এমপিওভুক্ত শিক্ষকের ওভারটাইম!

মো. ইউসুফ আলী |

চাকরিজীবীদের কাছে বহুল পরিচিত শব্দ ওভারটাইম। শুধু অপরিচিত এমপিওভুক্ত নামে অদ্ভুত চাকরিজীবী বেসরকারি শিক্ষক। অদ্ভুত বললাম এ কারণে এমপিও নামে জগাখিচুড়িভাবে বেতনাদি পৃথিবীর আর কোনো দেশে হয় কি না জানা নেই। স্বাধীনতার পর সমাজের দানশীল ও শিক্ষানুরাগী ব্যক্তিরা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে গড়ে তোলেন মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং নিজস্ব অর্থায়নে তা পরিচালিত করতে থাকে, যা দেশের মাধ্যমিক শিক্ষা প্রসারে মূল ভূমিকা রাখে। এসব গুণীজনের মহৎ কর্মের ফলেই দেশের শিক্ষার হার বর্তমান পর্যায়ে আসতে পেরেছে। এসব গুণীজন রাষ্টীয়ভাবে সম্মান পাওয়ার দাবিদার হলেও তা পান না। রাষ্ট্রপক্ষ থেকে যেমন সম্মান পাচ্ছেন না, তেমনি নিজ হাতে গড়া প্রতিষ্ঠানেও খুব কমই স্মরণ করা হচ্ছে। অথচ নামে বেনামে কতো অনুষ্ঠান করে শিক্ষার পরিবেশের বিঘ্ন ঘটে। ব্যক্তি পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে কর্মরত শিক্ষকদের সরকার কয়েক মাস পর পর নামকাওয়াস্তে অনুদান দিতো। 

 

পরবর্তীতে শিক্ষকরা জাতীয় স্কেলে অন্তর্ভুক্ত হয়ে স্কেলের ভগ্নাংশের একটা অংশ পেতে শুরু করেন। এর নাম দেয়া হয় এমপিও, পদবি নির্ধারণ হয় বেসরকারি শিক্ষক যা অদ্যাবধি চলমান। অনেকেই টিটকারি করে বলেন, যার নাই গতি, সে করে মাস্টারি! সম্ভবত এই গতিহীনদের সস্তায় খাটানোর জন্যই অদ্ভুত এমপিও প্রচলন। সস্তায় খাটানোরও তো একটা ন্যূনতম বিধি আছে। আমাদের দেশে গার্মেন্টসগুলো সস্তায় শ্রমিক খাটায়। এই শ্রমিকদেরও কর্মঘণ্টা শেষে মাগনা খাটাতে পারে না। কর্মঘণ্টা শেষে ঘণ্টা হিসেবে অতিরিক্ত কাজ করাতে পারে কোম্পানি। দেশের অধিকাংশ প্রাইভেট কোম্পানিতে ওভারটাইমের সুযোগ আছে।যদিও অন্যান্য দেশের তুলনায় ওভার টাইমের মজুরি কম। ব্যতিক্রম শুধু এমপিওভুক্ত শিক্ষক। শিক্ষার্থীর জন্য, দেশের জন্য অনেক সময়ই শিক্ষকদের অতিরিক্ত কাজ করতে হয়। কিন্তু সে কাজের কোনো সম্মানী পান না। 
এ ব্যাপারটা এ রকম শিক্ষকদের কোনো সুবিধা দিতে গেলই অর্থসংকট দেখা দেয়। শিক্ষকদের অভিযোগ ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দে এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের আন্দোলনের শাস্তি হিসেবে গ্রীষ্মের ছুটি বাতিল করা হয়েছিলো। এবারও গ্রীষ্মের ছুটি বাতিল। শিক্ষার্থীদের কল্যাণে ছুটি বাতিল হতেই পারে। শিক্ষার্থীদের কল্যাণে অতিরিক্ত ক্লাস হবে, শিক্ষকের কল্যাণে সামান্যও কিছু করা হবে না কেনো? একপেশে ভালোবাসা হয় না। এমনিতেই শিক্ষক সমাজ অর্থনৈতিকভাবে অবহেলিত। বিশেষ করে যারা দূরদূরান্তে কর্মরত তাদের নিদারুণ কষ্টের কথা পত্র পত্রিকায় বারবার ছাপানো হচ্ছে। নতুন যোগদান করা শিক্ষক ১২ হাজার/১৬ হাজার টাকা বেতন দিয়ে সংসার চালাতে দিশেহারা, মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। এতে শিক্ষার মতো গুরু দায়িত্ব পালন বিঘ্নিত হচ্ছে। বর্তমান বাজারে একজন শিক্ষকের গড় দৈনিক আয় হচ্ছে ৪০০-৭০০ টাকা। এই আয় দিয়ে ন্যূনতম সম্মান নিয়ে সমাজে চলা দায়। এমনকি ক্লাসে যে ধরনের পোশাক পরিধান করে যেতে হয় তাও সম্ভব হচ্ছে না। রংপুরের বাসিন্দাকে সিলেট/চট্টগ্রাম পোস্টিং দেয়া হয়। অর্থের অভাবে নিকটজনের দাফনেও অংশ নিতে পারেন না। এর চাইতে কষ্টের আর কী হতে পারে? এমপিও শিক্ষকেরা বদলির জন্য আন্দোলন করে যাচ্ছেন। 

