শিক্ষা সফর কি বন্ধ হয়ে যাবে?

ড. সুলতান মাহমুদ রানা |

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষা সফর ও দলগত ভ্রমণের বিষয়ে গত ১২ ফেব্রুয়ারি শিক্ষা মন্ত্রণালয় একটি পরিপত্র জারি করেছে। সাধারণত শিক্ষার্থীদের আনন্দ দেওয়ার উদ্দেশ্যেই প্রতিবছর দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এ ধরনের ভ্রমণের আয়োজন করে থাকে। কিন্তু পিকনিক ও শিক্ষা সফরে যাওয়া নিয়ে সরকারের নতুন পরিপত্রের ফলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষার্থীদের হয়রানি এবং শিক্ষা সফর বন্ধের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। পরিপত্রে যেসব অবশ্যপালনীয় বিধান সংযোজন করা হয়েছে, তা যথাযথভাবে মানতে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে অনেক খড়কাঠি পোড়াতে হবে। আর এই খড়কাঠি পুড়িয়ে শিক্ষা সফরের আয়োজন করা কতটা বিড়ম্বনা তৈরি করতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিপত্রে বলা হয়েছে, জেলা প্রশাসক (ডিসি) বা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) পূর্বানুমতি ছাড়া শিক্ষার্থীরা শিক্ষা সফর বা পিকনিকে যেতে পারবে না। কোনো প্রতিষ্ঠান এ ধরনের কর্মসূচির আয়োজন করলে শিক্ষার্থী বহনকারী গাড়ির ফিটনেস ও চালকের লাইসেন্স সম্পর্কে অবশ্যই বিআরটিএর প্রত্যয়ন নিতে হবে। ওই প্রত্যয়নপত্র দেখানো সাপেক্ষে অন্যান্য অনুমতি মিলবে। মূলত শিক্ষা সফর, পিকনিক বা দলগত ভ্রমণে যাওয়ার ক্ষেত্রে মন্ত্রণালয় থেকে সাত দফা নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এতে আরো বলা হয়েছে, ভ্রমণের জন্য নির্ধারিত স্থানে যাওয়ার আগে স্থানীয় প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনকে আনুষ্ঠানিকভাবে অবহিত করতে হবে। স্থানীয় নিরাপত্তাসংক্রান্ত যেসব বিধি-বিধান আছে, তা সবাইকে যথাযথভাবে মেনে চলতে হবে।

অনুমতি, প্রত্যয়ন ও অবহিতকরণ ইস্যুগুলো যত সহজে পরিপত্রে যুক্ত করা হয়েছে, তা বাস্তবায়ন করা অতটা সহজ নয়। কারণ আমরা দীর্ঘদিন ধরেই বিআরটিএর নামে নানা ধরনের অভিযোগ শুনে আসছি। কথিত স্পিড মানির বিনিময়ে গাড়ির লাইসেন্স, ড্রাইভিং লাইসেন্স ও ফিটনেস দেওয়ার বিষয়ে অনেক অভিযোগ শোনা যায়। তাহলে শিক্ষা সফরের গাড়ির ফিটনেসের প্রত্যয়নপত্র বিআরটিএর কাছ থেকে প্রাপ্তি কতটা সহজ কিংবা কঠিন হবে, তা আমাদের বুঝতে বাকি থাকার কথা নয়।

