শেকৃবির হলে হলে মাদক, পিছিয়ে নেই ছাত্রীরাও

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

রাজধানীর শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে (শেকৃবি) মাদকদ্রব্য সহজলভ্য হওয়ায় মাদকসেবী শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়ছে। ক্যাম্পাসের বেশ কয়েকটি পয়েন্টসহ বিভিন্ন আবাসিক হলে নিয়মিত মাদক সেবনের আসর বসছে। শুক্রবার (৬ সেপ্টেম্বর) যুগান্তরে এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ হয়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন ইমরান খান। 

মাদক সংশ্লিষ্টতার কারণে কয়েক শিক্ষার্থী আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরা পড়লেও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। ফলে মাদকের বিস্তার রোধ করা যাচ্ছে না। দিন দিন মাদকাসক্ত ছাত্রের সংখ্যা বাড়ছে। একই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মাদকসেবী ছাত্রীদের সংখ্যাও। মাদকের টাকা জোগাতে গিয়ে তারা চুরি ও ছিনতাইয়ের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। মাদক সরবরাহের ক্ষেত্রে বস্তি এখন শেকৃবির গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

কয়েক শিক্ষার্থী জানান, সিগারেটের দাম বেড়ে যাওয়া এবং গাঁজা সহজলভ্য হওয়ায় তারা গাঁজা বেছে নিয়েছে। আর সচ্ছল শিক্ষার্থীরা ইয়াবার দিকে বেশি ঝুঁকেছে। ক্যাম্পাসের ভেতর ও বাইরের বিভিন্ন এজেন্টের মাধ্যমে মাদক সরবরাহ করা হয়। ফলে সব ধরনের মাদকদ্রব্য হাতের নাগালেই পাওয়া যায়। মাদকের টাকা জোগাতে গিয়ে আবাসিক হলগুলোতে বাইসাইকেল, ল্যাপটপ, মোবাইল ফোন সেট, মানিব্যাগ ও বইসহ বিভিন্ন জিনিস চুরি ও ছিনতাইয়ের সঙ্গে শিক্ষার্থীরা জড়িয়ে পড়ছে। তবে এসব নিয়ে প্রশাসনের কোনো মাথাব্যথা নেই।

সূত্র জানায়, প্রশাসনের চোখের সামনেই ছাত্রদের তিনটি আবাসিক হলে মধ্যরাতে মাদকের আসর বসে। নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা হলের দুটি ব্লকের ছাদে, ‘এ’ ব্লকের পঞ্চম তলা ও সপ্তম তলা, ‘বি’ ব্লকের দ্বিতীয় তলায় এবং কবি কাজী নজরুল ইসলাম হলের ছাদে এবং বেশ কয়েকটি কক্ষে, শেরেবাংলা হলের ছাদে মাদকের নিয়মিত আসর বসে। দুটি ছাত্রী হলেও নিয়মিত মাদকের আসর বসে। হলগুলোর বেশ কয়েকটি রুমে মাদকের আসর বসে। এছাড়া নির্মাণাধীন টিএসসি ও এর পাশের মোবাইল ফোন টাওয়ার ও কেন্দ্রীয় খেলার মাঠে রাতভর চলে গাঁজা, ফেনসিডিল ও ইয়াবাসহ বিভিন্ন মাদকের আসর।

দ্বিতীয় বর্ষের এক শিক্ষার্থী জানান, হলের মাদকাসক্ত কিছু ‘বড় ভাইয়ের’ সান্নিধ্যে প্রথম বর্ষ থেকে অনেকেই নেশায় জড়িয়ে পড়েন। ক্যাম্পাসে ইয়াবা ও ফেনসিডিল সেবনের প্রবণতাও ব্যাপকভাবে বেড়েছে। 

কৃষকরত্ন শেখ হাসিনা হলের এক পরিচ্ছন্ন কর্মী জানান, কিছুদিন আগে ওয়াশ রুম পরিষ্কার করার সময় বেশ কিছু ফেনসিডিলের বোতল পাওয়া যায়। বিষয়টি প্রশাসনকে জানানো হলেও কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি।

এ হলের সপ্তম তলায় এক রুমে ১৭ ও ১৩তম ব্যাচের চার ছাত্রীর গাঁজা সেবনের অভিযোগ পাওয়া গেলেও প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। কৃষকরত্ন শেখ হাসিনা হল ও ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলে মাদক সরবরাহে ১৪, ১৬ ও ১৭তম ব্যাচের ১০ থেকে ১২ শিক্ষার্থী জড়িত বলে জানা গেছে।

নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা হলের ‘এ’ ব্লকের ছাদে ২৪ জুলাই মাদকের আসর বসার খবর সহকারী প্রক্টর রুহুল আমিনকে জানানো হলে বিষয়টি তিনি প্রক্টরকে জানাবেন বলে ধন্যবাদ দিয়ে ফোন সংযোগ কেটে দেন। ‘বি’ ব্লকে ৪ আগস্ট ইয়াবার আসর বসার খবর প্রক্টর ফরহাদ হোসেনকে সাংবাদিকরা জানান। কিন্তু তিনি বলেন, ‘এটি তো সামাজিক সমস্যা। এ ব্যাপারে কী করা যায়! এখানে বন্ধ করলেও অন্য জায়গায় খাবে। এ নেশা থেকে দূর করবা কেমনে!’

