শিক্ষা-গবেষণা খাতে আরো মনোযোগ চাই

শহিদুল ইসলাম |

শিক্ষা ও গবেষণা খাতে সবচেয়ে কম বরাদ্দ করে বাংলাদেশ। এসকাপের জরিপে (২০১৮) দেখা যায়, শিক্ষা খাতে বাংলাদেশ জিডিপির প্রায় ২ শতাংশ ব্যয় করে, যা এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ৫২টি দেশের মধ্যে সবচেয়ে কম। পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে কম ব্যয় করে কম্বোডিয়া। তার পরই বাংলাদেশ। পাকিস্তান ব্যয় করে জিডিপির ২.৬ শতাংশ, ভারত ৩.৮ শতাংশ, নিউজিল্যান্ড ৬ শতাংশ। সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী জাতীয় সংসদে ২০১৮-১৯ অর্থবছরের সে বাজেট ঘোষণা করেছেন, সেখানে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ টাকার অঙ্কে বাড়লেও মোট বাজেটে এ দুই খাতে বরাদ্দ কমেছে। সার্ক দেশগুলোর মধ্যে এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সবার পেছনে।

নতুন বাজেটে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ১১.৪ শতাংশ। এটা চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেট বরাদ্দের  চেয়েও কম। শিক্ষা খাতে ২০১৭-১৮  অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে দেওয়া হয়েছে ১২.৬ শতাংশ। নতুন বাজেটে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে জিডিপির অনুপাতে ২.০৯ শতাংশ। বিগত চারটি বাজেটের চেয়ে এটা সর্বনিম্ন। সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় শিক্ষা খাতে জিডিপির অনুপাতে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ২.৮৪ শতাংশ বরাদ্দ করার কথা বলা হয়েছিল। সিপিডি জানিয়েছে, শিক্ষা খাতে মোট ব্যয় ৫৩ হাজার ৫০৪ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে। শিক্ষা খাতে এত কম বরাদ্দ দিয়ে উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশ হওয়া এবং দক্ষ শ্রমশক্তি নির্মাণ স্বপ্ন ছাড়া কিছু নয়।

দুই.

১৯৯৫ খ্রিস্টাব্দে বিশ্বব্যাংক ১৯২টি দেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক পর্যালোচনা শেষে যে সিদ্ধান্ত জানিয়েছিল তা হলো, ‘বিশ্বে মোট সম্পদের বিভিন্ন ধরনের পুঁজির অবদান হলো ভৌত পুঁজি ১৬ শতাংশ, প্রাকৃতিক পুঁজি ২০ শতাংশ এবং মানব ও সামাজিক পুঁজি ৬৪ শতাংশ।’ অর্থাৎ পৃথিবীর যেকোনো দেশে সম্পদ সৃষ্টিতে মানব ও সামাজিক পুঁজির অবদান সবচেয়ে বেশি। তাই মানব ও সামাজিক পুঁজি গঠনে অগ্রসরমাণ বিনিয়োগের কোনো বিকল্প নেই। তবে ১৯৯৫ খ্রিস্টাব্দের পর মানব ও সামাজিক পুঁজির অবদান যে আরো বেড়েছে, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কিভাবে মানব ও সামাজিক পুঁজি বাড়ানো যেতে পারে? মানসম্মত শিক্ষা ও উন্নত স্বাস্থ্যের মাধ্যমেই সে সম্পদ বৃদ্ধি হতে পারে। তাই আমরা দেখছি, সার্কভুক্ত দেশগুলো শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে আমাদের চেয়ে বেশি বরাদ্দ দিচ্ছে। দেশের উন্নয়ন একান্তভাবেই নির্ভর করে মানসম্পন্ন শিক্ষার ওপর। শিক্ষার মাধ্যমেই মানুষ সম্পদে পরিণত হয়। সে জন্য চাই শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বাজেটে অধিক বরাদ্দ।

শিক্ষা আজ এক মৌলিক অধিকারে পরিণত হয়েছে। ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে গৃহীত মানবাধিকার সনদের ২৬ নম্বর ধারায় ঘোষণা দেওয়া হয়েছে, ‘শিক্ষা মানুষের মৌলিক অধিকার। প্রাথমিক ও মৌলিক স্তর পর্যন্ত শিক্ষা হবে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক।’ ১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে শিশু অধিকার সনদের ৭ নম্বর ধারায় একই কথা বলা হয়েছে। ‘সব শিশুর শিক্ষা পাওয়ার অধিকার আছে; যা হবে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক, কমপক্ষে প্রাথমিক স্তরে।’ ১৯৮৭ খ্রিস্টাব্দে ‘এশিয়া প্যাসিফিক প্রগ্রাম অব এডুকেশন ফর অল’ (APPEAL) নামে এক কর্মপন্থা গ্রহণ করা হয়। ওই বছর ২৩ ফেব্রুয়ারি নয়াদিল্লিতে আনুষ্ঠানিকভাবে তার কাজ শুরু হয়। জাতিসংঘের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দ ‘আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা বছর’ হিসেবে পালিত হয়। তার মূল স্লোগান ছিল—এক. নিরক্ষরতা বর্তমানে প্রধান ভূমণ্ডলীয় সমস্যা, দুই. নিরক্ষরতা প্রধানত অনুন্নয়ন ও দারিদ্র্যের সঙ্গে সম্পর্কিত। সুতরাং নিরক্ষরতা দূরীকরণ উন্নয়ন ও মানুষের কল্যাণের প্রধান শর্ত এবং তিন. নিরক্ষরতা কোনো জাতি বা রাষ্ট্রের ভাগ্য বা পূর্বনির্ধারিত কোনো বিষয় নয়, যা দূর করা যায় না। সমাজ বিবর্তনের পথে এটা একটা অবস্থা। আন্তরিকতা ও দূরদৃষ্টি নিয়ে লেগে থাকলে তা দূর করা সম্ভব এবং দূর করা হচ্ছেও।’

