স্কুল-কলেজে ‘গলাকাটা’ ফি বন্ধ হচ্ছে!

রুম্মান তূর্য |

অবশেষে রদ হচ্ছে বেসরকারি স্কুল-কলেজের গলাকাটা টিউশন ফি আদায়ের সুযোগ। তিন বছরের বেশি সময় ধরে টিউশন ফি নীতিমালার খসড়া তৈরি করেছে শিক্ষা প্রশাসন। এ নীতিমালায় রাজধানী ঢাকাসহ মহানগরীর বেসরকারি স্কুলগুলোর জন্য মাসিক সর্বোচ্চ টিউশন ফি ৬০০ টাকা, স্নাতক শিক্ষার্থীদের জন্য ৭০০ টাকা ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষার্থীদের জন্য ৬০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। একইসঙ্গে টিউশন ফিয়ের টাকা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধান ও সভাপতির ইচ্ছে মাফিক ব্যয় বন্ধে কিছু খাত নির্ধারণ করে দেয়া হচ্ছে। শিগগিরই এ খসড়া চূড়ান্ত করা হবে।  

গতকাল বুধবার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ এবং মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের মধ্যে এক সভায় এ নীতিমালা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বিষয়টি নিশ্চিত করে দৈনিক আমাদের বার্তাকে জানান, আরও একটি সভার পর নীতিমালা চূড়ান্ত করা হবে।

স্কুলে সর্বোচ্চ ৬০০ কলেজে ৭০০ টাকা :

 প্রস্তাবিত খসড়ায় রাজধানীসহ মহানগর, জেলা ও পৌর শহর এবং মফস্বলের স্কুল ও কলেজের জন্য আলাদা টিউশন ফি নির্ধারণ করা হয়েছে। সর্বোচ্চ ৭০০ টাকা মাসিক বেতন নির্ধারণ করা হয়েছে রাজধানীসহ মহানগরের ননএমপিও কলেজগুলোর স্নাতক শিক্ষার্থীদের জন্য। 

অপরদিকে রাজধানীসহ মহানগরীর ননএমপিও বেসরকারি স্কুলগুলোর শিক্ষার্থীদের জন্য মাধ্যমিক পর্যায়ে সর্বোচ্চ ৬০০ টাকা এবং  নিম্মমাধ্যমিক পর্যায়ে সর্বোচ্চ ৫০০ টাকা আদায় করা যাবে। 

কোন স্কুলে কত টিউশন ফি :

মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের তৈরি করা খসড়ায় রাজধানীসহ মহানগরীর ননএমপিও স্কুলগুলোর নবম ও দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের বেতন ৬০০ টাকা। ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণির মাসিক বেতন ৫০০ টাকা। 

খসড়ায় জেলা শহর ও পৌর উপজেলা এলাকার ননএমপিও স্কুলের নবম ও দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের বেতন ৪৫০ টাকা, ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণির ৩৫০ টাকা। আর মফস্বল এলাকার ননএমপিও স্কুলের নবম ও দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের বেতন ২৫০ টাকা। ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণির ২০০ টাকা। প্রতি পত্রের পরীক্ষার জন্য সর্বোচ্চ ৪০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। 

একই নীতিমালায় রাজধানীসহ মহানগরী এলাকার এমপিওভুক্ত স্কুলের নবম ও দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের বেতন ৪০০ টাকা আর ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণির ৩৫০ টাকা। জেলা শহর ও পৌর এলাকার এমপিওভুক্ত স্কুলের নবম ও দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য ২৫০ টাকা আর ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণির ২০০ টাকা। অপরদিকে মফস্বলের এমপিওভুক্ত স্কুলের নবম ও দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য ১৫০ টাকা আর ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের মাসিক বেতন সর্বোচ্চ ১০০ টাকা। এমপিওভুক্ত স্কুলের জন্য প্রতি পত্রের পরীক্ষার জন্য সর্বোচ্চ ৪০ টাকা ফি নির্ধারণ করা হয়েছে।  

কোন কলেজে কত মাসিক বেতন :

