সব কিছু যেখানে সচল, সেখানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কেন সচল নয়

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

করোনার শুরু থেকে এক বছর আমাদের শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবনে দারুণ ছন্দঃপতন দেখা দেওয়ার পর আমরা আশার আলো দেখতে পেয়েছিলাম। কারণ করোনা একেবারে কমে এসেছিল। সরকার শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করে অবশেষে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। সে মোতাবেক আগামী ২৩ মে থেকে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার কথা। বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলো ১৭ মে শিক্ষার্থীদের ভ্যাকসিন প্রয়োগ ও স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করে খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত এখনো আছে। এমন সিদ্ধান্তকে সবাই স্বাগত জানিয়েছিল। ছাত্র-ছাত্রীরাও খুশি। কিন্তু হঠাৎ করে মার্চ মাসের শেষের দিকে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ আসায় আমাদের স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় খোলার সিদ্ধান্তকে তছনছ করে দিয়েছে। সোমবার (৩ মে) কালের কণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত উপ-সম্পাদকীয়তে এ তথ্য জানা যায়।

উপ-সম্পাদকীয়তে আরও জানা যায়, ভারত থেকে টিকা আসার অনিশ্চয়তা শুধু শিক্ষার্থী নয়, সবাইকেই ভাবিয়ে তুলেছে। দীর্ঘ এক বছর শিক্ষার্থীদের করোনার সামাজিক, অর্থনৈতিক ও মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব আমরা আশা করেছিলাম অনেকটা কমবে; কিন্তু করোনার বর্তমান প্রবণতা বলবৎ থাকলে শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা বলা মুশকিল। এই একটিমাত্র ক্ষেত্র, যেখানে করোনার প্রভাব অনেক বেশি। স্বীকার করছি করোনার অর্থনৈতিক প্রভাব কম নয়; কিন্তু অর্থনৈতিক গতি চলমান একেবারে স্থবির নয়। উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অনেক শিক্ষার্থী এরই মধ্যে লেখাপড়া বাদ দিয়ে জীবিকার সন্ধানে রত আছেন, অনেক মেয়েশিক্ষার্থীর অভিভাবকরা বিয়ে দিয়েছেন, স্কুলের অনেক শিক্ষার্থী ঝরে পড়েছে, সেখান থেকে তাদের হয়তো ফিরিয়ে আনা যাবে না। আমরা জানি না আমাদের শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে। তবে করোনাকে মাথায় নিয়ে একটি সর্বজনীন পদক্ষেপ গ্রহণ করার এখনই সময়, যেখানে পাবলিক ও প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানের মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকবে না।

গত বছর আমরা এইচএসসিতে অটো পাসের ব্যবস্থা করেছি। অন্য শ্রেণিগুলোতেও অনলাইন ক্লাসের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের উত্তীর্ণ করেছি। আমরা আশা করেছিলাম এ বছর একটু দেরিতে হলেও এসএসসি/সমমান ও এইচএসসি/সমমান পরীক্ষা নিতে পারব। সে অনুযায়ী সিলেবাসও সংক্ষিপ্ত করা হয়েছিল। কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয় ফাইনাল ইয়ারগুলোতে পরীক্ষা নেওয়ার ব্যবস্থা করেছিল এবং কেউ কেউ শেষও করেছিল। কিন্তু শিক্ষার্থীদের হল খোলার আন্দোলনে তা বন্ধ করতে বাধ্য করেছে। মজার ব্যাপার হলো, এই সময় প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবনে কোনো ছেদ হতে দেয়নি। তারা শিক্ষা ও ভর্তি কার্যক্রম অব্যাহত রাখছে। আমাদের আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ আসন্ন ভর্তি পরীক্ষা। মে মাস থেকে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে একক ও গুচ্ছে ভর্তি পরীক্ষা আয়োজন করার কথা। করোনার মধ্যেও সরকার মেডিক্যালের ভর্তি পরীক্ষা নিতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু করোনার এই সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার কী হবে। কঠোর নিষেধাজ্ঞা বা লকডাউন, স্বাস্থ্যবিধি মানা প্রভৃতি কার্যক্রমের মাধ্যমে যদি করোনা শনাক্ত ও মৃত্যুহার ক্রমান্বয়ে কমতে থাকে, তাহলে আমরা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে পারব; কিন্তু যদি তা না হয় তাহলে আমাদের উপায় কী। আমাদের শিক্ষার্থীদের কী হবে। আমরা কী পরিস্থিতি বিবেচনায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছুটি বাড়াতে থাকব, নাকি বিকল্প চিন্তা করব। আমাদের গভীরভাবে ভাবার সময় এসেছে। বসে থাকলে আমরা আবার পিছিয়ে পড়ব।

