ব্যক্তির চলাফেরার স্বাধীনতা একচ্ছত্র কোনো অধিকার নয়

নিজস্ব প্রতিবেদক |

সংবিধানের ৩৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী কোনো ব্যক্তির চলাফেরার স্বাধীনতা একচ্ছত্র কোনো অধিকার নয় বলে রায় দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। রায়ে বলা হয়েছে, বিশেষ পরিস্থিতিতে এবং আইন মেনে যে কাউকে চলাফেরায় বাধা দেওয়া যাবে। তবে, আইন ও বিধি ছাড়া কারও চলাফেরার স্বাধীনতা খর্ব করা অসাংবিধানিক।

মৌলিক অধিকার সংক্রান্ত সংবধানের ৩৬ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, 'জনস্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ সাপেক্ষে বাংলাদেশের সর্বত্র অবাধ চলাফেরা, ইহার যে কোনো স্থানে বসবাস ও বসতি স্থাপন এবং বাংলাদেশ ত্যাগ ও বাংলাদেশে পুনঃপ্রবেশ করিবার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকিবে।'

দুর্নীতি মামলার আসামি বা সন্দেহভাজন কোনো ব্যক্তির বিদেশে যাওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা সম্পর্কিত ৫টি পৃথক রিটে আপিল বিভাগের দেওয়া পূর্ণাঙ্গ রায়ে বুধবার পর্যবেক্ষণ দেওয়া হয়। প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বাধীন চার বিচারপতির বেঞ্চ এই রায় দেন। বেঞ্চের অপর বিচারপতিরা হলেন- বিচারপতি মোহাম্মদ ইমান আলী, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও বিচারপতি মো. নুরুজ্জামান।

এর আগে গত ২৭ সেপ্টেম্বর সুনির্দিষ্ট বিধি বা আইন প্রণয়ন না করা পর্যন্ত দুর্নীতি মামলার আসামি বা সন্দেহভাজন কোনো ব্যক্তির বিদেশ যাত্রার ওপর নিষেধাজ্ঞা নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আবেদন পর্যবেক্ষণসহ নিষ্পত্তি করেছিলেন আপিল বিভাগ। এরই ধারাবাহিকতায় বুধবার বিচারপতিদের স্বাক্ষর শেষে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করা হয়।

১৮ পৃষ্ঠার এই রায়ে ৮ দফা পর্যবেক্ষণ দেওয়া হয়েছে। এতে বলা হয়, সংবিধানের ৩৬ অনুচ্ছেদের অধীনে নাগরিকের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। সংবিধান সর্বোচ্চ আইন। তবে নিজের দেশ ছেড়ে যাওয়ার অধিকার কখনোই নিরঙ্কুশ অধিকার হিসেবে বিবেচিত হতে পারে না। নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে অধিকার সীমাবদ্ধ হতে পারে। সংবিধানের ৩৬ অনুচ্ছেদ বিধিনিষেধ আরোপের অনুমতি দেয়। তবে এই ধরনের বিধিনিষেধ অবশ্যই প্রণীত আইনের মাধ্যমে হতে হবে। জনস্বার্থে যুক্তিসঙ্গতভাবে তা করতে হবে। আইনের সমর্থন ছাড়া শুধুমাত্র নির্বাহী আদেশে কারও স্বাধীনতার ওপর সীমাবদ্ধতা আরোপ করা অসাংবিধানিক হবে।

পর্যবেক্ষণে আরও বলা হয়, সংবিধানের ৩৬ অনুচ্ছেদে যে স্বাধীনতা দেওয়া আছে তার মূল উদ্দেশ্য সামাজিক ভারসাম্য রক্ষা করা। তাই ফৌজদারি অপরাধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলে, পাসপোর্ট জব্দ ও বিদেশ যাত্রা আটকানো যাবে। তারপরও যদি কেউ আইনকে পাশ কাটিয়ে বিদেশ যাত্রার চেষ্টা করে, তাহলে আটকানোর পর, তিন কার্যদিবসের মধ্যে আদালতকে জানাতে হবে। কিন্তু, ফৌজদারি অপরাধে কারও নাম এলেই তার বিদেশযাত্রা রোধ করা যাবে না।

এ রায়ের বিষয়ে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল এএম আমিন উদ্দিন বলেন, আপিল বিভাগের রায়টি একটি যুগান্তকারী রায়। এর মাধ্যমে দুর্নীতির মামলা বা সন্দেহভাজন আসামিদের বিদেশে যাওয়া ঠেকানো যাবে। এ নিয়ে যে বিশৃঙ্খলা রয়েছে তাতে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হবে। তিনি আরও বলেন, এই রায় আরও আগে পাওয়া গেলে পিকে হালদারের মতো দুর্নীতিবাজদের বিদেশে যাওয়া ঠেকানো যেত।

সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্না বলেন, আপিল বিভাগের রায়ের ফলে লুটেরা-দুর্নীতিবাজদের বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার পথ সংকুচিত হবে। চাইলেই তারা পালিয়ে যেতে পারবে না। আপিল বিভাগের এই রায় অত্যন্ত আবশ্যক। এটি আরও আগে প্রয়োজন ছিল।