‘এপিল’ গঠনের তিন বছরের মাথায় ‘সবার জন্য শিক্ষা’ নামের বিশ্ব সম্মেলনে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে বিভিন্ন দেশে শিশুরা বিভিন্ন পদ্ধতিতে প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করে। একই দেশে বিভিন্ন ধরনের প্রাথমিক শিক্ষা চালু আছে। কিন্তু সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, ‘যেভাবেই দেওয়া হোক প্রাথমিক শিক্ষা হবে সবার জন্য সমান ও একমুখী।’ এটা কার্যকর করার জন্য ২০০০ খ্রিস্টাব্দে সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়।

১৯৯২ খ্রিস্টাব্দে জাতিসংঘের ‘ইউনেসকো’ সিদ্ধান্ত নেয় যে শিক্ষা ও গবেষণা খাতে জিডিপির ৭ শতাংশ অর্থ বরাদ্দ করতে হবে। ৬ শতাংশ শিক্ষা এবং ১ শতাংশ গবেষণা খাতে।

তিন.

বাংলাদেশ জাতিসংঘ ও ইউনেসকোর সদস্য একটি দেশ। ওই সব সিদ্ধান্তে স্বাক্ষরদাতা। কাজেই সেগুলো বাস্তবায়ন করা বাংলাদেশ সরকারের নৈতিক দায়িত্ব। কিন্তু জিডিপির মাত্র ২ শতাংশ শিক্ষা ও গবেষণা খাতে ব্যয় করে দেশকে উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করা সোনার পাথরবাটির স্বপ্ন দেখা ছাড়া আর কিছু নয়। নির্বাচন সামনে রেখে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল অলীক স্বপ্ন দেখাচ্ছে। জনগণকে নানাভাবে প্রলোভিত করার চেষ্টা পরিলক্ষিত হচ্ছে। সবাই দেশের অগ্রগতির আশ্বাস দিচ্ছে। কিন্তু যদি শিক্ষা, গবেষণা ও স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি না করে, তাহলে নির্বাচনের পর তাদের সে আশ্বাসের অন্তঃসারশূন্যতা প্রমাণিত হতে বিলম্ব হবে না।

 

লেখক : সাবেক অধ্যাপক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

 

সৌজন্যে: কালের কণ্ঠ


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
কাল থেকে শিক্ষা বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী চলবে সব প্রাথমিক বিদ্যালয় - dainik shiksha কাল থেকে শিক্ষা বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী চলবে সব প্রাথমিক বিদ্যালয় বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার মান বাড়ানোর নির্দেশ রাষ্ট্রপতির - dainik shiksha বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার মান বাড়ানোর নির্দেশ রাষ্ট্রপতির ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার দাবিতে দেশজুড়ে সংহতি সমাবেশ - dainik shiksha ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার দাবিতে দেশজুড়ে সংহতি সমাবেশ সব মাদরাসার ওয়েবসাইট ও তথ্য হালনাগাদের নির্দেশ - dainik shiksha সব মাদরাসার ওয়েবসাইট ও তথ্য হালনাগাদের নির্দেশ অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা অবৈতনিক : দুই মন্ত্রণালয় যা করবে - dainik shiksha অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা অবৈতনিক : দুই মন্ত্রণালয় যা করবে নার্সিং-মিডওয়াইফারি ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ - dainik shiksha নার্সিং-মিডওয়াইফারি ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ শুক্রবার স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত হয়নি, জানালো শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha শুক্রবার স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত হয়নি, জানালো শিক্ষা মন্ত্রণালয় সিনিয়র আইনজীবীরা বিচার বিভাগের স্বার্থে কথা বলবেন, আশা প্রধান বিচারপতির - dainik shiksha সিনিয়র আইনজীবীরা বিচার বিভাগের স্বার্থে কথা বলবেন, আশা প্রধান বিচারপতির দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0029981136322021