শতভাগ সাক্ষরতা অর্জনে আমাদের চ্যালেঞ্জ

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

একবিংশ শতাব্দীতে একটি রাষ্ট্রের শিক্ষাব্যবস্থার অন্যতম দর্শন হবে একটি জ্ঞাননির্ভর সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে অগ্রগামী হওয়া। সেই অগ্রযাত্রায় রাষ্ট্র প্রচেষ্টা পাবে তার নিজস্ব জাতির জন্য নতুন নতুন জ্ঞান সৃষ্টি করে ওই সৃষ্ট জ্ঞান মূলধনে পরিণত করে বিশ্বায়নের যুগে জাতি হিসেবে নিজের স্বকীয়তা প্রতিষ্ঠিত করার। সেই বিবেচনায় আমরা এখনও যুদ্ধ করছি শতভাগ সাক্ষরতা অর্জনের জন্য। আনুষ্ঠানিক, উপানুষ্ঠানিক কখনও-বা বেসরকারি ব্যক্তি কিংবা প্রতিষ্ঠান সর্বমুখী প্রচেষ্টা চালিয়েও আমরা পৌঁছতে পারিনি আমাদের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে। কিন্তু আশার কথা হলো, এ রাষ্ট্র সাংবিধানিক ধারামতে (১৭ ক, খ, গ) দায়বদ্ধতা গ্রহণ করেছে যে, বাংলাদেশের ভৌগোলিক সীমানার মধ্যে বসবাসরত বৈধ সব নাগরিককে নূ্যনতম মৌলিক শিক্ষা নিশ্চিত করবে রাষ্ট্র নির্ধারিত একটি সময়সীমার মধ্যে। সে লক্ষ্যে বাংলাদেশ স্বাক্ষর করেছে বহু আন্তর্জাতিক প্রত্যাশা ও চুক্তিপত্রে। বৃহস্পতিবার (৩ অক্টোবর) সমকাল পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়। 

১৯৯০ খ্রিষ্টাব্দের শিক্ষাবিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলনের পর থেকেই বাংলাদেশ সরকার নিরক্ষরতা দূরীকরণের প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। সবার জন্য শিক্ষা বাস্তবায়নের কৌশল হিসেবে আনুষ্ঠানিক সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষার পাশাপাশি উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার মাধ্যমে প্রশাসন, কমিউনিটির জনগণ, এনজিও, উন্নয়ন সহযোগী, সরকারের অন্যান্য প্রতিষ্ঠান, এমনকি ব্যক্তি পর্যায়ের উদ্যোগকেও স্বীকৃতি জানানো হয়েছে। কিন্তু স্বাধীনতার ৪৮ বছর এবং জমতিয়েন সম্মেলনের ২৯ বছর পার হলেও আমরা সাক্ষরতা অর্জনের ক্ষেত্রে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারিনি। ২০১৯-এর তথ্যমতে, বাংলাদেশের সাক্ষরতার হার ৭৩ দশমিক ৯ শতাংশ।

বাংলাদেশ রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এসডিজির একজন স্বাক্ষরকারী সদস্য হিসেবে ২০৩০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে এ দেশে 'অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সমতাভিত্তিক মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা এবং সবার জন্য জীবনব্যাপী শিক্ষার সুযোগ তৈরি করার' লক্ষ্য পূরণ করতে। তার জন্য সরকার অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। দেশের প্রচলিত আনুষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থার সম্পূরক ও পরিপূরক হিসেবে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষাধারা রাষ্ট্রের সহায়ক শক্তি হিসেবে ব্যাপক মাত্রায় এ দেশে কাজ করে যাচ্ছে। তারপরও উপানুষ্ঠানিক শিক্ষাধারা এ দেশে বহুমাত্রীয় চ্যালেঞ্জ রয়েছে। সে জন্য রাষ্ট্রের সরকারি, বেসরকারি, আন্তর্জাতিক, স্থানীয় ও ব্যক্তি পর্যায়ের সামগ্রিক সম্মিলিত প্রচেষ্টা আরও ত্বরান্বিত করার তাড়না বহুগুণে বাড়িয়ে দেওয়ার সময় এসেছে একবিংশ শতাব্দীর গোড়াতেই। না হলে আমরা পিছিয়ে পড়ব রাষ্ট্র হিসেবে।

