সদিচ্ছার অভাবেই হয়নি ডাকসু নির্বাচন

সাব্বির নেওয়াজ |

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতার মতো ৩৩ বছর কাটেনি, তবে সময়টা প্রায় কাছাকাছিই হতে চলেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনের জন্য শিক্ষার্থীদের অপেক্ষার প্রহর প্রায় তিন দশক পার হতে চললেও কেউ কথা রাখেনি। বিগত দিনে দায়িত্ব পালন করা ছয়জন উপাচার্যের মধ্যে তিনজন চেষ্টা করেও এ নির্বাচন দিতে সফল হননি। বাকিরা প্রতিশ্রুতি দিলেও রক্ষা করেননি। সরকার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এবং দেশের বড় দুটি ছাত্র সংগঠন- ছাত্রলীগ ও ছাত্রদল প্রকাশ্যে কখনও এই নির্বাচনের বিরোধিতা করেনি। তবে বাস্তবতা হলো, শেষবার নির্বাচন হওয়ার পর ২৮ বছর পার হয়ে ২৯তম বছরে পড়েছে, তবু ডাকসু নির্বাচন হয়নি।

ডাকসু নির্বাচন না হওয়ার কারণ খুঁজতে গিয়ে দেখা গেছে, মূলত সরকারগুলোর সদিচ্ছার অভাবেই এ নির্বাচন হয়নি। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও সহিংসতা সৃষ্টির আশঙ্কায় কেউই এ বিষয়ে উদ্যোগী হননি। নির্বাচন সম্পন্ন করতে সরকার, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, ছাত্রলীগ ও ছাত্রদল- এই চারটি পক্ষের কারোরই উদ্যোগ, আগ্রহ বা চাপ ছিল না। তবে ক্যাম্পাসে ক্রিয়াশীল বাম ছাত্র সংগঠনগুলো বরাবরই ডাকসু নির্বাচন চেয়ে আসছে।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ১৯৭৩ সালের আইন অনুসারে পরিচালিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্বায়ত্তশাসনের ক্ষমতা ভোগ করলেও বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় ১৯৯০ সালের পর থেকে ছাত্রদের কোনো আইনানুগ অংশীদারিত্ব নেই। দীর্ঘ ২৮ বছরে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনাকারী বডি সিনেটে শিক্ষক প্রতিনিধি, রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েট প্রতিনিধি, সিন্ডিকেট সদস্য, ডিন, শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সংগঠনসহ সব সংগঠনের নির্বাচন নিয়মিত অনুষ্ঠিত হচ্ছে। হয় না শুধু ডাকসু নির্বাচন। ফলে বছরের পর বছর ধরে সিনেটে ছাত্র প্রতিনিধির ৫টি পদ শূন্যই থাকছে। ডাকসু প্রতিষ্ঠা হয় ১৯২৪ সালে। ১৯৫৩ সালের আগ পর্যন্ত ডাকসুর সহসভাপতি মনোনয়ন করা হতো। ওই বছরই প্রথম নির্বাচন হয়। ১৯৭১ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত সাতবার ডাকসু নির্বাচন হয়। ১৯৭৩ সালের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আদেশের ২০ ধারা অনুযায়ী, সিনেটের ১০৫ জন সদস্যের মধ্যে ৫ জন শিক্ষার্থী প্রতিনিধি থাকার কথা, যারা ডাকসুর মাধ্যমে নির্বাচিত হয়ে আসবেন। কিন্তু দিনের পর দিন নির্বাচন না হওয়ায় খি ত সিনেট নিয়েই সভা বসছে।

বরেণ্য শিক্ষাবিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী  বলেন, 'আমাদের অভিজ্ঞতা হলো, সরকার চায় না বলেই ডাকসু নির্বাচন হয় না। দলীয়ভাবে নিয়োগ করা উপাচার্যরা সরকারের মতের প্রতিই অনুগত থাকেন। অতীতে সরকারগুলো হয়তো ভেবেছে, ডাকসু নির্বাচন হলে ছাত্রদের মতামত তাদের পক্ষে নাও যেতে পারে।'

