শিক্ষা বাজেটে বেসরকারি শিক্ষা খাতের বিভাজন আলাদাভাবে দেখানো হোক

অধ্যক্ষ এস এম খায়রুল বাসার |

আমাদের দেশে বাজেট পেশের ক্ষেত্রে ২৮টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ কার্যক্রমকে যুক্ত করে শিক্ষা বাজেটের মোট বরাদ্দ দেখানো হয়। বাজেট বরাদ্দে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগকে যুক্ত করে দেখিয়ে টাকার অঙ্ক বেশি দেখানো হয়। অথচ খাতওয়ারি এবং বিভাগ ও মন্ত্রণালয়ওয়ারী বরাদ্দের মধ্যে পর্যালোচনা করলে সরাসরি শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দকৃত অর্থের সাথে অন্যান্য মন্ত্রণালয় ও বিভাগের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ কার্যক্রমের কোনো যোগসূত্র পাওয়া যায় না। অন্যদিকে, মোট বাজেটের পরিমাণ বড় হওয়ার কারণে শিক্ষায় বরাদ্দের পরিমাণ বাড়লেও বাড়ছে না বরাদ্দের আনুপাতিক হার।

চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটে ২৮টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে দায়িত্ব দিয়ে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ কার্যক্রমকে যুক্ত করে শিক্ষা বাজেটে মোট ৮৭ হাজার ৬২০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে যা মোট বাজেট বরাদ্দের ১৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ। এটা জিডিপির ৩ দশমিক ০৪ শতাংশ। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ বাদ দিলে মোট অর্থের পরিমাণ দাঁড়ায় ৬১ হাজার ১১৮ কোটি টাকা। শিক্ষা খাতের বরাদ্দ দাঁড়াচ্ছে মোট বাজেটের ১১ দশমিক ৬৮ শতাংশ ও জিডিপির মাত্র ২ দশমিক ১ শতাংশ। যা আগের বছরের বাজেটের চেয়ে শতাংশের হিসাবে মাত্র ০ দশমিক ০৯ শতাংশ বেশি। 

এর মধ্যে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অনুকূলে বরাদ্দের পরিমাণ ২৪ হাজার ৪০ কোটি টাকা। মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ এবং কারিগরি ও মাদরাসা বিভাগের সমন্বয়ে গঠিত শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অনুকূলে বরাদ্দের পরিমাণ ৩৭ হাজার ৭৮ কোটি টাকা। যা মোট বাজেটের ৭ দশমিক ১০ শতাংশ। এমনিতেই শিক্ষার লক্ষ্য অর্জনের জন্য পরিমিত মানের সাথে সঙ্গতি রেখে শিক্ষা খাতে জাতীয় বাজেটের কমপক্ষে ২০ ভাগ এবং জিডিপির ৬ ভাগ ব্যবহার করা হয় না বাংলাদেশে।

তদুপরি শিক্ষা খাতে যে  বরাদ্দ দেওয়া হয় সেই বরাদ্দের মধ্যেও বৈষম্যও বিরাজমান। দেশের ৯৭ শতাংশ শিক্ষাব্যবস্থা বেসরকারি ব্যবস্থাপনা নির্ভর। অথচ অনুপাত অনুযায়ী শিক্ষা বাজেটের বরাদ্দকৃত অর্থের ৯৭ ভাগ বেসরকারি শিক্ষা ব্যবস্থার পেছনে ব্যয় করা হয় না। বেসরকারি শিক্ষা খাতে প্রায় ১০ লাখ শিক্ষক-কর্মচারী কর্মরত আছেন। জাতি গঠন এবং সরকারে উন্নয়নে এরা অংশীদার। অথচ সরকারি-বেসরকারি শিক্ষকদের মধ্যে বেতন-ভাতা বৈষম্য চরম। বেসরকারি এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীরা কেবল স্কেলের মূল বেতনটুকুই সরকারিদের সমান পেয়ে থাকেন। বাকি সব ভাতা ও সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে বৈষম্যে আছেন তাঁরা। 
এমপিওভুক্ত বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধান থেকে পিয়ন পর্যন্ত বাড়ি ভাড়া পান মাত্র ১০০০ টাকা, যা দিয়ে দেশের কোথাও বাড়ি ভাড়া পাওয়া সম্ভব নয়। চিকিৎসা ভাতা পান ৫০০ টাকা যা দিয়ে পরিবারের সদস্যদের ডাক্তারের ফি-ই মেটানো সম্ভব নয়। অথচ ৩ ভাগ শিক্ষার্থী পড়ানো সরকারি শিক্ষকবৃন্দ বাড়ি ভাড়া পান বেতনের ৪৫ শতাংশ থেকে ৫০ শতাংশ, চিকিৎসা ভাতা পান ১৫০০ -২০০০ টাকা। সরকারি শিক্ষকরা মূল বেতনের শতভাগ উৎসব ভাতা হিসেবে পেলেও বেসরকারি শিক্ষকরা পান মূল বেতনের মাত্র ২৫ ভাগ আর কর্মচারীরা ৫০ ভাগ অর্থ। সরকারি শিক্ষকরা এছাড়া আরও অন্যান্য সুবিধা পেয়ে থাকেন।

