শিক্ষার রূপান্তর সময়ের দাবি

অধ্যাপক মিজানুর রহমান মজুমদার |

প্রতিবারের মত এবারও ৫ অক্টোবর বিশ্ব শিক্ষক দিবস পালিত হচ্ছে।

১৯৬৬ খ্রিষ্টাব্দের ৫ অক্টোবর প্যারিসে শিক্ষকের মর্যাদা সংক্রান্ত আন্তঃসরকার সম্মেলনে ইউনেস্কো এবং আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা শিক্ষকদের অধিকার, দায়িত্ব এবং মর্যাদা সম্পর্কে একটি যৌথ সুপারিশনামা প্রণয়ন করে। ওইদিনকে বিশেষভাবে স্মরণীয় করে রাখার জন্য ১৯৯৪ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ৫ অক্টোবর বিশ্ব শিক্ষক দিবস উদযাপন করে আসছে। ১৯৯৭ খ্রিষ্টাব্দে অনুষ্ঠিত আইএলও-ইউনেস্কো যৌথ বিশেষজ্ঞ কমিটির সভায় উচ্চশিক্ষায় নিয়োজিত শিক্ষকদের জন্য একটি সুপারিশমালা গৃহীত হয়। উক্ত সুপারিশমালায় শিক্ষকতা পেশাকে সম্মানজনক অবস্থানে নেয়াসহ শিক্ষক প্রশিক্ষণ, নিয়োগ ও পদোন্নতি, দায়িত্ব ও অধিকার, চাকরির নিরাপত্তা, শৃঙ্খলা বিধানের প্রক্রিয়া, পেশাগত স্বাধীনতা, কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন, শিক্ষাসংক্রান্ত নীতিনির্ধারণী প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ, কার্যকর শিক্ষাদান ও শিখনের পরিবেশ এবং সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। দিবসটি উপলক্ষে প্রতি বছর একটি প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়। এবারের বিশ্ব শিক্ষক দিবসের  মূল প্রতিপাদ্য হলো: The transformation of education begins with teachers. প্রতিপাদ্যের ভাষান্তর করা হয়েছে- ‘শিক্ষকদের দিয়েই শিক্ষায় রূপান্তর শুরু’। শিক্ষার রূপান্তর একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। 

বিশেষতঃ মানুষের আর্থসামাজিক উন্নয়নের সাথে সাথে শিক্ষর রূপান্তর অনিবার্য। কোভিড-১৯ সারা বিশ্বের মত বাংলাদেশেও শিক্ষা ব্যবস্থায় নীতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। দীর্ঘদিন শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর সরাসরি শ্রেণিকক্ষে পাঠদান সম্ভব হয়নি। ফলে যে গ্যাপ তৈরি হয়েছে, তা কীভাবে পুষিয়ে নেয়া যাবে, সে বিষয়ে ভাবতে হবে। শিক্ষার রূপান্তরের মাধ্যমে অতীতের ক্ষতি পুষিয়ে সামনে এগিয়ে নেয়া হচ্ছে চ্যালেঞ্জ। শিক্ষার সাথে সংশ্লিষ্ট শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক, শিক্ষা সংশ্লিষ্ট সকলকে এ বিষয়ে সম্মিলিত ভাবে কাজ করতে হবে। সরকারের একার পক্ষে এ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা সম্ভব নয়। বর্তমানে আমাদের দেশে প্রায় ৫ কোটি শিক্ষার্থী রয়েছে। বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থীকে এ বিষয়ে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে মানবসম্পদে রূপান্তরিত করতে শিক্ষকরা প্রধান ভূমিকা পালন করবেন। এজন্য প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে কাঙিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছাতে হলে চলমান শিল্পবিপ্লব ও কোভিড-১৯ পরবর্তী বিশ্ব ব্যবস্থার সাথে খাপ খাইয়ে নিতে শিক্ষার মানোন্নয়নের বিকল্প নেই। শিক্ষার্থীদের সৃষ্টিশীলতা ও বিশ্লেষণী চিন্তার উন্মেষ ঘটিয়ে ভবিষ্যৎ উপযোগী দক্ষ ও আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করতে শিক্ষকের ভূমিকা প্রধান। সুতরাং আগামী শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় শিক্ষকদের উপযোগী করে গড়ে তুলতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রশিক্ষন ও রূপান্তর জরুরি। 

গতকাল আজকের মত নয়। আবার আগামী কালেও আজকের মত হবে না। তাই কোভিড-১৯ পরবর্তী বিরূপ পরিস্থিতিতে শিক্ষা কারিকুলাম আধুনিক ও যুগোপযোগী করতে হবে। সরকার ইতিমধ্যে নতুন শিক্ষাক্রম প্রণয়ন করেছে। কিন্তু এ বিষয়ে সকলের মতামতের ভিত্তিতে তা প্রণীত হওয়া বাঞ্ছনীয়। বিশেষ করে শিক্ষা সংশ্লিষ্টদের সম্পৃক্ত করে ভবিষ্যৎ পরিবর্তনশীল পৃথিবীর সাথে সামঞ্জস্য রেখে শিক্ষাক্রম প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে। আমাদের নৈতিক মূল্যবোধসম্পন্ন, দক্ষ ও দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ সুনাগরিক গড়ে তুলতে হবে।  

