ্ঠানে এনে রাখা সম্ভব নয়। অটোমোবাইলের ব্যাবহারিকের জন্যও গ্যারেজে নিয়ে যাওয়া হয়। আর অন্যান্য টেকনোলজির জন্য ল্যাবরেটরি আমাদের আছে। পিয়ন বাইরে যাওয়ায় আপনাকে এ মুহূর্তে দেখাতে পারছি না।’

পাশের টেবিলে বসা আরেক কর্মকর্তা মো. টিপু বলেন, ‘আমাদের আরেকটি ক্যাম্পাস আছে। সেখানে আরও কিছু ল্যাবরেটরি আছে। পিয়ন না থাকায় আমরা এখন কোনোটাই দেখাতে পারব না।’ অথচ এই প্রতিবেদক ওপরের তলায় গিয়ে নিজে নিজেই ল্যাবরেটরি নামের ময়লার স্তূপ দেখে এসেছেন।

ক্লাসরুমে কথা হয় ইলেকট্রিক্যাল প্রথম বর্ষের তিন শিক্ষার্থী নাঈম, হাফিজ ও পৃথুলের সঙ্গে। তাঁরা জানান, তাঁদের শুধু থিউরিটিক্যাল ক্লাস করানো হচ্ছে। এখনো ল্যাবরেটরিতে নেয়া হয়নি।

কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের নীতিমালা অনুযায়ী, প্রতি টেকনোলজিতে একজন চিফ ইন্সট্রাক্টর (টেক), একজন ইন্সট্রাক্টর (টেক), জুনিয়র ইন্সট্রাক্টর (টেক) দুজন, প্রতি দুই টেকনোলজিতে একজন ইন্সট্রাক্টর (নন-টেক) ও একজন জুনিয়র ইন্সট্রাক্টর (নন-টেক), প্রতি টেকনোলজিতে একজন ল্যাব অ্যাটেনডেন্টসহ একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী থাকার কথা। সে হিসাবে প্রতি টেকনোলজিতে কমপক্ষে চারজন শিক্ষক ও একজন ল্যাব অ্যাটেনডেন্ট থাকার কথা। এই হিসাবে এমআইএসটিতে ৩০ জন শিক্ষক ও ল্যাব অ্যাটেনডেন্ট থাকার কথা থাকলেও আছেন মাত্র ৯ জন। আর প্রতি টেকনোলজিতে চারটি ল্যাবরেটরি ও চারটি করে ৪০০ বর্গফুটের ক্লাসরুম থাকার কথা থাকলেও মূলত তাদের কিছুই নেই। এর পরও ২০০৩ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ভাড়া বাড়িতে চলা প্রতিষ্ঠানটির বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি কারিগরি শিক্ষা বোর্ড।

জানা যায়, ৩৮৭ বেসরকারি পলিটেকনিকের মধ্যে ভালো মানের প্রতিষ্ঠান আছে ২০ থেকে ২৫টি। বাকি প্রতিষ্ঠানগুলোতে মানের বালাই নেই। এসব প্রতিষ্ঠানে দক্ষতা আর শিক্ষাদানের পরিবর্তে ব্যবসা করছেন মালিকরা। ছোট্ট জায়গায় চালানো হচ্ছে প্রতিষ্ঠান। নেই ল্যাবরেটরি ও প্রয়োজনীয় শিক্ষক। এর পরও এসব প্রতিষ্ঠান থেকে পাসও করছেন শিক্ষার্থীরা। কিন্তু এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের পড়ালেখার মান নিয়ে থেকে যাচ্ছে প্রশ্ন। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর স্থায়ী ক্যাম্পাসে যাওয়ার বাধ্যবাধকতা থাকলেও এখনো ১৮৪টি প্রতিষ্ঠান চলছে ভাড়া বাড়িতে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কারিগরি ও মাদরাসা বিভাগের সচিব মুনশী শাহাবুদ্দীন আহমেদ বলেন, ‘বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো একটা নীতিমালার আওতায় চলছে। আমরা মনিটর করছি। চেষ্টা করছি মান উন্নয়নের। সরকার কারিগরি শিক্ষাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছে। আমাদেরও অনেক পরিকল্পনা রয়েছে। এই শিক্ষায় শুধু পাস করলেই হবে না, দক্ষ হতে হবে। এ ক্ষেত্রে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে আমরা মডেল হিসেবে দাঁড় করাতে চাইছি, যাতে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের অনুসরণ করতে পারে। যদি তারা মান বাড়াতে ব্যর্থ হয় তাহলে তাদের ঝরে যেতে হবে।’

পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের পড়ালেখার পদ্ধতি নিয়েও রয়েছে নানা প্রশ্ন। চার বছরে আট সেমিস্টারে তাদের পড়ালেখা হয়। এর মধ্যে তিন সেমিস্টারের ফল তাদের নিজেদের হাতে থাকে। বাকি পাঁচ সেমিস্টার বোর্ডের হাতে। এ ছাড়া ব্যবহারিকের ক্ষেত্রে এক প্রতিষ্ঠান আরেক প্রতিষ্ঠানকে সহায়তা করে। ফলে ব্যবহারিক না করেও শিক্ষার্থীরা তাতে ভালো নম্বর পায়।

গত বছর বেসরকারি পলিটেকনিকগুলোতে রেটিং বা তিনটি ক্যাটাগরিতে ভাগ করার কাজ শুরু হয়েছিল, যাতে ‘সি’ ক্যাটাগরির প্রতিষ্ঠানগুলো ‘বি’ ক্যাটাগরিতে উঠতে পারে। কিন্তু সে পরিকল্পনাও কিছু পলিটেকনিক মালিকের চাপে ভেস্তে গেছে। 

পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটকে ব্যবসা হিসেবে নিয়েছে কিছু ব্যাবসায়িক প্রতিষ্ঠান। বর্তমানে একটি গ্রুপের হাতে নানা ধরনের ২০০ কারিগরি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। দেশের সব জেলায়ই এই গ্রুপের আছে একাধিক প্রতিষ্ঠান। দেখা যাচ্ছে, তারা একটি ভবন ভাড়া নিয়ে তাতে সাত-আটটি প্রতিষ্ঠান চালাচ্ছে। একটি ল্যাব প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে। আবার পরিদর্শনের সময় একই ভবনে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন সাইনবোর্ড ঝোলায় তারা। এমনকি তাদের বিরুদ্ধে ছোট ছোট প্রতিষ্ঠান দখলের অভিযোগও উঠেছে। বোর্ডের কর্মকর্তাদের ম্যানেজে পটু গ্রুপটির কর্মকর্তারা। আর্থিক সুবিধা ছাড়াও বোর্ড কর্মকর্তাদের নিয়মিত গাড়ির সুবিধা দেয় গ্রুপটি।

কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান ড. মোরাদ হোসেন মোল্ল্যা বলেন, ‘যদি কোনো প্রতিষ্ঠানে ল্যাবরেটরিসহ অন্যান্য শর্তের ঘাটতি থাকে, তাহলে আমরা পরিদর্শন করে অবশ্যই ব্যবস্থা গ্রহণ করব।’


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
একাদশ শ্রেণির ক্লাস শুরু ৩০ জুলাই - dainik shiksha একাদশ শ্রেণির ক্লাস শুরু ৩০ জুলাই অবসর কল্যাণে শিক্ষার্থীদের দেয়া টাকা জমার ফের তাগিদ - dainik shiksha অবসর কল্যাণে শিক্ষার্থীদের দেয়া টাকা জমার ফের তাগিদ সুধা রানী হাদিসের শিক্ষক পদে : এনটিআরসিএর ব্যাখ্যা - dainik shiksha সুধা রানী হাদিসের শিক্ষক পদে : এনটিআরসিএর ব্যাখ্যা শরীফ-শরীফার গল্প বাদ যাচ্ছে পাঠ্যবই থেকে - dainik shiksha শরীফ-শরীফার গল্প বাদ যাচ্ছে পাঠ্যবই থেকে কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে শূন্যপদের ভুল চাহিদায় শাস্তি পাবেন কর্মকর্তা ও প্রধান শিক্ষক - dainik shiksha শূন্যপদের ভুল চাহিদায় শাস্তি পাবেন কর্মকর্তা ও প্রধান শিক্ষক এক রুমে ৩৫ ছাত্রী অসুস্থ, পাঠদান বন্ধ - dainik shiksha এক রুমে ৩৫ ছাত্রী অসুস্থ, পাঠদান বন্ধ যৌ*ন হয়রানির অভিযোগে প্রধান শিক্ষক কারাগারে - dainik shiksha যৌ*ন হয়রানির অভিযোগে প্রধান শিক্ষক কারাগারে এসএসসির খাতা চ্যালেঞ্জের আবেদন যেভাবে - dainik shiksha এসএসসির খাতা চ্যালেঞ্জের আবেদন যেভাবে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0037851333618164