আদালতে রেইন ট্রি’র ছায়া, এলাহাবাদ থেকে জনসন রোড

সিদ্দিকুর রহমান খান |

‘সম্পদশালীরা অর্থের বিনিময়ে তাদের অনুকূলে রায় নিশ্চিত করতে পারেন, দরিদ্ররা কোনো বিচার আশা করতে পারেন না। বিচারকরা ‘মধু বালা আওর মধু হালা’র প্রলোভনেও পড়েন।’ ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দে ভারতের এলাহাবাদ হাইকোর্টের একটা রায়ের কিছু অংশের বাংলা তরজমা করলে এর অর্থ এমনটিই দাঁড়ায়।

‘শুধু কিছু কিছু অদক্ষ বিচারক ও আইনজীবীর জন্য আইনের প্রতি দিন দিন সাধারণ মানুষের আস্থা কমে আসছে।’  সাবেক রাষ্ট্রপতি ও প্রধান বিচারপতি শাহাবুদ্দীন আহমদ ১৯৯৪ খ্রিষ্টাব্দের ১৩ নভেম্বর  গোপালগঞ্জ জেলা আইনজীবী সমিতির সভায় এ কথা বলেছিলেন।

১৯৯২ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ মার্চ তিনি বলেন, ‘বিচারকার্য সম্বন্ধে জনমনে অনেক প্রশ্ন উঠেছে এবং বিচারক ও আইনজীবী উভয়েই সমালোচনার সম্মুখীন হচ্ছেন।’ গুলশান ও বারিধারায় অবৈধভাবে আইনজীবী ও বিচারপতিদের বাড়ি বানানো প্রসঙ্গে তিনি এমন মন্তব্য করেছিলেন।

১৯৯৮ খ্রিষ্টাব্দের ২১ মার্চ রাষ্ট্রপতির বক্তৃতায় তিনি ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের বরাতে যে বিচার বিভাগকে ‘দুর্নীতিপরায়ণ ক্ষেত্র’ বলা হয়েছে, তার প্রতি আদালতের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, ‘যদি আদালতের প্রতি জনগণের আস্থা কমতে থাকে, তাহলে এর পরিণতি হবে ভয়ংকর।’ পাঠক, আমরা কি বিচারপতি শাহাবুদ্দিনের আশংকা করা সে ‘ভয়ংকর পরিণতি দেখছি?’

 

এবার আরেকটি প্রসঙ্গ। ‘লুঙ্গি, বারিধারা এবং জাতীয় সংসদ’ শিরোনামে ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দে একটি নিবন্ধ লিখেছিলাম প্রথম আলোতে। লুঙ্গিপরা রিকশাচালকদের এলাকায় প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে নিরাপত্তারক্ষীদের প্রতি বারিধারার বাড়ির মালিকদের সংগঠন বারিধারা  সোসাইটির নির্দেশনায় বলা হয়েছিল, ‘বারিধারায় প্রবেশ করতে হলে ট্রাউজার পরতে হবে।’ একজন টাকাওয়ালার  মেম সাহেবের অপছন্দ লুঙ্গি। সেই থেকে ঘটনার সূত্রপাত। সেই মেম সাহেবের নির্দেশে লুঙ্গিপরা এক রিক্শাওয়ালাকে বেদম পেটায় নিরাপত্তারক্ষীরা। প্রথম আলোয় প্রকাশিত আমার লেখাটি ব্যাপক আলোচিত হয়েছিল। বিভিন্ন পত্রিকায় প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।অবশ্য আদালতের নজরে আনলেও শুধু রুল জারিতেই সীমাবদ্ধ থাকার কথাই জেনেছি।

১১ নভেম্বর বনানীর রেইন ট্রি হোটেলে সাড়ে চার বছর আগে সংঘটিত ধর্ষণ মামলার রায়ে বিচারকের পর্যবেক্ষণ ও রায় নিয়ে তুমুল আলোচনা-সমালোচনা চলছে। আসামিরা আপন জুয়েলার্সের মালিকের ছেলে সাফাত; তার বন্ধুবান্ধব, দেহরক্ষী ও ড্রাইভারসহ মোট পাঁচজন। কয়েকমাস আগে আরেক শিল্পগ্রুপের অন্যতম মালিকের বিরুদ্ধে দায়ের করা কলেজছাত্রী মোসারাত জাহান মুনিয়া হত্যা মামলায় পুলিশের তদন্ত ও বিচারিক আদালতের রায় এখনও আলোচনায়। যদিও নতুন করে মামলা ও পুলিশের তদন্ত চলছে।

