সিঙ্গেল মাদার ও সামাজিক প্রতিবন্ধকতা

শাহনাজ পারভীন এলিস |

গল্পের শুরুটা মা হওয়ার আগের। প্রায় দশ বছর চেষ্টা করেও মা হতে পারছিলেন না মিতালি। আর এতো চেষ্টা করেও মা হতে না পারার যন্ত্রণায় মিতালী নিজেই যখন দগ্ধ- তখন শশুরবাড়ির লোকদের কূটকথা, পরিবারের সদস্যদের অবহেলা আর সমাজের নানা ইঙ্গিতপূর্ণ কথাবার্তা তাকে আরও আহত করতে থাকে। তারপরও হাল ছাড়েনি মিতালি। কারণ কলেজ জীবনের বন্ধু, তার স্বামী মাহফুজ তাকে মানসিকভাবে সাপোর্ট দিচ্ছিলো, চিকিৎসাও চলছিলো। প্রচণ্ড ইচ্ছাশক্তি আর তাদের যৌথ প্রচেষ্টায় বিয়ের এগারো বছর পর  মিতালির কোলজুড়ে আসে জমজ সন্তান মনন ও মেধা। 

কিন্তু আবারও ছন্দপতন ঘটে মিতালির জীবনে। বাচ্চাদের বয়স দুই বছর হওয়ার আগেই রোড এক্সিডেন্টে মারা যান মাহফুজ। তারপর থেকে... কখনো বাবা, কখনোবা মা হয়ে সন্তানের পাশে থেকে জীবনযুদ্ধ শুরু করেন তিনি। এমন ঘটনা শুধু মিতালির জীবনে ঘটেছে এমন নয়, সমাজে নানা কারণেই বেড়েছে সিঙ্গেল মাদারের সংখ্যা। অথচ জীবনযুদ্ধে থাকা এমন নারী বা মায়েদের পাশে সমাজের লোকজন তাগিদ বোধ করেন না; উল্টো ইঙ্গিতপূর্ণ নানা কথা, অনাকাঙ্খিত প্রশ্নে প্রতিনিয়ত বিদ্ধ করছেন। একটিবারও তারা ভাবেন না প্রতিটি মানুষ স্বাধীন সত্তার অধিকারী। কারো ব্যক্তিগত জীবনযাপন নিয়ে লোকসমাজের অনধিকার চর্চা কাম্য নয়। সমাজে কোন নারী সিঙ্গেল মাদার হিসেবে সন্তানদের নিয়ে জীবনযাপন করতে চাইলে, তাকে নানা শব্দ চয়নে হেয় প্রতিপন্ন করা হয়।

সৃষ্টির আদিকাল থেকেই নারী-পুরুষের সম্মিলনে গড়ে ওঠে পরিবার। কিন্তু একসঙ্গে বসবাস ও চলতে গিয়ে অনেক সময় মতপার্থক্যসহ নানা কারণে অনেক পরিবারেই ভাঙন দেখা দেয়। এক পর্যায়ে স্বামী-স্ত্রীর বিচ্ছেদ অনিবার্য হয়ে ওঠে। এরপর পাল্টে যেতে থাকে সমাজে বসবাসরত মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি। এমন পরিস্থিতিতে পড়া পুরুষের চেয়ে নারীদের বেশি মানসিক পীড়নের শিকার হতে হয়! কারণ সিঙ্গেল মাদার ও সিঙ্গেল নারীরা সমাজে নানা প্রশ্নের সম্মুখীন হন, মানুষ হিসেবে তার ইচ্ছাকে সমাজ সম্মান দিতে চায় না। এর ফলে ওই নারীদের সামাজিক সমস্যা বাড়তে থাকে। যৌন হয়রানিসহ বিভিন্ন রকম সমস্যার মধ্য দিয়ে চলে তাদের জীবন যাপন। অনেক সময় বিয়ের জন্যও তাদের নানাভাবে উত্যক্ত করে ওই নারীদের জীবন দুর্বিষহ করে তোলা হয়। বিয়েতে রাজি না হলে ওই নারীকে সামাজিকভাবে হেনস্তা করা এবং তার সম্পত্তি জবরদখলের চেষ্টা করা হয়। এতোকিছুর পরও শেষপর্যন্ত কোন নারী মানসিক দৃঢ়তা নিয়ে টিকে থাকার চেষ্টা করলে, চারিত্রিক দোষ দিয়ে তাকে ঘরবন্দি বা একঘরে করে রাখার অনেক ঘটনাও দেখা যায়!