এ বছর ৮ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবসের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল- বহু ভাষায় সাক্ষরতা; উন্নত জীবনের নিশ্চয়তা। সাক্ষরতা উন্নত জীবনের প্রথম সোপান। বিশ্বায়ন ও প্রযুক্তি বিপ্লবের এই যুগে শুধু মাতৃভাষায় সাক্ষরতা উন্নয়নে প্রতিবন্ধকতা হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে। তাই একের অধিক ভাষা বা বহু ভাষা রপ্ত করা আজ সময়ের দাবি।

আমরা দেখব, স্বাধীনতা-উত্তর সবার জন্য শিক্ষা অর্জনে বাংলাদেশ কতদূর এগিয়েছে কিংবা তার প্রধান অন্তরায়ই-বা কোথায়? বাংলাদেশ সরকার তার জাতীয় পরিকল্পনায় অর্থাৎ সর্বশেষ সপ্তম-পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় (২০১৬-২০২০) 'উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ও বয়স্ক সাক্ষরতা' শিরোনামে চারটি লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। ৩২.৫ মিলিয়ন নিরক্ষরকে সাক্ষরতা প্রদান করা; প্রতিটি ইউনিয়নে কমপক্ষে একটি ও কিছু শহর এলাকায় মোট ৫০২৫টি কমিউনিটি লার্নিং সেন্টার প্রতিষ্ঠা করার মাধ্যমে আইসিটিভিত্তিক অব্যাহত ও জীবনব্যাপী শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করা; মৌলিক সাক্ষরতা প্রকল্পের আওতায় সাক্ষরতা অর্জনকারী ৫ মিলিয়ন নব্য সাক্ষরকে কার্যকর দক্ষতা প্রশিক্ষণ প্রদান করা এবং উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা বোর্ড প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু সপ্তম-পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় সমগ্র শিক্ষা খাতে জিডিপির ২ দশমিক ৮ শতাংশ বরাদ্দ রাখা হয়েছে, যা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল এবং একই সঙ্গে লক্ষ্য অর্জনের পথে বাধা সৃষ্টি করবে। অথচ ইউনেস্কো শিক্ষা খাতে জিডিপির ৬ শতাংশ বরাদ্দের বেঞ্চমার্ক ঠিক করেছে। চলতি (২০১৯-২০) অর্থবছরে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে মাত্র ২৪,০৪০ কোটি টাকা (ডেইলি স্টার, ১ জুলাই ২০১৯), যা সমগ্র মন্ত্রণালয়াধীন অধিদপ্তর ও অন্যান্য অফিসের জন্য বরাদ্দ। গভীর বিশ্নেষণে না গেলেও বোঝা যায়, এ বরাদ্দ প্রকৃতপক্ষে প্রয়োজনের তুলনায় কতটা অপ্রতুল! তাছাড়া অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, এ রাষ্ট্রে এখনও রয়ে গেছে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার প্রত্যয়গত ধারণার সীমাবদ্ধতা। উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ধারণায় সীমাবদ্ধতার সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষা সংক্রান্ত বেশ কিছু বাংলা প্রত্যয় ব্যবহারেও রয়েছে আমাদের বিভ্রান্তি। যেমন- শিক্ষা পরিস্থিতি বোঝাতে ইংরেজি 'সাক্ষরতার হার' ব্যবহার না করে 'শিক্ষার হার' ব্যবহার করা, ইংরেজি লিটারেসি শব্দের বাংলা বানানে সমস্যা বা বিভ্রান্তি, উপানুষ্ঠানিক শিক্ষাকে মনে করা শুধু 'এনজিওভিত্তিক শিক্ষা' ইত্যাদি।