এদিকে, শিক্ষামন্ত্রী সাফ জানিয়ে দিয়েছেন এমপিও শিক্ষকদের নিয়োগদাতা যেহেতু মন্ত্রণালয় নয়, বদলিও মন্ত্রণালয়ের নয়। মন্ত্রীর কথা যৌক্তিক ও বিধিসম্মত কতোটুকু? মন্ত্রীর কথা যৌক্তিক হলে এমপিও শিক্ষকদের বেতন ভাতাদি হয় কীভাবে? এ জন্যই বলছি, এমপিওভুক্ত শিক্ষক এক অদ্ভুত চাকরিজীবী। শিক্ষকদের বদলির দাবি যৌক্তিক হলেও বাস্তবায়ন কঠিন। সিলেট অঞ্চলে মাধ্যমিক স্কুল ও কলেজ পর্যায়ে স্থানীয় শিক্ষকের যে সংকট তা পূরণ অন্য জেলা থেকে করার বিকল্প নেই। সরকারি চাকরিজীবীদের মফস্বল এলাকা ও শহর এলাকা বাড়িভাড়া সমান নয়। দুর্গম এলাকায় যাতায়াতসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বেশি। এমপিও শিক্ষকদের বেলায় তা হয় না কেনো? দিনাজপুর, সাতক্ষীরা থেকে সিলেটে নিয়োগ দিলে এই শিক্ষকের যাতায়াত, থাকা, খাওয়া ১২ হাজার টাকা দিয়ে একাই চলা কঠিন। পরিবারের অন্য সদস্যদের খরচ কে যোগাবে? ৫০০-৭০০ কিমি দূরে পোস্টিং দিয়ে ১ হাজার টাকা বাড়িয়ে দেয়া হয়, যাতায়াত ভাড়া নেই যা শুধু উপহাস নয় নীলকরদের আচরণ! সোজা হিসাব বুঝতে না চাইলে মানসম্মত শিক্ষার জন্য যতো ঢাক ঢোল পেটানো হোকনা কেনো, কোনো ফল পাওয়া যাবে না। শিক্ষাক্ষেত্রে আমাদের পজিটিভ চিন্তার ঘাটতি রয়েছে। যতোক্ষণ পর্যন্ত পজিটিভ চিন্তার উন্মেষ হবে না, ততোক্ষণ পর্যন্ত মানসম্মত শিক্ষাও নিশ্চিত করা যাবে না।

লেখক: সহকারী প্রধান শিক্ষক, দনারাম উচ্চ বিদ্যালয়, সিলেট।

 


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় ধর্মীয় শিক্ষা বাধ্যতামূলক করার দাবি - dainik shiksha শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় ধর্মীয় শিক্ষা বাধ্যতামূলক করার দাবি কারিগরি শিক্ষকদের অক্টোবর মাসের এমপিওর চেক ছাড় - dainik shiksha কারিগরি শিক্ষকদের অক্টোবর মাসের এমপিওর চেক ছাড় সরকারি কর্মচারীদের ৯ দফা নির্দেশনা - dainik shiksha সরকারি কর্মচারীদের ৯ দফা নির্দেশনা স্কুল-কলেজে বেতন ছাড়া সব ফি বেঁধে দিলো সরকার - dainik shiksha স্কুল-কলেজে বেতন ছাড়া সব ফি বেঁধে দিলো সরকার সব শিক্ষকের স্বার্থ সংরক্ষণ করে বদলির নীতিমালা : সাক্ষাৎকারে শিক্ষা উপদেষ্টা - dainik shiksha সব শিক্ষকের স্বার্থ সংরক্ষণ করে বদলির নীতিমালা : সাক্ষাৎকারে শিক্ষা উপদেষ্টা ঢাবিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা রেখেই ভর্তি কার্যক্রম - dainik shiksha ঢাবিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা রেখেই ভর্তি কার্যক্রম ক্যামব্রিয়ানের বাশারকে গ্রেফতারের দাবিতে আন্দোলন অব্যাহত - dainik shiksha ক্যামব্রিয়ানের বাশারকে গ্রেফতারের দাবিতে আন্দোলন অব্যাহত শিক্ষক নিবন্ধন ভাইভা: অষ্টম দিনে যেসব প্রশ্নের মুখোমুখি - dainik shiksha শিক্ষক নিবন্ধন ভাইভা: অষ্টম দিনে যেসব প্রশ্নের মুখোমুখি কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করা কল্যাণের হবে না: ছাত্রদল সম্পাদক - dainik shiksha ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করা কল্যাণের হবে না: ছাত্রদল সম্পাদক দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক - dainik shiksha কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0021951198577881