সাংসারিক জীবন থেকে স্বামী-স্ত্রী আলাদা হয়ে যাওয়ার পর- পুরুষরা সমাজে যতটা স্বাধীন, স্বতন্ত্র ও নিরাপদে জীবনযাপন করতে পারে, নারীরা তা পারে না। সিঙ্গেল নারীর সমাজে টিকে থাকা রীতিমতো এক মহাযুদ্ধ। কারণ অনেকেই মনে করেন, সিঙ্গেল মাদার মানে অসহায়! আবার কেউবা ভাবেন- সিঙ্গেল মাদার একাকিত্ববোধে যন্ত্রনাবিদ্ধ। তাই অনেকে তাকে অকারণে সহানুভূতি দেখাতে চান। এতে তার মানসিক শান্তি আরও বিঘ্নিত হয়। তবে সন্তান যেখানে একজন মায়ের প্রধানতম পছন্দ সেখানে সংগ্রাম তার নিত্যসঙ্গী। তাই সব ধরনের প্রতিবন্ধকতা পেছনে ফেলে সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয়- একলা পথচলা সংগ্রামী মায়েদের।

আমাদের সমাজে এখনো সিঙ্গেল মাদার- বিষয়টিকে খুব সহজে মেনে নিতে পারেন না অনেকে। তারা মনে করেন, সন্তান বড় করার দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে পুরুষের সাহায্য ছাড়া মহিলারা অক্ষম। তাইতো একলা মায়েদের হাজারো প্রশ্নবাণে প্রতিনিয়ত জর্জরিত হতে হয়। সিঙ্গেল মাদার-এর সন্তানদেরও সমাজে নানারকম অপ্রিয় প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়, ফলে তারাও একলা থাকতে বেশি পছন্দ করেন। এতে অন্যান্য বাচ্চাদের মতো সমাজে স্বাভাবিকভাবে মিশতে না পেরে- ক্রমশ তারা অসামাজিক হয়ে পড়েন।

সিঙ্গেল মাদার বা সিঙ্গেল প্যারেন্টস- পরিবার ও সমাজ কারো জন্যই সুখকর নয়। তারপরও সমস্যা যত কঠিনই হোক না কেন- পরিস্থিতি মানুষকে সমাধানের পথ খুঁজে নিয়ে বাধ্য করে। অল্প বয়সে বিবাহবিচ্ছেদ কিংবা দুর্ঘটনায় বিধবা হওয়ার পর, দ্বিতীয় বিয়ে না করে অনেক নারীকেই বেছে নিতে হয় সিঙ্গেল মাদার জীবন। পিতৃ পরিচয় ছাড়াও সন্তানকে লালন-পালন করছেন, এমন সিঙ্গেল মাদার বা একক মায়েদের সংখ্যা খুব বেশি না হলেও, নেহায়েত কমও না। ফলে জানা-অজানা অনেক পরিবারে সন্তানেরা বেড়ে উঠছে মাতৃছায়ায়। 