বাংলাদেশে সাক্ষরতার হার নিয়েও রয়েছে বিভ্রাট। সরকারি ও বেসরকারিভাবে প্রকাশিত তথ্যের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ব্যবধান পরিস্কারভাবে বিদ্যমান। সে কারণে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রকাশযোগ্য রাষ্ট্রের উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার একটি নির্ভরযোগ্য তথ্য কোষ গড়ে তুলতে হবে, যাতে করে প্রকৃত পরিসংখ্যান প্রকাশ করা সম্ভব হবে। তাতে রাষ্ট্র তার প্রয়োজনে প্রকৃত তথ্যনির্ভর ভবিষ্যৎমুখী উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা কর্মসূচি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হবে।

বাংলাদেশের উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত ও বাস্তবায়িত হয় প্রধানত প্রকল্পভিত্তিক, তাতে করে প্রকল্প সমাপ্ত হওয়ামাত্র নতুন প্রকল্প প্রস্তাবিত, অনুমোদন ও বাস্তবায়ন হয়। অনেক ক্ষেত্রে একটি প্রকল্পের সঙ্গে নতুন প্রকল্পের যোগসূত্র থাকে না। ফলে বিক্ষিপ্ত এসব প্রকল্পের মাধ্যমে জাতীয় পর্যায়ের সমন্বিত উন্নয়ন অধিকাংশ সময়েই ব্যাহত হয়। তাছাড়া বিভিন্ন বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলো তাদের সাহায্যকারী সংস্থার চাহিদা অনুযায়ী উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা প্রকল্প প্রস্তাবনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করছে। যে কারণে অনেক ক্ষেত্রে একই প্রকল্পের একাধিক পুনরাবৃত্তি হচ্ছে বিভিন্ন সংস্থাভেদে। এ ক্ষেত্রে সরকারকে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার প্রকল্পভিত্তিক কৌশল থেকে দেশের জাতীয় চাহিদা অনুযায়ী ব্যাপক কার্যক্রমভিত্তিক কর্মসূচি হাতে নিতে হবে। একই সঙ্গে দেশের মধ্যে পরিচালিত সব বেসরকারি, স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থার কার্যক্রমের মধ্যে কেন্দ্রীয়ভাবে সমন্বয় সাধনের নিমিত্তে সরকারকে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার কেন্দ্রীয় সমন্বয় কোষ স্থাপন করে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালনে উদ্যোগী হতে হবে।

পরিশেষে বলা যায়, উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার একটি নতুন প্রজ্ঞাবান চেতনা, ধারণা ও কৌশল সমাজে প্রতিষ্ঠা করতে গেলে তার যেমন ঝুঁকি থাকে, ঠিক সমমাত্রায় তার সফলতার সম্ভাবনাও অনেক বেশি থাকে। এ জন্য শুধু প্রয়োজন শিক্ষার পরিবর্তনমুখী নেতৃত্ব, যারা পরিবর্তন ব্যবস্থাপনায় আগামী দিনের নির্দেশনা দিতে বদ্ধপরিকর।

 

লেখক: ড. মো. আবদুস সালাম (অধ্যাপক) ও সৈয়দা আতিকুন নাহার (সহযোগী অধ্যাপক), শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

 


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
শুক্রবার স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত হয়নি, জানালো শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha শুক্রবার স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত হয়নি, জানালো শিক্ষা মন্ত্রণালয় স্কুল-কলেজ শিক্ষকদের এপ্রিল মাসের এমপিওর চেক ছাড় - dainik shiksha স্কুল-কলেজ শিক্ষকদের এপ্রিল মাসের এমপিওর চেক ছাড় গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটে প্রথম লামিয়া - dainik shiksha গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটে প্রথম লামিয়া প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে দ্বিতীয় ধাপের চূড়ান্ত ফল আগামী সপ্তাহ - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে দ্বিতীয় ধাপের চূড়ান্ত ফল আগামী সপ্তাহ ছাত্রলীগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিলিস্তিনের পতাকা উড়াবে কাল - dainik shiksha ছাত্রলীগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিলিস্তিনের পতাকা উড়াবে কাল চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ করার বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রী যা জানালেন - dainik shiksha চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ করার বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রী যা জানালেন গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ, পাস ৩৬.৩৩ শতাংশ - dainik shiksha গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ, পাস ৩৬.৩৩ শতাংশ কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0043821334838867