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কয়েকজন প্রবীণ অধ্যাপক জানান, ডাকসু নির্বাচন আয়োজন করলে তা থেকে সহিংসতা হতে পারে- এমন আশঙ্কা থেকেই আসলে কেউ (সরকার বা উপাচার্য) নির্বাচন দেয়নি। অন্যদিকে ১৯৯০ সালের পর দুই দফা বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে ছাত্রদল ডাকসু নির্বাচনের বিষয়ে ততটা আগ্রহী ছিল না। তখন ছাত্রলীগ নির্বাচনের পরিবেশ না থাকার অভিযোগ তুলে ডাকসু নির্বাচনে আগ্রহ দেখায়নি। একইভাবে নব্বই-পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগ তিন দফা ক্ষমতায় থাকলেও ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রলীগের আগ্রহ ছিল না। তবে ছাত্রলীগের বর্তমান নেতৃত্বের মধ্যে ডাকসু নির্বাচন নিয়ে আগ্রহ দৃশ্যমান। 

৪৭ বছরে মাত্র সাতবার নির্বাচন :খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, স্বাধীনতার পর ৪৭ বছরে মাত্র সাতবার ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। স্বাধীনতার আগে শুধু ১৯৬৫-৬৬ ও ১৯৬৯-৭০ সালে এ নির্বাচন হয়নি। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু সরকারের শুরুতেই (১৯৭২-৭৩) ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৭৩-৭৪ সালেও নির্বাচন দেওয়া হয়েছিল, তবে সেটা প হয়ে যায়। এর পর সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের আমলে দু'বার (১৯৭৯-৮০ ও ৮০-৮১), আবদুস সাত্তার সরকারের আমলে একবার (১৯৮২-৮৩) এবং এরশাদের আমলে  দুবার (১৯৮৯-৯০ ও ১৯৯০-৯১) ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৯০ সালে এরশাদের স্বৈরশাসনের পতনের পর গত ২৮ বছরে আর এই নির্বাচন হয়নি।

ডাকসুর সর্বশেষ নির্বাচন হয় ১৯৯০ সালের ৬ জুন। তখন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ দেশের রাষ্ট্রপতি। ১৯৯৮ সালে ডাকসুর কমিটি ভেঙে দেওয়া হয়। পরবর্তী ছয় মাসের মধ্যে নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছিল কর্তৃপক্ষ। এর পর কেটে গেছে ২৮ বছর। 

কেউ কথা রাখেনি :বিগত দিনে দায়িত্ব পালন করা একাধিক উপাচার্য ডাকসু নির্বাচন দেওয়ার আশ্বাস দিলেও নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেননি তারা। দেখা গেছে, গত ২৮ বছরে সাতজন অধ্যাপক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দায়িত্ব পালন করেছেন। আদালতের আদেশের কারণে অনেকটা বাধ্য হয়েই বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক আখতারুজ্জামান এ নির্বাচন দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছেন। এর বাইরে চার বছরের পূর্ণ মেয়াদ বা তার বেশি সময় উপাচার্য ছিলেন এ কে আজাদ চৌধুরী, এস এম এ ফায়েজ এবং আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক। আগের সাত বছরে তিনবার তফসিল ঘোষণা করেও নির্বাচন দেওয়া যায়নি। ফলে এই তিনজনসহ ছয়জনের কেউই ওই পথ মাড়াননি। সাবেক উপাচার্য আরেফিন সিদ্দিক ২০০৯ সালে নিয়োগ পাওয়ার পর গণমাধ্যমে ডাকসু নির্বাচনের কথা বললেও তার মেয়াদের সাড়ে আট বছরে একবারও নির্বাচনের উদ্যোগ নেননি। 

