৪ জনের কক্ষে রাত কাটে ৮০ জনের!

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

চারজনের একটি কক্ষে সর্বোচ্চ কতজন শিক্ষার্থী থাকতে পারে? আটজন, বড়জোর ১২ জন। কিন্তু প্রতিটি কক্ষে থাকছে ৭০ থেকে ৮০ জন। অবাস্তব মনে হলেও ঢাকা কলেজের উত্তর, দক্ষিণসহ একাধিক ছাত্রাবাসের চিত্র এটি।

ঐতিহ্যবাহী এ কলেজের সমস্যা জানতে সম্প্রতি ছাত্রাবাসগুলোতে সরেজমিনে গেলে উঠে আসে এ রকম ভয়াবহ চিত্র। কয়েকটি কক্ষে পালা করে অর্থাৎ দুই পালায় শিক্ষার্থীদের রাতযাপনের তথ্যও পাওয়া যায়। এক কক্ষে অনেক শিক্ষার্থী গাদাগাদি করে থাকায় জটিল চর্মরোগে আক্রান্ত হচ্ছে তারা। সোমবার (৮ জুলাই) কালের কন্ঠ প্রত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়, প্রতিবেদনটি লিখেছেন শরীফুল আলম সুমন ও তানজিদ বসুনিয়া।

এ ছাড়া অনেক কক্ষেই পলেস্তারা খসে পড়েছে। বেরিয়ে এসেছে ছাদের রড। বৃষ্টি হলেই ছাদ চুঁইয়ে পানি পড়ে। বাথরুমের সমস্যা, ডাইনিংয়ে অস্বাস্থ্যকর খাবার—এসবের সঙ্গে নিত্যদিনের সমস্যা গোসলের পানি না থাকা।

জানা যায়, ঢাকা কলেজে মোট আটটি ছাত্রাবাস রয়েছে। সেগুলো হলো—দক্ষিণ ছাত্রাবাস, দক্ষিণায়ন ছাত্রাবাস, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ছাত্রাবাস, শহীদ ফরহাদ হোসেন বা মাস্টার্স ছাত্রাবাস, ইন্টারন্যাশনাল ছাত্রাবাস, উত্তর ছাত্রাবাস, ওয়েস্ট ছাত্রাবাস ও শেখ কামাল ছাত্রাবাস। এসব হলের প্রায় ৩০০ কক্ষে এক হাজার ২০০ (প্রতি কক্ষে চারজন করে ধরলে) জন শিক্ষার্থী থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু থাকছে পাঁচগুণেরও বেশি শিক্ষার্থী।

উত্তর ছাত্রাবাসের নিচতলার ১২০ নম্বর কক্ষে চারটি বিছানায় সর্বোচ্চ আটজন শিক্ষার্থী থাকার কথা। কিন্তু অবাক করা বিষয় হলো ওই কক্ষে থাকে ৭০ থেকে ৮০ জন শিক্ষার্থী। কক্ষের আকার ছোট হওয়ায় বাধ্য হয়ে শিক্ষার্থীরা পালা করে ঘুমায়। রাত ১২টা থেকে ভোর ৪টা পর্যন্ত এক পালায় ৩৫ জন এবং ভোর ৪টা থেকে সকাল ৮টা পর্যন্ত আরেক পালায় ৩৫ থেকে ৪০ জন শিক্ষার্থী ঘুমায়। উত্তর ছাত্রাবাসের ১২০ ও ১১৯ নম্বর কক্ষেও চলছে এমন পালা করে ঘুমানোর ব্যবস্থা। এই দুই কক্ষে দুই পালায় ১৪০ থেকে ১৬০ জন শিক্ষার্থী রাত্রিযাপন করে।

