রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশে ‘প্রশাসক’ নামে কোনও পদ না থাকলেও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে এই নামে ৯টি পদ রয়েছে। বিধি অনুযায়ী এসব পদে কর্মকর্তাদের দায়িত্ব পালন করার কথা থাকলেও ৯টি পদের মধ্যে সাতটিতেই দায়িত্বে রয়েছেন শিক্ষকরা। তাদের মধ্যে কয়েকজনের কাজের দক্ষতা নিয়েও সমালোচনা রয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাদেশবহির্ভূত প্রশাসক পদের সৃষ্টি এবং কর্মকর্তাদের জায়গায় শিক্ষকদের নিয়োগ দেয়ার কারণ কী? তবে এর সুস্পষ্ট কোনও ব্যাখ্যা দিতে পারেনি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ের অফিসার সমিতির পক্ষ থেকে প্রশাসক প্রথা বাতিলসহ বেশ কয়েক দফা দাবি জানিয়ে একটি স্মারকলিপি দেয়া হয়েছে উপাচার্য বরাবর।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, জনসংযোগ দপ্তর, গ্রন্থাগার, ছাপাখানা, বিজ্ঞান কারিগরি কারখানা, পরিবহন দপ্তর, কেন্দ্রীয় কাফেটেরিয়া, রাকসুর কোষাধ্যক্ষ, লিগ্যাল সেল, কিউরেটর শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালাসহ সর্বমোট ৯টি দপ্তরের প্রধান কর্মকর্তাদের প্রশাসক বলে অভিহিত করা হয়। ৯টি দপ্তরের মধ্যে শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালা ও লিগাল সেল ছাড়া বাকি সব দপ্তরের দায়িত্বে রয়েছেন শিক্ষকরা।
এছাড়া অধ্যাদেশ অনুযায়ী কর্মকর্তার পদ হলেও রেজিস্ট্রার, কলেজ পরিদর্শক, আইসিটি সেন্টার, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক দপ্তর, মানসিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র, সেন্ট্রাল সায়েন্স ল্যাবরেটরি, শহীদ সুখরঞ্জন সমাদ্দার ছাত্র-শিক্ষক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, শহীদ মীর আব্দুল কাইয়ূম ইন্টারন্যাশনাল ডরমিটরি প্রধান কর্মকর্তার পদগুলোতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সিনিয়র অধ্যাপক মুহম্মদ মিজানউদ্দীন জানান, সত্তরের দশকে তিনি যখন ছাত্র ছিলেন, তখন প্রশাসক বলতে কোনও পদ ছিল না। কিন্তু পরবর্তী সময়ে এটি হয়েছে। পদগুলো সৃষ্টির পেছনে কর্মকর্তাদের অযোগ্যতা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যয় কমানো প্রধান কারণ বলে মনে করেন অধ্যাপক মিজানউদ্দীন। তিনি জানান, ‘১৯৮৩ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ছাত্র উপদেষ্টা পদে শিক্ষক নিয়োগ করা হয়। এরপর থেকে উচ্চপদস্থ সব পদেই শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হচ্ছে।’
তিনি বলছেন, ‘কর্মকর্তাদের নিয়োগের ক্ষেত্রে অধিকাংশ ক্ষেত্রে যোগ্যতার চেয়ে রাজনৈতিক মতাদর্শকে প্রাধান্য দেয়া হয়। নীতিমালার কারণে পদোন্নতি পেয়ে কর্মকর্তারা উচ্চতর পদে চলে যান, কিন্তু উচ্চতর ওই পদের জন্য যে যোগ্যতা প্রয়োজন সেটি অর্জন করেন না। অনেক সময় সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে চিঠিপত্র লিখে পাঠাতে হয়। কিন্তু এ ধরনের চিঠিপত্র লিখতে যে ভাষাগত জ্ঞানের প্রয়োজন, কর্মকর্তাদের তা থাকে না। এছাড়া একজন কর্মকর্তার জন্য যে টাকা প্রয়োজন, একজন শিক্ষককে নিয়োগ করলে তার তুলনায় সামান্য পরিমাণ টাকা দিলেই চলে। বেতনের বাইরে অল্প টাকা সম্মানী দেয়া হয়। এসব বিষয় বিবেচনায় পরবর্তী সময়ে প্রশাসক পদ সৃষ্টি করা হয়েছে।’
