চিকিৎসার সক্ষমতা নেই : সমঝোতার পথে সেই স্কুলশিক্ষক

নিজস্ব প্রতিবেদক |

ওয়াসিফা বিনতে রহমত। বয়স তার মাত্র চার। বাবার পায়ের পাশে আনমনে বসে আছে সে। ছোট্ট ওয়াসিফা চায় বাবা তার দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠুন। কিন্তু ব্যথায় চোখ বুজে কাতরাচ্ছেন বাবা রহমত উল্লাহ। পায়ের পাশে বসে থাকা ছোট্ট মেয়ের অস্তিত্ব টের পেলেও অনিশ্চিত ভবিষ্যতের চিন্তায় তার দিকে মন দিতে পারছেন না বাবা।

'মাত্র দুই টাকার জন্য মানুষ এত নির্মম হতে পারে! ধাক্কা দিয়ে গাড়ির নিচে চাপা দিতে পারে! এরকম কখনোই ভাবিনি। কিন্তু সেটিই ঘটেছে। আঘাত লাগা পায়ে আবার স্বাভাবিক জোর ফিরে পাব কিনা, জানি না।' বলতে বলতে শিক্ষক রহমত উল্লাহর চোখের কোণ বেয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগল অশ্রুকণা। ছোট্ট ওয়াসিফা মুছে দিতে লাগল বাবার অশ্রুসিক্ত চোখ।

চট্টগ্রাম বন্দরনগরীর মেহেদীবাগে ন্যাশনাল হাসপাতালের ৩০৩ নম্বর রুমে গিয়ে এই হৃদয়বিদারক দৃশ্যের সামনাসামনি হতে হয় সমকালকে। অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের প্রতিবাদ করায় গত শনিবার বাস থেকে ফেলে দেওয়া হয় স্কুলশিক্ষক রহমত উল্লাহকে। হাসপাতালের এই কক্ষে তার চিকিৎসা চলছে।

তবে দরিদ্রতার নির্মম কশাঘাতে শেষ পর্যন্ত এ ঘটনায় কোনো মামলা না করে বরং সমঝোতার পথই বেছে নিতে হয়েছে স্কুলশিক্ষক রহমত উল্লাহকে। চিকিৎসার ব্যয় বাবদ তাকে চার লাখ টাকা দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন বাসের মালিক সাজ্জাদ আল মামুন। তিনি বলেছেন, প্রয়োজনে তারা চিকিৎসার জন্য আরও টাকা দেবেন।

কোতোয়ালি থানার ওসি নেজাম উদ্দীন জানিয়েছেন, শিক্ষক রহমত উল্লাহ বা তার পরিবারের পক্ষ থেকে কোনো অভিযোগ দেওয়া হয়নি। তাই বাসটিকে জব্দ করলেও তারা এর চালক ও হেলপারকে গ্রেপ্তার করতে পারছেন না। তারা জানতে পেরেছেন, উভয়পক্ষ ঘটনাটি সমঝোতার মাধ্যমে মীমাংসা করেছেন। তাই কোনো মামলা করা হয়নি।

রহমত উল্লাহর শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে ন্যাশনাল হাসপাতালের অর্থোপেডিক্স বিভাগের চিকিৎসক মোহাম্মদ মামুন জানান, তার কোমরে চিড় ধরেছে। এটি সারতে সময় লাগবে। অপারেশনেরও দরকার হতে পারে। তার বাঁ পায়ের মাংস থেঁতলে গেছে। চামড়া উঠে গেছে। এখন আপাতত ড্রেসিং করা হচ্ছে। দুই সপ্তাহ পর প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগে রেফার করা হবে।

রহমত উল্লাহর সঙ্গে হাসপাতালে আছেন তার স্ত্রীর ভাই মো. রুবেল। চট্টগ্রাম কলেজ থেকে মাস্টার্স শেষ করে তিনি চাকরি খুঁজছেন। তিনি বললেন, গতকাল সোমবার থেকে তরল খাবার দেওয়া হচ্ছে বোনজামাইকে (রহমত উল্লাহ)। অল্প অল্প কথাও বলতে পারছেন তিনি। দুই সন্তানের সংসারে তিনিই একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। তাই ভবিষ্যতে তিনি পায়ে স্বাভাবিক জোর পাবেন কিনা- তা নিয়ে টেনশনে আছেন তারা।

টানাপোড়েনের সংসার :মহেশখালীর পানিরছড়া এলাকার বাসিন্দা রহমত উল্লাহর সঙ্গে শারমিন আক্তারের বিয়ে হয় ২০১৩ সালে। চার বছরের ওয়াসিফা ছাড়াও এই দম্পতির মানদোহা বিনতে রহমত নামের দেড় বছরের আরেকটি মেয়ে রয়েছে। পাঁচলাইশের শাহ হাবিব উল্লাহ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক তিনি।