পরিপত্র দেখে মনে হচ্ছে, পরিবহনের চালকদের বেপরোয়া গাড়ি চালানোর কারণে দুর্ঘটনা ঘটলে মূলত এর দায়িত্ব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা শিক্ষার্থীদের। অথচ ফিটনেসবিহীন গাড়ি রাস্তায় অহরহ চলছে। তাহলে তাদের জীবনের কি কোনো নিরাপত্তা নেই? লক্কড়ঝক্কড় গাড়ি বা লাইসেন্সবিহীন চালকদের আইনের আওতায় আনার জন্য বিআরটিএ রয়েছে। রয়েছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। পরিবহন বা চালকদের কারণে দুর্ঘটনা ঘটলে এ জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দোষী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে। যথাযথ আইন অনুসরণ করা হলে ফিটনেসবিহীন গাড়ি রাস্তায় থাকারই কথা নয়। অথচ বিআরটিএর নিজস্ব হিসাবে, বর্তমানে সারা দেশে ফিটনেসবিহীন যানবাহনের সংখ্যা তিন লাখ ৩৫ হাজার। এর মধ্যে বাস-মিনিবাস ৪১ শতাংশ বা প্রায় ২৫ হাজার। অবশ্য ফিটনেস সনদ হালনাগাদ না করলেও তা ফিটনেসবিহীন গাড়ির তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়। বুয়েটের একজন বিশেষজ্ঞের মতে, একটি যানবাহনের ফিটনেস দিতে ৪২টি পরীক্ষা করার নিয়ম। কিন্তু সেগুলো করা হয় না। এ বিষয়ে বিভিন্ন সময় আদালতও নির্দেশনা দিয়েছেন। তবু এসবের সমাধান হচ্ছে না যথাযথভাবে। তাহলে শিক্ষা সফরে যাওয়া এবং অনুমতি নেওয়ার বিষয়টি কি শুধুই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দায়? দুর্ঘটনার জন্য কি শুধু তারাই দায়ী?

শুধু সড়ক দুর্ঘটনার কারণে শিক্ষা সফরে বা পিকনিকে যেতে অনুমতি চাওয়ার বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করার ঘটনা দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ও সংশ্লিষ্টদের মাঝে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। এতে শিক্ষা সফর ও পিকনিকে যেতে অনেকেই উত্সাহ হারাচ্ছেন। সংশ্লিষ্ট দপ্তরের অনুমতি পেতে ধরনা দেওয়া বা ঝামেলা মনে হওয়ায় অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষা সফরে যাবে না কিংবা উদ্যোগ নেবে না। ফলে শিক্ষার্থীদের এই আনন্দভ্রমণের রীতি নিরানন্দে পরিণত হওয়ার শঙ্কা রয়েছে।

এই পরিপত্র জারির পর পূর্বনির্ধারিত সময়সূচি অনুযায়ী সিলেট ও কক্সবাজার জেলায় আমার নেতৃত্বে ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে একটি শিক্ষা সফর হয়। তখনো আমরা সংশ্লিষ্ট পরিপত্রটি হাতে পাইনি। তবে কার্যকরী প্রতিষ্ঠানগুলো হাতে পেয়ে গিয়েছিল। হাতে না পাওয়ায় পরিপত্রে বর্ণিত বিধি-বিধান নিয়ে খুব বেশি সতর্ক হতে পারিনি। ফলে শিক্ষা সফরে গিয়ে রীতিমতো হয়রানির শিকার হতে হয় আমাদের। পাঁচ দিনের সফরে ছয়-সাতটি পুলিশ চেক পোস্টের মুখোমুখি হতে হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই গাড়ির ফিটনেস ও কাগজপত্র নিরীক্ষণ করা হয়। সেগুলো যথাযথ থাকায় খুব বেশি অসুবিধায় পড়তে হয়নি আমাদের। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের শিক্ষা সফর হওয়ায় বিড়ম্বনার মাত্রা ছিল অপেক্ষাকৃত কম। তবে ডিসির অনুমতি, বিআরটিএর প্রত্যয়নপত্র না থাকায় কিছুটা বিড়ম্বনার শিকার হতে হয়েছে; বিশেষ করে সিলেট থেকে মৌলভীবাজার যাওয়ার পথে বড়লেখা থানার সামনে গাড়ি থামিয়ে কনস্টেবল থেকে প্রমোটেড একজন ‘সাব-ইন্সপেক্টর’ গাড়ির কাগজপত্র নিরীক্ষার নামে হয়রানি, অতঃপর ৫০০ টাকা ঘুষ দাবি করলে ছাত্রদের সঙ্গে উত্তেজনা তৈরি হয়। পরে ওই থানার সেকেন্ড অফিসারের হস্তক্ষেপে বিষয়টির সন্তোষজনক সমাধান হয়। কাজেই এমন হয়রানির উদাহরণ থেকে সহজেই অনুমান করা যেতে পারে, এ বিষয়ে প্রকৃত পরিবেশ কেমন ভয়াবহ হতে পারে!