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও বর্তমানে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আব্দুল খালেক বলেন, ‘প্রশাসক পদটি অফিসার ক্যাটাগরির। তবে এখানে শিক্ষকদের নিয়োগ দেয়ার কারণ, তারা একজন কর্মকর্তার চেয়ে ওইসব জায়গায় দক্ষ। একজন কর্মকর্তা দিন মাস গণনা ও পরীক্ষার মাধ্যমে পদোন্নতি পেয়ে পদগুলোতে আসেন ঠিকই, কিন্তু প্রশাসকের পদগুলোর জন্য যে যোগ্যতা প্রয়োজন কিংবা দক্ষতার প্রয়োজন, সেটি অধিকাংশ কর্মকর্তার মধ্যে থাকে না। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালনার জন্য উপাচার্য শিক্ষকদের এসব পদে দায়িত্ব দেন।’
তিনি জানান, ‘কোন প্রেক্ষাপটে প্রশাসকের জায়গায় একজন শিক্ষককে নিয়োগ দেন সেটি নির্ভর করে উপাচার্যের ওপর। দেখা যাচ্ছে পদোন্নতির নীতিমালার জন্য একজন কর্মকর্তা পদোন্নতি পেয়ে রেজিস্ট্রার হয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু একজন রেজিস্ট্রারের যে যোগ্যতা ও দক্ষতা থাকার প্রয়োজন, সেটি তার মধ্যে নেই। তাছাড়া একজন কর্মকর্তা যখন পদোন্নতি পেয়ে ডেপুটি রেজিস্ট্রার হন, তখন তার অধীনে থাকা কর্মকর্তারা তার কথা শোনেন না। তারা মনে করেন উনি তাদের মতো কেরানিই ছিলেন। সেজন্য আমার মনে হয় ভাইস চ্যান্সেলররা একজন অধ্যাপককে এসব জায়গায় দায়িত্ব দেন।’
প্রশাসক পদে দায়িত্বরত শিক্ষকদের কাজের দক্ষতা ও কর্মকাণ্ড নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন এর সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা। ২৮ নভেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের একাদশ সমাবর্তন উপলক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে জনসংযোগ দপ্তরের প্রশাসক ও পরিসংখ্যান বিভাগের অধ্যাপক প্রভাষ কুমার কর্মকারের কর্মদক্ষতা নিয়ে সাংবাদিকদের তোপের মুখে পড়েছিলেন উপাচার্য অধ্যাপক এম আব্দুস সোবহান। এছাড়া পরিবহন দপ্তরের প্রশাসক ও উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক এফ এম আলী হায়দার চাকরিপ্রত্যাশীদের কাছ থেকে টাকা নেন বলে ক্যাম্পাসে প্রচার রয়েছে। এছাড়া অনৈতিকভাবে চাকরি দেওয়া সংক্রান্ত একটি ফোনালাপের রেকর্ডিংও ফাঁস হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের অফিসার সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. রাব্বেল হোসেন বলছেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাদেশ অনুযায়ী প্রশাসকের পদগুলো অফিসারদের। কিন্তু এসব পদে অফিসারদের না দিয়ে শিক্ষকদের নিয়োগ দেয়ার মাধ্যমে অফিসারদের বঞ্চিত করা হচ্ছে। সব কর্মকর্তার ইচ্ছা থাকে তিনি তার কাজের দক্ষতা দিয়ে সর্বোচ্চ পদে যাবেন। কিন্তু যখন এসব পদে শিক্ষকদের নিয়োগ দেয়া হয়, তখন কর্মকর্তারা তাদের কাজের আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। শিক্ষকরা একসঙ্গে প্রশাসনিক পদে এবং একাডেমিক কাজ করতে গিয়ে কোনোটিই ভালোভাবে করতে পারছেন না। এছাড়া পদগুলোতে অফিসাররা যেভাবে কাজ করতে পারবেন, শিক্ষকরা সেভাবে পারছেন না।’