অন্যদিকে দুর্নীতি দমন কমিশনের আইনজীবী মোহাম্মদ খুরশীদ আলম খান বলেন, এই রায়ের মধ্যে দিয়ে দুদকের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। দুদক সন্দেহভাজন আসামি বা দুর্নীতি মামলার আসামিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারবে। তবে তার তত্ত্বাবধান করবেন আদালত।

মামলার বিবরণে জানা যায়, দুর্নীতি মামলায় জড়িত বা সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের বিদেশে যাওয়া ঠেকাতে দুদক বা সরকার বিভিন্ন সময়ে নানা পদক্ষেপ নিয়ে থাকে। বিষয়টি চ্যালেঞ্জ করে বিভিন্ন সময়ে হাইকোর্টে ৫ জন সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি হাইকোর্টে পৃথক রিট দায়ের করেন। ওই রিটের শুনানি নিয়ে হাইকোর্টের একটি বেঞ্চের রায়ে বলা হয়, এ ধরনের বিদেশে যাওয়া ঠেকাতে সরকারকে আদালতের অনুমতি নিতে হবে। আবার অন্য একটি বেঞ্চের রায়ে বলা হয়, সরকার সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বিদেশে যাওয়ায় নিষেধাজ্ঞা জারি করতে পারবে। পরে একই ধরনের ৫টি রিটের ওপর হাইকোর্টের দেওয়া রায় বা আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করে দুদক ও সংক্ষুব্ধরা। পরে সেই আপিলগুলো নিষ্পত্তি করে গত ২৭ সেপ্টেম্বর রায় দেন আপিল বিভাগ। বুধবার তারই পূর্ণাঙ্গ রায়।

৫টি পৃথক রিট আবেদন করেছিলেন জিভি হোসাইন,তাফসির মোহাম্মদ আওয়াল, আরিফ হোসেন ও মো.আতাউর রহমান এবং মো. আহসান হাবীব। রিটগুলোর একটি হলো নরসিংদীর আতাউর রহমানের মামলা। বিদেশে যেতে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে আতাউর রহমান ওরফে সুইডেন আতাউরের করা এক রিট আবেদনে জারি করা রুলের ওপর ১৬ মার্চ রায় দেন হাইকোর্ট।

দুদকের দেওয়া নিষেধাজ্ঞার চিঠি অবৈধ ঘোষণা করে বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমান সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ রায় দেন। রায়ের পর্যবেক্ষণে বলেন, সুনির্দিষ্ট বিধি বা আইন প্রণয়ন না করা পর্যন্ত দুর্নীতি মামলার আসামি বা সন্দেহভাজন কোনো ব্যক্তির বিদেশে যাওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার বিষয়ে দুদক নয়, সিদ্ধান্ত নেবেন বিশেষ জজ আদালত।

হাইকোর্টের রায়ে আরও বলা হয়, বিদেশে যাওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার বিষয়ে দুদকের সুনির্দিস্ট আইন বা বিধি নেই। এ কারণে বিষয়টি নিয়ে দ্রুত সুনির্দিষ্ট আইন বা বিধিমালা করা প্রয়োজন। তাই আশা করছি, এ বিষয়ে দুদক বা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় আইন বা বিধি করার বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে।

আদালতে দুদকের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী খুরশীদ আলম খান। রিট আবেদনকারীর পক্ষে শুনানিতে ছিলেন আইনজীবী প্রবীর নিয়োগী ও মুন্সী মনিরুজ্জামান।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
রোববার থেকে সরকারি প্রাথমিকে মর্নিং স্কুল, খোলার প্রজ্ঞাপন জারি - dainik shiksha রোববার থেকে সরকারি প্রাথমিকে মর্নিং স্কুল, খোলার প্রজ্ঞাপন জারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শনিবারের ছুটি বহাল থাকছে - dainik shiksha প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শনিবারের ছুটি বহাল থাকছে ফের আন্দোলনের হুশিয়ারি চুয়েট শিক্ষার্থীদের - dainik shiksha ফের আন্দোলনের হুশিয়ারি চুয়েট শিক্ষার্থীদের গরমে কলেজে কোচিং, দুদিনে অসুস্থ ৮ ছাত্রী - dainik shiksha গরমে কলেজে কোচিং, দুদিনে অসুস্থ ৮ ছাত্রী কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে নিবন্ধিত শিক্ষক নিয়োগে এনটিআরসির নতুন নির্দেশনা - dainik shiksha নিবন্ধিত শিক্ষক নিয়োগে এনটিআরসির নতুন নির্দেশনা দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে জাল সনদে চাকরি করছে কয়েক হাজার হেলথ টেকনোলজিস্ট - dainik shiksha জাল সনদে চাকরি করছে কয়েক হাজার হেলথ টেকনোলজিস্ট ফের আন্দোলনের হুশিয়ারি চুয়েট শিক্ষার্থীদের - dainik shiksha ফের আন্দোলনের হুশিয়ারি চুয়েট শিক্ষার্থীদের আইনি লড়াইয়ে যাচ্ছেন শিক্ষক নেতা কাওছার শেখ - dainik shiksha আইনি লড়াইয়ে যাচ্ছেন শিক্ষক নেতা কাওছার শেখ please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0061819553375244