আগে এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীরা টাইম স্কেল পেতেন। তাও পুরো চাকরি জীবনে মাত্র দুবার। বর্তমানে টাইম স্কেলটিও বন্ধ। এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের সঙ্গে কোনো ধরনের আলোচনা ছাড়াই শিক্ষক-কর্মচারী কল্যাণ ট্রাস্ট ও অবসর সুবিধা বোর্ডে অতিরিক্ত ৪ শতাংশ কেটে নেয়া শুরু হয়েছে যা মোটেও কাম্য নয়। বেসরকারি শিক্ষকদের মাঝে আবার রয়েছে এমপিও বনাম নন-এমপিও-প্রাইভেট বিভেদ।

বছরের পর বছর এ বৈষম্য চলছে। সঠিক পরিকল্পনা এবং শিক্ষাখাতে প্রয়োজনীয় বরাদ্দ না থাকায় বৈষম্যের  প্রতিকার মিলছে না। অবশ্য গোটা শিক্ষাব্যবস্থা সরকারিকরণ ছাড়া এই বৈষম্য দূর করা সম্ভব নয়। যতদিন গোটা শিক্ষাব্যবস্থা সরকারিকরণ না হচ্ছে, ততদিন শিক্ষা বাজেটে ৯৭ ভাগ শিক্ষার্থীদের পাঠদানকারী বেসরকারি শিক্ষাখাতের বরাদ্দের বিভাজন আলাদাভাবে প্রদর্শন করা হোক। যেখানে প্রদর্শিত হবে বেসরকারি শিক্ষা খাতের অবকাঠামোগত উন্নয়ন বরাদ্দের হিসাব, বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতার হিসাব, বাড়ি ভাড়া, চিকিৎসা ভাতা, উৎসব ভাতা, ইনক্রিমেন্ট, প্রশিক্ষণ বাবদ বরাদ্দের হিসাব ইত্যাদি, ইত্যাদি। তাহলে আমরা বুঝতে পারব বেসরকারি শিক্ষাব্যবস্থার পেছনে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বাজেটের কত অংশ ব্যয় করা হয়ে থাকে। সাথে সাথে সরকারি-বেসরকারি খাতের অবদান অনুযায়ী শিক্ষা বাজেটের অর্থ বেসরকারি শিক্ষা খাতে বরাদ্দ করা হোক আসন্ন ২০২০-২০২১ অর্থবছরের বাজেট থেকেই। বাজেট অধিবেশনের সময় অতি সন্নিকটে। সংক্ষিপ্ত সময়ে তাই কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করছি।

লেখক : এস এম খায়রুল বাসার, অধ্যক্ষ, পল্লীমঙ্গল আদর্শ মহাবিদ্যালয়, ইছামতি, অভয়নগর, যশোর।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশ ১২ মে - dainik shiksha এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশ ১২ মে খাড়িয়া ভাষা সংরক্ষণে উদ্যোগ গ্রহণের আহবান প্রধান বিচারপতির - dainik shiksha খাড়িয়া ভাষা সংরক্ষণে উদ্যোগ গ্রহণের আহবান প্রধান বিচারপতির উপবৃত্তির সব অ্যাকাউন্ট নগদ-এ রূপান্তরের সময় বৃদ্ধি - dainik shiksha উপবৃত্তির সব অ্যাকাউন্ট নগদ-এ রূপান্তরের সময় বৃদ্ধি শিক্ষক হতে চান না শিক্ষক দম্পতিদের কৃতী সন্তানরা - dainik shiksha শিক্ষক হতে চান না শিক্ষক দম্পতিদের কৃতী সন্তানরা কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে শিক্ষার্থী বিক্ষোভের মধ্যে ইহুদিবিদ্বেষ নিয়ে বিল পাস - dainik shiksha শিক্ষার্থী বিক্ষোভের মধ্যে ইহুদিবিদ্বেষ নিয়ে বিল পাস দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.004641056060791