মূলত মন্ত্রণালয়ের পরিপত্রে বলা হয়, দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আয়োজনে শিক্ষার্থীদের শিক্ষা সফর, পিকনিক বা কোনো উত্সব অথবা এজাতীয় কোনো আনন্দভ্রমণে যাতায়াতের সময় পরিবহনজনিত দুর্ঘটনাসহ বিভিন্ন ধরনের দুর্ঘটনা ঘটছে। এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা পরিহারের জন্য অধিকতর সতর্কতা অবলম্বন করা প্রয়োজন। এ বিষয়ে দ্বিমত নেই। কিন্তু এসব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে শিক্ষা সফর এবং পরবর্তী সময়ে নানা রকম হয়রানির মুখোমুখি হওয়ার বিশেষ আশঙ্কা রয়েছে। আর এ ধরনের হয়রানির আশঙ্কায় শিক্ষা সফরের মতো একটি ইতিবাচক কর্মসূচি ক্রমেই বন্ধ হতে থাকবে। পরিপত্রে সংযোজিত বিধান অনুসরণ করে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে অনুমতি চাওয়া বা অনুমতি পাওয়া অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পক্ষে সম্ভব হবে না। ফলে ইচ্ছা থাকলেও শিক্ষার্থীদের নিয়ে নির্দিষ্ট কোনো স্থানে সফরে যেতে পারবে না। আর এ কারণে আবহমান কাল থেকে চলে আসা শিক্ষা ও সংস্কৃতিমূলক সফরের ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি হতে পারে।

লেখক : সহকারী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

সৌজন্যে: কালের কণ্ঠ


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
কাল খুলছে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শনিবারও চালু ক্লাস - dainik shiksha কাল খুলছে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শনিবারও চালু ক্লাস সরকারি কলেজ মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও খাদিমের চাকরি জাতীয়করণ দাবি - dainik shiksha সরকারি কলেজ মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও খাদিমের চাকরি জাতীয়করণ দাবি উপবৃত্তির সব অ্যাকাউন্ট নগদ-এ রূপান্তরের সময় বৃদ্ধি - dainik shiksha উপবৃত্তির সব অ্যাকাউন্ট নগদ-এ রূপান্তরের সময় বৃদ্ধি শিক্ষকের বেতন ও শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া রোধে কাজ চলছে: শিক্ষামন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষকের বেতন ও শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া রোধে কাজ চলছে: শিক্ষামন্ত্রী বিএসসি মর্যাদার দাবিতে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের মাসব্যাপী কর্মসূচি - dainik shiksha বিএসসি মর্যাদার দাবিতে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের মাসব্যাপী কর্মসূচি কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে ১৩ বছরের কম বয়সী শিশুদের হাতে স্মার্টফোন নয় - dainik shiksha ১৩ বছরের কম বয়সী শিশুদের হাতে স্মার্টফোন নয় একই স্কুলের দুই ছাত্রীকে বিয়ের পর আরেক ছাত্রীকে ল্যাব সহকারীর অনৈতিক প্রস্তাব - dainik shiksha একই স্কুলের দুই ছাত্রীকে বিয়ের পর আরেক ছাত্রীকে ল্যাব সহকারীর অনৈতিক প্রস্তাব দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশ ১২ মে - dainik shiksha এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশ ১২ মে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0028378963470459