সূত্র জানায়, রাইড শেয়ার ‘উবার’ ও ‘পাঠাও’-এর মাধ্যমে প্রতিদিন ক্যাম্পাসের বস্তিতে লাখ লাখ টাকার ইয়াবাসহ বিভিন্ন মাদকদ্রব্য আসে। এছাড়া কলেজ গেট, জেনেভা ক্যাম্প, বিএনপি বাজারসহ বেশ কয়েকটি স্থান থেকে মাদকদ্রব্য ক্যাম্পাসে পাঠানো হয়। এরপর সেগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে সরবরাহ করা হয়।

এ কাজে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারী ও বস্তির ভাড়াটিয়া কিছু ব্যক্তি সহায়তা করার অভিযোগ রয়েছে। কয়েকজন প্রভাবশালী ছাত্রনেতার আশ্রয়-প্রশ্রয়ে কয়েকজন কর্মচারী ও কয়েকটি চক্র দিনের পর দিন ক্যাম্পাসে অবাধে মাদকের ব্যবসা করছে। প্রশাসনের সামনে এসব ঘটলেও তা রোধে কোনো উদ্যোগ নেই। মূলত মাদকদ্রব্য সহজলভ্য হওয়ার পেছনে বহিরাগত মাদক ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের কতিপয় শিক্ষার্থী, সহায়ক কর্মচারী ও নিরাপত্তা প্রহরীর ভূমিকা রয়েছে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, শিক্ষার্থীদের হাতে ইয়াবা চালান সরবরাহ করার সঙ্গে ১৯ জনের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। তাদের মধ্যে রয়েছে- বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন নিরাপত্তা প্রহরী, এক গাড়িচালকের ভাই, দোয়েল ভবনের লিফ্টম্যান, বোটানি ল্যাবের এক অ্যাটেনডেন্টের ছেলে ও বস্তির ভাড়াটিয়া কয়েকজন। ইয়াবা, গাঁজা, ফেনসিডিল ও অন্যসব মাদকদ্রব্য সরবরাহের সঙ্গে তারা সক্রিয়ভাবে জড়িত। এছাড়া ক্যাম্পাসে পাইকারি ও খুচরা মাদক ব্যবসার সঙ্গে বেশ কয়েকজন ছাত্র জড়িত বলেও অভিযোগ রয়েছে। একাধিক আবাসিক হলের মাদকাসক্ত ছাত্রদের রাতে বহিরাগতদের নিয়ে ঘোরাফেরা করতে দেখা গেছে।

১৭ নভেম্বর লিফটম্যান আক্তার ও বহিরাগত তারিফকে ইয়াবাসহ আটক করা হয়। তবে তারিফকে পুলিশে ধরিয়ে দিলেও আক্তারকে ছেড়ে দেয়া হয়। ১৭ আগস্ট ক্যাম্পাসের আবুল বাশার স্কুলের পাশে তিনজনকে ইয়াবাসহ আটক করা হলেও সন্দেহমূলক মামলা দিয়ে তাদের ছেড়ে দেয়া হয়। এভাবে চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ীদের ছেড়ে দেয়ায় উদ্বেগ ও হতাশা প্রকাশ করেছে বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্টরা।

একটি সূত্র জানায়, ১৬ ও ১৭তম ব্যাচের বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী অন্য শিক্ষার্থীদের মধ্যে ইয়াবা ও অন্যসব মাদক সরবরাহ করে। এসব শিক্ষার্থীর অধিকাংশই পরীক্ষায় পাস করতে পারেনি। ১৮তম ব্যাচ ও নতুন ব্যাচের কিছু শিক্ষার্থী তাদের প্রভাবে মাদকাসক্ত হতে শুরু করেছে।

এ বিষয়ে প্রক্টর ফরহাদ হোসেনের কাছে জানতে চাইলে তিনি জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ের বস্তি আমাদের গলার কাঁটা। এ কারণেই মাদকের বিস্তার হচ্ছে। বাইরের চাপে আমরা বস্তিটি উচ্ছেদ করতে পারছি না। সুনির্দিষ্ট তথ্য পেলে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
রোববার থেকে সরকারি প্রাথমিকে মর্নিং স্কুল, খোলার প্রজ্ঞাপন জারি - dainik shiksha রোববার থেকে সরকারি প্রাথমিকে মর্নিং স্কুল, খোলার প্রজ্ঞাপন জারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শনিবারের ছুটি বহাল থাকছে - dainik shiksha প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শনিবারের ছুটি বহাল থাকছে ফের আন্দোলনের হুশিয়ারি চুয়েট শিক্ষার্থীদের - dainik shiksha ফের আন্দোলনের হুশিয়ারি চুয়েট শিক্ষার্থীদের গরমে কলেজে কোচিং, দুদিনে অসুস্থ ৮ ছাত্রী - dainik shiksha গরমে কলেজে কোচিং, দুদিনে অসুস্থ ৮ ছাত্রী কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে নিবন্ধিত শিক্ষক নিয়োগে এনটিআরসির নতুন নির্দেশনা - dainik shiksha নিবন্ধিত শিক্ষক নিয়োগে এনটিআরসির নতুন নির্দেশনা দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে জাল সনদে চাকরি করছে কয়েক হাজার হেলথ টেকনোলজিস্ট - dainik shiksha জাল সনদে চাকরি করছে কয়েক হাজার হেলথ টেকনোলজিস্ট ফের আন্দোলনের হুশিয়ারি চুয়েট শিক্ষার্থীদের - dainik shiksha ফের আন্দোলনের হুশিয়ারি চুয়েট শিক্ষার্থীদের আইনি লড়াইয়ে যাচ্ছেন শিক্ষক নেতা কাওছার শেখ - dainik shiksha আইনি লড়াইয়ে যাচ্ছেন শিক্ষক নেতা কাওছার শেখ please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0050160884857178