খসড়া নীতিমালায় রাজধানীসহ মহানগরীর ননএমপিও কলেজগুলোর স্নাতক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের জন্য বেতন প্রস্তাব করা হয়েছে ৭০০ টাকা। এ কলেজগুলোর উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষার্থীদের জন্য সর্বোচ্চ মাসিক বেতন ৬০০ টাকা। জেলা শহর ও পৌর উপজেলার ননএমপিও কলেজগুলোর স্নাতক শিক্ষার্থীদের বেতন ৫০০ টাকা ও উচ্চমাধ্যমিকের জন্য সর্বোচ্চ ৪০০ টাকা। আর মফস্বলের ননএমপিও কলেজগুলোর স্নাতক শিক্ষার্থীদের বেতন ৪০০ টাকা ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষার্থীদের ৩০০ টাকা। ননএমপিও কলেজের প্রতি পত্রের পরীক্ষার সর্বোচ্চ ৫০ টাকা। 

প্রস্তাবে আরও আছে, রাজধানীসহ মহানগরীর এমপিওভুক্ত বেসরকারি কলেজগুলোর স্নাতক শিক্ষার্থীদের বেতন ৫০০ টাকা। উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষার্থীদের সর্বোচ্চ মাসিক বেতন ৪৫০ টাকা। জেলা শহর ও পৌর উপজেলার এমপিওভুক্ত কলেজগুলোর স্নাতক শিক্ষার্থীদের জন্য মাসিক বেতন ২৫০ টাকা ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষার্থীদের জন্য সর্বোচ্চ মাসিক বেতন ২০০ টাকা। আর মফস্বলের এমপিওভুক্ত কলেজগুলোর স্নাতক শিক্ষার্থীদের জন্য বেতন ২০০ টাকা ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের জন্য সর্বোচ্চ মাসিক বেতন ১৮০ টাকা। এমপিওভুক্ত কলেজের প্রতি পত্রের পরীক্ষার জন্য সর্বোচ্চ ৫০ টাকা ফি নির্ধারণ করা হয়েছে। 

ইচ্ছেমাফিক খরচ করতে পারবেন না প্রতিষ্ঠান প্রধান ও সভাপতিরা :

দৈনিক আমাদের বার্তার অনুসন্ধানে জানা যায়, রাজধানীসহ বিভাগীয় এবং জেলা শহরগুলোতে কয়েক হাজার প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যাদের নিজস্ব তহবিলে টিউশন ফির মোটা অংকের টাকা জমা থাকে। এ টাকা ব্যয় হয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি ও প্রতিষ্ঠান প্রধানের ইচ্ছায়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রতিষ্ঠান প্রধান ও কমিটির সভাপতির বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ থাকে। ঢাকার স্বনামধন্য বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো ডোনেশন, মোটা টিউশন ফি ও কোচিং ফিয়ের নামে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা নিয়ে নিচ্ছে। অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ফান্ডে কয়েকশ কোটি টাকা রয়েছে বলেও তথ্য আছে। এ টাকা শিক্ষার্থীদের উন্নয়নে ব্যয়ের বাধ্যবাধকতা টিউশন ফিয়ের খসড়া নীতিমালায় বলা হয়েছে। এ নীতিমালা বাস্তবায়ন হলে প্রতিষ্ঠান প্রধান ও সভাপতি নিজেদের ইচ্ছেমত টিউশন আদায় ও সে টাকা খরচের সুযোগ হারাবেন।  

খসড়া নীতিমালায় বলছে, নির্ধারিত খাত ছাড়া অতিরিক্ত টাকা শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আদায় করা যাবে না। আদায় করা টাকা খাতওয়ারী আলাদা ব্যাংক হিসাব খুলে জমা রাখতে হবে, যা প্রতিষ্ঠান প্রধান ও সভাপতির যৌথ স্বাক্ষরে পরিচালিত হবে। আন্তর্জাতিক হিসাব বিজ্ঞানের মান (আইএএস) অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নির্ধারিত ক্যাশবহি   সংরক্ষণ করতে হবে। প্রত্যেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের একাডেমিক কাউন্সিলের মনোনীত দক্ষ ও অভিজ্ঞ শিক্ষক দিয়ে অভ্যন্তরীণ অডিট কমিটি গঠন করতে হবে। অডিট কমিটি প্রতি বছর অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা করবে ও প্রতিবেদন অ্যাকাডেমিক কাউন্সিল, স্কুল পরিচালনা কমিটিকে সংরক্ষণ করতে হবে। প্রতিষ্ঠান প্রধান তিন সদস্যের কমিটি গঠনের মাধ্যমে টাকা ব্যয় করবেন এবং ব্যয়ের জন্য স্কুল পরিচালনা কমিটির অনুমোদন নিতে হবে। ভাউচারে কমিটির স্বাক্ষর ও প্রতিষ্ঠান প্রধানের প্রতিস্বাক্ষরসহ সংরক্ষণ করতে হবে। প্রতিষ্ঠানের নির্ধারিত রিসিট বই ছাড়া কোনো টাকা আদায় করা যাবে না। বিল, ভাউচার ছাড়া কোনো ব্যয় করা যাবে না। সরকার নির্ধারিত নিয়মে ভ্যাট-ট্যাক্স ফি পরিশোধ করতে হবে। প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাব পরিবর্তনের ক্ষেত্রে অবশ্যই সংশ্লিষ্ট জেলা শিক্ষা অফিসকে জানাতে হবে।