আমাদের সামনে দুটি পথ খোলা আছে। আমরা দেখেছি মার্কেট, শপিং মল, কারখানা, গণপরিবহন ইত্যাদি খোলা রাখলে করোনার পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়। স্কুল ও কলেজের কথা বলছি না; কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দিলে করোনার পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় তা আমরা পর্যবেক্ষণ করতে পারি। আমাদের সুবিধা হতো শিক্ষার্থীদের ভ্যাকসিন দিয়ে আবাসিক হলে প্রবেশ করানো গেলে। কিন্তু যাঁরা ভ্যাকসিনের দ্বিতীয় ডোজ নিয়েছেন তাঁদের বেলায় যেখানে অনিশ্চয়তা, সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ভ্যাকসিন দেওয়া এ সময়ে সম্ভব হওয়ার নয়। তবে শিক্ষার্থীরা একটি নির্দিষ্ট জায়গায় যেহেতু থাকবে, সেহেতু তাদের কঠোর বিধি-নিষেধের মধ্যে রেখে স্বাস্থ্যবিধি মানতে বাধ্য করে বিশ্ববিদ্যালয় খোলা যেতে পারে। যদি ভালো ফল না দেয়, তাহলে সহজেই বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করা হবে। ঠিক একইভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে আমরা ভর্তি পরীক্ষার ব্যবস্থাও করতে পারি। আমাদের বিকল্প চিন্তাও মাথায় রাখতে হবে। ধরে নিলাম করোনার থাবা থেকে আমরা অচিরেই মুক্তি পাচ্ছি না। তাহলে কি আমরা বসে থাকব। যে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পরীক্ষা নিচ্ছে, ঠিক একই প্রক্রিয়ায়, সম্ভব হলে আরো একটু উন্নত করে নেওয়া যায় কি না তা চিন্তা করা উচিত। আমরা অনলাইনে ক্লাস নিচ্ছি, এখন বাকি কাজ পরীক্ষা নেওয়া। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় সম্প্রতি অনলাইনে শিক্ষার্থীদের মৌখিক পরীক্ষা আয়োজনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। কাজেই আমরা কিভাবে পরীক্ষা নিতে পারি তার সঠিক উপায় বের করা জরুরি। নইলে আমরা আরো পিছিয়ে পড়ব।

আমাদের কাছে বারবার একটি প্রশ্ন আসছে—সব কিছু যেখানে সচল, সেখানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কেন সচল নয়। এর পক্ষে অনেক যুক্তিও আছে। জীবিকা ও প্রয়োজনের তাগিদে প্রচণ্ড চাপে অনেক কিছু খুলে দিতে হচ্ছে। আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থা বিবেচনায় সব কিছু বন্ধ করা সম্ভব নয়। আমাদের হয়তো মনে আছে করোনার প্রথম ঢেউয়ে সরকার, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, ব্যক্তি ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন যেভাবে এগিয়ে এসেছিল এবারে তা তেমন চোখে পড়ে না। কাজেই জীবিকার বিষয়টি যেকোনোভাবেই হোক মাথায় রাখতে হচ্ছে। আমরা আশা করি লকডাউন উঠে যাওয়ার পরও মানুষ স্বাস্থ্যবিধি মানবে, করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যুহার কমতে থাকবে এবং আমরা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসব। আমরা সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মে মাস থেকে শিক্ষাজীবন শুরু করতে পারব। কিন্তু যদি পরিস্থিতির উন্নতি না হয়, তাহলে আমাদের করণীয় কী। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় খোলার বিষয়ে শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে প্রচণ্ড চাপ রয়েছে। শিক্ষার্থীরা তালা ভেঙে হলে প্রবেশ করেছিলেন। কাজেই ঈদের পরে তাঁদের ঠেকানো মুশকিল হবে। আক্রান্তের হার কমবেশি বিবেচনায় এনে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন অব্যাহত রাখা উচিত। আমাদের পথ দুটি—কঠোর স্বাস্থ্যবিধি মেনে বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেওয়া, নয়তো অনলাইনে পরীক্ষা নেওয়ার ব্যবস্থা করা। করোনার সঙ্গে সমযোজনের মাধ্যমে এভাবেই আমাদের শিক্ষাজীবন অতিবাহিত করা ছাড়া আর বিকল্প কী।

 

লেখক : ড. নিয়াজ আহম্মেদ, অধ্যাপক, সমাজকর্ম বিভাগ শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
একাদশ শ্রেণির ক্লাস শুরু ৩০ জুলাই - dainik shiksha একাদশ শ্রেণির ক্লাস শুরু ৩০ জুলাই অবসর কল্যাণে শিক্ষার্থীদের দেয়া টাকা জমার ফের তাগিদ - dainik shiksha অবসর কল্যাণে শিক্ষার্থীদের দেয়া টাকা জমার ফের তাগিদ সুধা রানী হাদিসের শিক্ষক পদে : এনটিআরসিএর ব্যাখ্যা - dainik shiksha সুধা রানী হাদিসের শিক্ষক পদে : এনটিআরসিএর ব্যাখ্যা শরীফ-শরীফার গল্প বাদ যাচ্ছে পাঠ্যবই থেকে - dainik shiksha শরীফ-শরীফার গল্প বাদ যাচ্ছে পাঠ্যবই থেকে কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে শূন্যপদের ভুল চাহিদায় শাস্তি পাবেন কর্মকর্তা ও প্রধান শিক্ষক - dainik shiksha শূন্যপদের ভুল চাহিদায় শাস্তি পাবেন কর্মকর্তা ও প্রধান শিক্ষক এক রুমে ৩৫ ছাত্রী অসুস্থ, পাঠদান বন্ধ - dainik shiksha এক রুমে ৩৫ ছাত্রী অসুস্থ, পাঠদান বন্ধ যৌ*ন হয়রানির অভিযোগে প্রধান শিক্ষক কারাগারে - dainik shiksha যৌ*ন হয়রানির অভিযোগে প্রধান শিক্ষক কারাগারে এসএসসির খাতা চ্যালেঞ্জের আবেদন যেভাবে - dainik shiksha এসএসসির খাতা চ্যালেঞ্জের আবেদন যেভাবে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0038490295410156