সমিতির সভাপতি মোক্তাদির হোসেন রাহী বলছেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে জ্ঞানচর্চার জায়গা। শিক্ষকরা একাডেমিক কাজের বাইরে গিয়ে ব্যক্তিগতভাবে গবেষণা করবেন। কিন্তু একজন শিক্ষক যখন প্রশাসকের দায়িত্বে থাকেন, তখন তিনি একাডেমিক কিংবা প্রশাসকের কাজ কোনোটিই ভালোভাবে করতে পারেন না। এছাড়া একজন শিক্ষক একাডেমিক কাজের বাইরে গিয়ে কর্মকর্তাদের কাজ করলে শিক্ষকের মর্যাদাও ক্ষুণ্ন হয়। আমরাও চাই, শিক্ষকরা একাডেমিক ও গবেষণা কাজেই ব্যস্ত থাকুন। তাদের কর্মকর্তাদের পদে দায়িত্ব দিয়ে শিক্ষকতার মর্যাদা ক্ষুণ্ন করা হচ্ছে।’
অফিসার সমিতির সভাপতির সঙ্গে একমত পোষণ করে সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক মিজানউদ্দীন বলেন, ‘শ্রেণিকক্ষের বাইরে বাড়তি দায়িত্ব পালনের কারণে গবেষণায় কিছুটা হলেও বিঘ্ন ঘটে। এছাড়া প্রশাসক পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে শিক্ষকদের দক্ষতার চেয়ে কতটা উপাচার্যের আস্থাভাজন, সেটি বেশি প্রাধান্য পায়।’
তবে বাড়তি দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে গবেষণায় বিঘ্ন ঘটছে, এমনটি মানতে রাজি নন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আব্দুল খালেক। তিনি মনে করেন, ‘একজন শিক্ষকের জন্য গবেষণা যেমন বড় কাজ, প্রশাসকের কাজও বড়। একটি লাইব্রেরিকে ভালোভাবে চালাতে একজন ভালো প্রশাসকের প্রয়োজন। তবে প্রশাসক হলে যে তিনি গবেষণা করতে পারবেন না, সেটি নয়। যে রাঁধে সে চুল বাঁধতেও জানে।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বললে তারা জানান, প্রশাসক পদে শিক্ষকদের নিয়োগ দেয়ার পেছনে কর্মকর্তাদের অযোগ্যতার চেয়েও বেশি কাজ করছে শিক্ষকদের রাজনীতি। শিক্ষকরা পরস্পরের সঙ্গে সমঝোতার ভিত্তিতে অলিখিত জোট গঠন করেন। ফলে তাদের জোট থেকে যিনি উপাচার্য হন, তিনি তার ঘনিষ্ঠদের বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের বিভিন্ন পদে স্থান দিতেই মূলত প্রশাসক পদ সৃষ্টি করা হয়েছে।
প্রশাসক পদ সৃষ্টির বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার অধ্যাপক এম এ বারী বলেন, ‘অধ্যাদেশ অনুযায়ী উপাচার্য তার ক্ষমতাবলে এসব পদ অধ্যাদেশে যুক্ত করেছেন।’ তবে কবে এটি অধ্যাদেশে যুক্ত করা হয়েছে, সে বিষয়ে বিস্তারিত জানাতে পারেননি রেজিস্ট্রার।
প্রশাসক পদ সৃষ্টির কারণ সম্পর্কে মন্তব্য করতে রাজি হননি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক আনন্দ কুমার সাহা। আরেক উপ-উপাচার্য চৌধুরী মো. জাকারিয়ার বক্তব্যের জন্য তার দপ্তরে কয়েকবার গিয়ে সাক্ষাৎ পাওয়া যায়নি।
কর্মকর্তাদের প্রশাসক প্রথা বাতিল চেয়ে দেয়া স্মারকলিপি ও প্রশাসক পদ সৃষ্টির বৈধতা সম্পর্কে জানতে একাধিকবার উপাচার্য অধ্যাপক এম আব্দুস সোবহানের সঙ্গে মোবাইলফোনে যোগাযোগ করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।