পাঠক, আদালত অবমাননার ভয় ও টাকাওয়ালাদের হামলা-মামলার কথা মাথায় রেখে ছোট্ট করে শুধু দুটি কথা বলেই লেখাটা শেষ করছি।

বরিশালের আঞ্চলিক ভাষায়, ‘রেন্ড্রি’ গাছ। আরেকটু প্রমিত বললে, রেইন ট্রি বা রেন্ট্রি গাছ। রেইন মানে বৃষ্টি আর ট্রি মানে গাছ। কিন্তু এই গাছ থাকলে বেশি বৃষ্টি হয় এমন কোনো তথ্য মেলেনি।  ছেলেবেলায় আমাদের বাসা সংলগ্ন পুকুরের পাড়ে একাধিক রেন্ট্রি গাছ ছিল। পুকুরটি সরু একটি খালের মাধ্যমে সরাসরি সুগন্ধা নদীর সঙ্গে যুক্ত ছিল। সে সুবাদে সরাসরি নদীর জোয়ার-ভাটার সঙ্গে পুকুরেও জোয়ারভাটা হতো। ঝড়-বৃষ্টির পর ভাটায় পানি কমলে পুকুর ও খালটিতে মাছ ধরার ধুম পড়ে যেত। নদীর সঙ্গে সংযোগ খালে যতটা মাছ পাওয়া যেত, পুকুরে ততটা না। আমরা এর কারণ খুঁজে পেতাম না। একদিন বড়দের কাছে জানতে চাইলে তারা জানালেন, ‘রেন্ড্রি গাছের পাতায় বিষ, পানিতে পড়লে মাছ দৌড়ে পালায়। রেন্ড্রি গাছের ছায়ার নিচে অন্য কোনো গাছও হয় না।’ ঘটনা সত্য। গত ১৫ বছরে দাদাবাড়িতে নিজ হাতে শত শত চারাগাছ লাগিয়েছি। কিন্তু একটাও রেন্ট্রি না।

টাকাওয়ালাদের বারিধারায় লুঙ্গিপরা রিকশাওয়ালাকে পিটুনির জন্য কাউকে শাস্তি পেতে হয়নি। গুলশানের মুনিয়া হত্যার প্রথম মামলায় পুলিশের প্রতিবেদন ও বিচারিক আদালতে ‘কাউকে’ দোষী পাওয়া যায়নি! বনানীর রেইন ট্রি হোটেলে ধর্ষণকাণ্ডে অভিযুক্ত বিখ্যাত স্বর্ণ ব্যবসায়ীর  ছেলে ও বন্ধুবান্ধব সবাই খালাস। রেইন ট্রি গাছ ও গাছের মালিকদের ঝাঁজ আরেকবার মনে করিয়ে দিলেন পুরান ঢাকার জনসন রোডস্থ আদালতের বিচারক!

সম্পদশালী ও প্রভাবশালীদের এলাকা বারিধারা-গুলশান-বনানীতে যদি সামনে আরো কিছু ঘটে, তাহলে আমরা শুধু ভারতের এলাহাবাদ হাইকোর্টের সে রায়ে উল্লেখিত ‘সম্পদশালীরা অর্থের বিনিময়ে তাদের অনুকূলে রায় নিশ্চিত করতে পারেন, দরিদ্ররা কোনো বিচার আশা করতে পারেন না। বিচারকরা ‘মধু বালা আওর মধু হালা’র প্রলোভনেও পড়েন।’ কথামালা স্মরণ করে আর দুই যুগ আগে রাষ্ট্রপতি বিচারপতি শাহাবুদ্দীনের আশঙ্কাকে সত্য বলে নিজ নিজ পাঠে মন দেবো। সম্পদশালীদের বিষয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করবো না। বিচারপতিদের বিচার ‘আজ জেগেছে এই জনতা’ করবেন এই স্বপ্নে বিভোর থাকবো। 


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না - dainik shiksha সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু - dainik shiksha চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় - dainik shiksha প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট - dainik shiksha রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0025911331176758