সমাজের তীর্যক দৃষ্টি, আর্থিক অস্বচ্ছলতা সহ্য করেও সিঙ্গেল মায়েরা সন্তানদের কখনো ছেড়ে যান না, পাশে থাকেন। সন্তানের ভবিষ্যৎ চিন্তা করে সমস্ত প্রতিকূলতা কাটিয়ে তাদের এগিয়ে নেন। সন্তানের মুখে হাসি ফোটাতে, সন্তানের সম্মান এবং তাদের সুখে সুখি হতে যুদ্ধ করছেন অনেক নারী। এই যুদ্ধে তারা সফলও হচ্ছেন। যার মূলে রয়েছে- বর্তমান সমাজে নারীরা এখন  আর শিক্ষা-দীক্ষায় পুরুষের চেয়ে পিছিয়ে নেই। উচ্চ শিক্ষিত নারীরা সিঙ্গেল মাদার হলেও তারা কর্মজীবী ও স্বাবলম্বী। অনেকে সামাজিকভাবেও প্রতিষ্ঠিত। তাই কারো ওপর নির্ভরশীলতা ছাড়াই সন্তানদের নিয়ে সমাজে মাথা উঁচু করে বাঁচতে পারছেন। সন্তানদের লেখাপড়া শিখিয়ে উচ্চ শিক্ষা দিতেও তাদের কারো সহানুভূতির প্রয়োজন হচ্ছে না। 

সমাজের সচেতন মহলের প্রশ্ন- কবে সেই দিন আসবে, যেদিন সিঙ্গেল নারীকে তার জীবনযাপনের জন্য সমাজ কখনোই প্রশ্নবিদ্ধ করবে না? তার জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলবে না?
 
মানবাধিকার কর্মীরা মনে করেন, যারা সিঙ্গেল মাদার তারা যদি কর্মজীবী হোন- তাকে কর্মক্ষেত্রের পাশাপাশি সন্তানের প্রতি যেমন দৃষ্টি দিতে হয়, তেমনি সংসারের দিকেও নজরদারি রাখতে হয়। তারপরও শুনতে হয় সমাজের নানা কটূক্তি। এর কারণ কুসংস্কার ও নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি। তাই পরিবর্তন করতে হবে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির। একা চলা সংগ্রামী নারী ও মায়েদের পাশে থাকতে হবে বন্ধুর মতো, তাদের প্রতি সমাজের নারী-পুরুষ সবার সংবেদনশীল আচরণ নিশ্চিত করা ছাড়া এ অবস্থা থেকে উত্তরণ সম্ভব নয়।

লেখক : শাহনাজ পারভীন এলিস, সাংবাদিক


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
কাল খুলছে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শনিবারও চালু ক্লাস - dainik shiksha কাল খুলছে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শনিবারও চালু ক্লাস সরকারি কলেজ মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও খাদিমের চাকরি জাতীয়করণ দাবি - dainik shiksha সরকারি কলেজ মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও খাদিমের চাকরি জাতীয়করণ দাবি উপবৃত্তির সব অ্যাকাউন্ট নগদ-এ রূপান্তরের সময় বৃদ্ধি - dainik shiksha উপবৃত্তির সব অ্যাকাউন্ট নগদ-এ রূপান্তরের সময় বৃদ্ধি শিক্ষকের বেতন ও শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া রোধে কাজ চলছে: শিক্ষামন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষকের বেতন ও শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া রোধে কাজ চলছে: শিক্ষামন্ত্রী বিএসসি মর্যাদার দাবিতে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের মাসব্যাপী কর্মসূচি - dainik shiksha বিএসসি মর্যাদার দাবিতে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের মাসব্যাপী কর্মসূচি কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে ১৩ বছরের কম বয়সী শিশুদের হাতে স্মার্টফোন নয় - dainik shiksha ১৩ বছরের কম বয়সী শিশুদের হাতে স্মার্টফোন নয় একই স্কুলের দুই ছাত্রীকে বিয়ের পর আরেক ছাত্রীকে ল্যাব সহকারীর অনৈতিক প্রস্তাব - dainik shiksha একই স্কুলের দুই ছাত্রীকে বিয়ের পর আরেক ছাত্রীকে ল্যাব সহকারীর অনৈতিক প্রস্তাব দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশ ১২ মে - dainik shiksha এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশ ১২ মে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0025768280029297