এসডিজি ৪ এর লক্ষ্য সবার জন্য একীভূত এবং সমতাভিত্তিক মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিতকরণ এবং জীবনব্যাপী শিক্ষার সুযোগ প্রসারকে (Ensure inclusive and equitable quality education and promote lifelong learning for all) বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে শিক্ষকদের কার্যকর নেতৃত্বে ভূমিকা পালন এ সচেতনতা বৃদ্ধি করা। ড. কুদরত-ই-খোদা শিক্ষা কমিশনের আলোকে অসাম্প্রয়দায়িক, বিজ্ঞানমনস্ক, বিশ্বমানের শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তনের লক্ষ্যে ২০১০ খ্রিষ্টাব্দের প্রণীত জাতীয় শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের মাধ্যমে শিক্ষার মানোন্নয়ন সাধন করা। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শিক্ষার উন্নয়নের কথা চিন্তা করে প্রাথমিক শিক্ষাকে জাতীয়করণ করেছিলেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা তারই ধারাবাহিকতায় শিক্ষার মানোন্নয়নে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন।  বাংলাদেশ ২০৪১ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে উন্নত বিশ্বের কাতারে শামিল হতে যাচ্ছে। এ লক্ষ্যে আমাদের যে মানবসম্পদ প্রয়োজন, তা তৈরির লক্ষ্যে আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষিত যুবসমাজ প্রয়োজন। ফলে সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার প্রসার ঘটিয়ে তাকে আমাদের জন্য প্রস্তুত করতে হবে। এবারের বিশ্ব শিক্ষক দিবস পালনের মাধ্যমে শিক্ষকদের ক্ষমতায়ন, নেতৃত্ব বিকাশ, প্রয়োজনীয় শিক্ষক নিয়োগ ও যথাযথ সম্মানী প্রদান, সরকারের নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে শিক্ষকদের অংশগ্রহণের মাধ্যমে সবার জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সমতাভিত্তিক, মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিতকরণ এবং জীবনব্যাপী শিক্ষার সুযোগ তৈরি করবে বলে আমাদের বিশ্বাস। সর্বোপরি শিক্ষা ব্যবস্থার জাতীয়করণের মাধ্যমে শিক্ষার সকল বৈষম্য দূরীকরণ সম্ভব। 
 
লেখক : অধ্যাপক মিজানুর রহমান মজুমদার, যুগ্ম সম্পাদক, বাংলাদেশ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ও ট্রাস্টিবোর্ড মেম্বার বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শিক্ষক-কর্মচারী কল্যাণ ট্রাস্ট, শিক্ষা মন্ত্রণালয়।  


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
রোববার থেকে সরকারি প্রাথমিকে মর্নিং স্কুল, খোলার প্রজ্ঞাপন জারি - dainik shiksha রোববার থেকে সরকারি প্রাথমিকে মর্নিং স্কুল, খোলার প্রজ্ঞাপন জারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শনিবারের ছুটি বহাল থাকছে - dainik shiksha প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শনিবারের ছুটি বহাল থাকছে ফের আন্দোলনের হুশিয়ারি চুয়েট শিক্ষার্থীদের - dainik shiksha ফের আন্দোলনের হুশিয়ারি চুয়েট শিক্ষার্থীদের গরমে কলেজে কোচিং, দুদিনে অসুস্থ ৮ ছাত্রী - dainik shiksha গরমে কলেজে কোচিং, দুদিনে অসুস্থ ৮ ছাত্রী কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে নিবন্ধিত শিক্ষক নিয়োগে এনটিআরসির নতুন নির্দেশনা - dainik shiksha নিবন্ধিত শিক্ষক নিয়োগে এনটিআরসির নতুন নির্দেশনা দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে জাল সনদে চাকরি করছে কয়েক হাজার হেলথ টেকনোলজিস্ট - dainik shiksha জাল সনদে চাকরি করছে কয়েক হাজার হেলথ টেকনোলজিস্ট ফের আন্দোলনের হুশিয়ারি চুয়েট শিক্ষার্থীদের - dainik shiksha ফের আন্দোলনের হুশিয়ারি চুয়েট শিক্ষার্থীদের আইনি লড়াইয়ে যাচ্ছেন শিক্ষক নেতা কাওছার শেখ - dainik shiksha আইনি লড়াইয়ে যাচ্ছেন শিক্ষক নেতা কাওছার শেখ please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0053699016571045