শারমিনের ভাই রুবেল জানান, শিক্ষকতা করে সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে রহমত উল্লাহকে। দুই টাকা বাঁচাতে তাই বাসে সেদিন ঝগড়ায় জড়িয়ে পড়েন তিনি। চিকিৎসার পাশাপাশি মামলা পরিচালনার ব্যয় বহন করা এই পরিবারের জন্য কঠিন এক কাজ। তাই আপস করতে হয়েছে বাস মালিকের সঙ্গে। তিনি প্রত্যাশা করেন, চিকিৎসার পর রহমত উল্লাহ যেন স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেন এবং এমন ঘটনার যাতে পুনরাবৃত্তি না হয়।

নেপথ্যে বাড়তি বাস ভাড়া :ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে রহমত উল্লাহ বলেন, "আমার বাসা অক্সিজেন এলাকায়। পুরাতন রেলস্টেশনে যেতে বাসে উঠেছিলাম। হেলপার অতিরিক্ত ভাড়া দাবি করায় প্রতিবাদ জানিয়েছিলাম। একপর্যায়ে বাসচালক হেলপারকে বলে, '...পুতকে কোতোয়ালি থানা মোড়ে নিয়ে নামিয়ে দে।' বলে বাস জোরে টানতে থাকে সে। এ জন্য আমি পুরাতন রেলস্টেশনে আর নামতে পারিনি। নিউমার্কেটের কাছে নতুন রেলস্টেশনের সামনে গেলে আমাকে ধাক্কা দিয়ে নামিয়ে দেয় হেলপার। ভারসাম্য রাখতে না পেরে আমি পড়ে গিয়ে পেছনের চাকায় আটকে যাই। গাড়ির চাকা আমাকে কিছুদূর টেনে নিয়ে যায়। এ সময় চাকার আঘাতে আমার পায়ের চামড়া উঠে যায়। হাড় ভেঙে যায়। আশপাশের মানুষ এসে উদ্ধার করেন আমাকে।'

আহত শিক্ষকের সহকর্মী অভিজিৎ বড়ূয়া জানান, রহমত উল্লাহ এখন প্রাইমারি ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে (পিটিআই) প্রশিক্ষণে আছেন। আগে অক্সিজেন থেকে নিউমার্কেট ৮ থেকে ১০ টাকা ভাড়া ছিল। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর পর ভাড়া ১৫ টাকা পুনর্নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু হেলপার ১৭ টাকা দাবি করে। তিনি এর প্রতিবাদ করেছিলেন।

পুনরাবৃত্তি চান না রহমত উল্লাহ :দারিদ্র্যের কারণে বাস মালিকের সঙ্গে সমঝোতা করলেও এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি চান না রহমত উল্লাহ। আর কোনো শিক্ষক যেন এমন নির্মমতার শিকার না হন, সেদিকেও খেয়াল রাখতে বলেছেন তিনি বাস মালিকদের। তিনি বলেন, 'মামলা করতে পারতাম। কিন্তু খরচ চালানোর মতো সামর্থ্য তো নেই আমার। আবার চিকিৎসা ব্যয় বহন করাও আমার পক্ষে অসম্ভব। বাধ্য হয়ে সমঝোতা করেছি। বাস মালিকও ঘটনার পর থেকে আন্তরিকভাবে খোঁজখবর নিয়েছেন। আমি চাই, আর কেউ যেন এমন নির্মমতার শিকার আর না হন।'


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
কাল থেকে শিক্ষা বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী চলবে সব প্রাথমিক বিদ্যালয় - dainik shiksha কাল থেকে শিক্ষা বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী চলবে সব প্রাথমিক বিদ্যালয় বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার মান বাড়ানোর নির্দেশ রাষ্ট্রপতির - dainik shiksha বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার মান বাড়ানোর নির্দেশ রাষ্ট্রপতির ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার দাবিতে দেশজুড়ে সংহতি সমাবেশ - dainik shiksha ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার দাবিতে দেশজুড়ে সংহতি সমাবেশ সব মাদরাসার ওয়েবসাইট ও তথ্য হালনাগাদের নির্দেশ - dainik shiksha সব মাদরাসার ওয়েবসাইট ও তথ্য হালনাগাদের নির্দেশ অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা অবৈতনিক : দুই মন্ত্রণালয় যা করবে - dainik shiksha অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা অবৈতনিক : দুই মন্ত্রণালয় যা করবে নার্সিং-মিডওয়াইফারি ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ - dainik shiksha নার্সিং-মিডওয়াইফারি ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ শুক্রবার স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত হয়নি, জানালো শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha শুক্রবার স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত হয়নি, জানালো শিক্ষা মন্ত্রণালয় সিনিয়র আইনজীবীরা বিচার বিভাগের স্বার্থে কথা বলবেন, আশা প্রধান বিচারপতির - dainik shiksha সিনিয়র আইনজীবীরা বিচার বিভাগের স্বার্থে কথা বলবেন, আশা প্রধান বিচারপতির দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0026891231536865