সমাজবিজ্ঞান বিভাগের স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী মাহমুদ ইরফানের সঙ্গে কথা হয় উত্তর ছাত্রাবাসে। তিনি গণরুম দেখিয়ে বলেন, ‘এই রুমে আমরা ৭০-৮০ জন থাকি। একজনের সিঙ্গেল বেডে তিনজন করে ঘুমাই। তাও আবার শিফট করে। একদল রাতের প্রথম ভাগে জেগে থাকে, আরেক দল ঘুমায়। তাদের চার ঘণ্টার ঘুমের পর আমরা ঘুমাতে যাই। এভাবে কম ঘুমের কারণে পড়াশোনার খুব ক্ষতি হচ্ছে। নিজেদের স্বাভাবিক মনে হয় না। আমরা স্বাভাবিক মানুষের মতো করে জীবন যাপন করতে চাই।’

ব্যবস্থাপনা বিভাগের স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী রেদওয়ান আহমেদ বলেন, ‘এক রুমে ৭০ জনেরও বেশি ছাত্র থাকার কারণে একজনের জ্বর বা ভাইরাসজনিত কোনো রোগ হলে সবারই জ্বর বা ওই ভাসরাসজনিত রোগ হয়। এ ছাড়া চর্মরোগের জন্য প্রায়ই ডাক্তারের কাছে যেতে হয়। ছারপোকার কথা আর কী বলব?’

মাস্টার্স ছাত্রাবাসের ১০১ ও ১০২ নম্বর কক্ষ দুটিও গণরুম হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এ ছাড়া দক্ষিণায়ন ছাত্রাবাস ও দক্ষিণ ছাত্রাবাসসহ প্রায় সব ছাত্রাবাসেই রয়েছে এ রকম গণরুম। আর আন্তর্জাতিক কোনো শিক্ষার্থী না থাকায় এখন আন্তর্জাতিক ছাত্রাবাসে থাকছে দেশি ছাত্ররাই। ঢাকা কলেজের উত্তর ও দক্ষিণ ছাত্রাবাস সবচেয়ে পুরনো। আর এই দুটি ছাত্রাবাসই বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। এ ছাড়া আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ছাত্রাবাসও ঝুঁকির মুখে রয়েছে।

অ্যাকাউন্টিং বিভাগের শিক্ষার্থী শাকিল হোসেন বলেন, ‘একটি সুস্থ সবল মানুষকে দৈনিক সাত-আট ঘণ্টা ঘুমাতে হয়। অথচ আমরা ঘুমাতে পারি চার ঘণ্টা। আমাদের অর্ধেক রাত জেগে থাকতে হয়। একজন মানুষের জীবন এভাবে চলতে পারে না। নিজেকে অবাঞ্ছিত মনে হয়।’

না প্রকাশ না করার শর্তে শহীদ ফরহাদ হোসেন ছাত্রাবাসের আবাসিক এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘আমি গ্রাম থেকে এসেছি খুব গরিব পরিবার থেকে। আমার কৃষক বাবার পক্ষে বাইরে থাকার খরচ দেওয়া সম্ভব নয়। তাই অনেক বলেকয়ে এখানে উঠেছি। কিন্তু এখানকার অবস্থা আর কী বলব? তার পরও আছি। কষ্ট হলেও একটি টিউশনি করে যে টাকা পাই তা দিয়ে কোনো রকমে চলছি।’

উত্তর ছাত্রাবাসের ৩১৬ নম্বর কক্ষের ছাদের পলেস্তারা খসে ২০১৫ সালের শেষ দিকে একজন শিক্ষার্থী মারাত্মক আহত হয়েছিলেন। এরপর সংস্কার করে সেই কক্ষেই এখন শিক্ষার্থীরা থাকছে। তবে বৃষ্টি হলেই ছাদ চুঁইয়ে পানি পড়ে। যেকোনো সময় মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটতে পারে বলে আশঙ্কা শিক্ষার্থীদের।

বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী কামরুল ইসলাম উত্তর ছাত্রাবাসে ভাঙা দরজা দেখিয়ে বলেন, ‘আমাদের দরজার যে অবস্থা মাঝে মাঝে রুমে কুকুরও এসে শুয়ে থাকে। আর ভালো ঘুম না হওয়ার কারণে পড়াশোনা ঠিকমতো হচ্ছে না। সামান্য একটু বৃষ্টি হলেই দেয়ালের ফাটল দিয়ে পানি পড়া শুরু হয়। এরই মধ্যে ছাদের বেশ কয়েক জায়গায় পলেস্তারা খসে পড়েছে। কখন কী হয় বলা যায় না। অথচ আমাদের কথা কারো মাথায় নেই।’

উত্তর ছাত্রবাসের প্রভোস্ট সহকারী অধ্যাপক মো. ওবায়দুল করিম বলেন, ‘অনেক শিক্ষার্থীই আসে যারা মেসের খরচ জোগাতে পারে না। তাই কষ্ট করে হলেও ছাত্রাবাসে থাকে। এখন আমরা তাদের বের করে দিলে হয়তো তার পড়ালেখাই বন্ধ হয়ে যাবে। তৃতীয় তলায় ছাদ থেকে পানি পড়ে। এমনকি আমার বাসার ছাদ থেকেও পানি পড়ে। অথচ বাসা ভাড়া হিসেবে মাসে ২৫ হাজার টাকা করে বেতন থেকে কেটে নেওয়া হয়। আসলে এই হলগুলো ভেঙে সুউচ্চ ভবন করাটা খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে।’

অধ্যক্ষ অধ্যাপক নেহাল আহমেদ বলেন, ‘অনেক হলের অবস্থাই খারাপ। কিন্তু সব হল যদি একসঙ্গে ভাঙা হয়, তাহলে ছাত্ররা থাকবে কোথায়? এমনও অনেক শিক্ষার্থী আছে যারা হলে থাকে, টিউশনি করে পুরো মাস চলে। তাই আমরা একটি করে হল ভেঙে ওই স্থানে নতুন ভবন নির্মাণের পর আরেকটিতে হাত দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। শিগগিরই নতুন ছাত্রাবাস নির্মাণের কাজ শুরু হবে।’


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
কাল খুলছে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শনিবারও চালু ক্লাস - dainik shiksha কাল খুলছে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শনিবারও চালু ক্লাস সরকারি কলেজ মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও খাদিমের চাকরি জাতীয়করণ দাবি - dainik shiksha সরকারি কলেজ মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও খাদিমের চাকরি জাতীয়করণ দাবি উপবৃত্তির সব অ্যাকাউন্ট নগদ-এ রূপান্তরের সময় বৃদ্ধি - dainik shiksha উপবৃত্তির সব অ্যাকাউন্ট নগদ-এ রূপান্তরের সময় বৃদ্ধি শিক্ষকের বেতন ও শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া রোধে কাজ চলছে: শিক্ষামন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষকের বেতন ও শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া রোধে কাজ চলছে: শিক্ষামন্ত্রী বিএসসি মর্যাদার দাবিতে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের মাসব্যাপী কর্মসূচি - dainik shiksha বিএসসি মর্যাদার দাবিতে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের মাসব্যাপী কর্মসূচি কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে ১৩ বছরের কম বয়সী শিশুদের হাতে স্মার্টফোন নয় - dainik shiksha ১৩ বছরের কম বয়সী শিশুদের হাতে স্মার্টফোন নয় একই স্কুলের দুই ছাত্রীকে বিয়ের পর আরেক ছাত্রীকে ল্যাব সহকারীর অনৈতিক প্রস্তাব - dainik shiksha একই স্কুলের দুই ছাত্রীকে বিয়ের পর আরেক ছাত্রীকে ল্যাব সহকারীর অনৈতিক প্রস্তাব দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশ ১২ মে - dainik shiksha এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশ ১২ মে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0029008388519287