খসড়ায় আরও বলা হয়েছে, শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আদায় করা টাকা সংশ্লিষ্টখাত ছাড়া অন্য যাতে স্থানান্তর ও ব্যয় করা যাবে না। তবে, প্রয়োজনে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর বা সংশ্লিষ্ট শিক্ষা বোর্ডের অনুমোদন নিয়ে অব্যয়িত এবং জমা থাকার টাকার সুদ বাবদ পাওয়া অর্থ অন্যখাতে স্থানান্তর ও ব্যয় করা যাবে। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আদায় করা টাকায় ব্যক্তিগত কোনো প্রকার ঋণ বা অগ্রিম হিসাবে পরিশোধ করা যাবে না। নীতিমালার অধীনে অগ্রিম সংশ্লিষ্ট কাজ করার ত্রিশ দিনের মধ্যে অথবা সংশ্লিষ্ট অর্থবছরের মধ্যে অবশ্যই সমন্বয় করতে হবে। ক্রয় করা মালামাল যথাযথভাবে লিপিবদ্ধ করতে হবে এবং বণ্টনের সময় হিসাব সংরক্ষণ করতে হবে। বিল পরিশোধের আগে ক্রয় করা মালামাল যথাযথভাবে বুঝে পাওয়া বা মেরামত ও অন্যান্য কাগজ যথাযথভাবে সম্পন্ন করা হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট কমিটির প্রত্যয়ন ও পরিচালনা কমিটির অনুমোদন নিতে হবে। প্রতিষ্ঠানের যে কোনো বিল ক্রস চেকের মাধ্যমে পরিশোধ করতে হবে। তহবিলের আয়-ব্যয়ের হিসাব প্রচলিত বিধিতে সংরক্ষণ করতে হবে।
 
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের একজন উপপরিচালক দৈনিক আমাদের বার্তাকে বলেন, টিউশন ফিয়ের খসড়া নীতিমালা নিয়ে মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। এ নীতিমালাটি পর্যালোচনা ও কিছু সংশোধনের পর তা জারি করবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
কাল খুলছে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শনিবারও চালু ক্লাস - dainik shiksha কাল খুলছে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শনিবারও চালু ক্লাস সরকারি কলেজ মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও খাদিমের চাকরি জাতীয়করণ দাবি - dainik shiksha সরকারি কলেজ মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও খাদিমের চাকরি জাতীয়করণ দাবি উপবৃত্তির সব অ্যাকাউন্ট নগদ-এ রূপান্তরের সময় বৃদ্ধি - dainik shiksha উপবৃত্তির সব অ্যাকাউন্ট নগদ-এ রূপান্তরের সময় বৃদ্ধি শিক্ষকের বেতন ও শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া রোধে কাজ চলছে: শিক্ষামন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষকের বেতন ও শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া রোধে কাজ চলছে: শিক্ষামন্ত্রী বিএসসি মর্যাদার দাবিতে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের মাসব্যাপী কর্মসূচি - dainik shiksha বিএসসি মর্যাদার দাবিতে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের মাসব্যাপী কর্মসূচি কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে ১৩ বছরের কম বয়সী শিশুদের হাতে স্মার্টফোন নয় - dainik shiksha ১৩ বছরের কম বয়সী শিশুদের হাতে স্মার্টফোন নয় একই স্কুলের দুই ছাত্রীকে বিয়ের পর আরেক ছাত্রীকে ল্যাব সহকারীর অনৈতিক প্রস্তাব - dainik shiksha একই স্কুলের দুই ছাত্রীকে বিয়ের পর আরেক ছাত্রীকে ল্যাব সহকারীর অনৈতিক প্রস্তাব দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশ ১২ মে - dainik shiksha এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশ ১২ মে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0028109550476074