১৯৯০ সালের নির্বাচনের পর ১৯৯১ সালের ১৮ জুন ডাকসু নির্বাচন হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ওই সময় সহিংস ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে উপাচার্য মনিরুজ্জামান মিঞা নির্বাচন বন্ধ করে দেন। ১৯৯৪ ও ১৯৯৫ সালে পরপর দু'বার উপাচার্য এমাজউদ্দীন আহমদ ডাকসুর তফসিল ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু তখন ছাত্রলীগের বিরোধিতার কারণে নির্বাচন হয়নি। অধ্যাপক এ কে আজাদ চৌধুরী উপাচার্য হওয়ার পর ১৯৯৬ সালে একাধিকবার ডাকসু নির্বাচনের সময়সীমার কথা জানিয়েছিলেন। তিনিও সেই সময়কার বিরোধী ছাত্র সংগঠনসহ অন্যান্য ছাত্র সংগঠনের অসহযোগিতার কারণে নির্বাচন দিতে পারেননি। ২০০৫ সালের মে মাসে উপাচার্য এস এম এ ফায়েজ ওই বছরের ডিসেম্বর মাসের মধ্যে ডাকসু নির্বাচনের ঘোষণা দেন। তখন ছাত্রদল ডাকসু নির্বাচনের দাবিতে একাধিকবার মিছিল, সমাবেশ ও উপাচার্যকে স্মারকলিপি দেয়। কিন্তু বিরোধিতা করে ছাত্রলীগ।

দাবি ওঠে, পূরণ হয় না :বিগত দিনগুলোতে বাম ছাত্র সংগঠনগুলো ডাকসু নির্বাচনের দাবিতে একাধিকবার আন্দোলনে নেমেছে। সিনেটে আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব এসেছে; কিন্তু তাতে ফল হয়নি। ২০১২ সালে বিক্ষোভ, ধর্মঘট, কালো পতাকা মিছিল এবং ব্যঙ্গচিত্র প্রদর্শনের মাধ্যমে ডাকসু নির্বাচনের দাবি জানান সাধারণ শিক্ষার্থী ও বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীরা। 'ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী অধিকার মঞ্চ' তৈরি করে লাগাতার কর্মসূচিও চলে বেশ কিছুদিন। পরে তা স্তিমিত হয়ে যায়। গত বছর উচ্চ আদালতের আদেশের পর টানা ১৫ দিন অনশন করেন সমাজকল্যাণ অনুষদের সান্ধ্যকালীন মাস্টার্সের ছাত্র ওয়ালিদ আশরাফ। এ ছাড়া ২০১৭ সালের ৬ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫০তম সমাবর্তন অনুষ্ঠানে বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর ও রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ বলেন, 'ডাকসু নির্বাচন ইজ আ মাস্ট। নির্বাচন না হলে ভবিষ্যৎ নেতৃত্বে শূন্যতার সৃষ্টি হবে।' 

চ্যান্সেলরের এ তাগাদার পরও পেরিয়ে গেছে আরও ২৩ মাস।

 

সৌজন্যে: সমকাল


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
শুক্রবার স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত হয়নি, জানালো শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha শুক্রবার স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত হয়নি, জানালো শিক্ষা মন্ত্রণালয় স্কুল-কলেজ শিক্ষকদের এপ্রিল মাসের এমপিওর চেক ছাড় - dainik shiksha স্কুল-কলেজ শিক্ষকদের এপ্রিল মাসের এমপিওর চেক ছাড় গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটে প্রথম লামিয়া - dainik shiksha গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটে প্রথম লামিয়া প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে দ্বিতীয় ধাপের চূড়ান্ত ফল আগামী সপ্তাহ - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে দ্বিতীয় ধাপের চূড়ান্ত ফল আগামী সপ্তাহ ছাত্রলীগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিলিস্তিনের পতাকা উড়াবে কাল - dainik shiksha ছাত্রলীগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিলিস্তিনের পতাকা উড়াবে কাল চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ করার বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রী যা জানালেন - dainik shiksha চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ করার বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রী যা জানালেন গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ, পাস ৩৬.৩৩ শতাংশ - dainik shiksha গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ, পাস ৩৬.৩৩ শতাংশ কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0027320384979248