জাতির প্রত্যাশা পূরণে মেধাবী শিক্ষার্থীদের ভূমিকা

আকমল হোসেন |

অবস্তুগত এবং অদৃশ্যমান জিনিসের অধিকাংশই আপেক্ষিক। এই কারণেই এর সর্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা নেই। বিশ্বাস, অনুভূতি বা উপলব্ধির মাধ্যমে এ সব বিষয়ে ব্যক্তির প্রতিক্রিয়া প্রকাশিত হয়। ভাবুকদের ক্ষেত্রে এ বিষয়টা বেশি পরিলক্ষিত।বস্তুগত জিনিসের গুণ বা দোষের ক্ষেত্রেও আপেক্ষিক অবস্থা বিদ্যমান। ভালো-মন্দ, খারাপ,সুন্দরের মাত্রাগত ভিন্নতা যেমন সত্য, তেমনি সত্য এগুলো সম্পর্কে ব্যক্তির মতের এবং পছন্দের ভিন্নতা। একটা সুন্দর জিনিস একজনের  কাছে যতটা সুন্দর অন্যের কাছ তা সমভাবে সুন্দর নাও হতে পারে। বর-কনে বিয়ের ক্ষেত্রে পছন্দের হের-ফের সহজে ধরা সম্ভব-ফলে কালো, বোবা, কানা কেউই পড়ে নেই। সবারই দাম্পত্য জীবন দৃষ্টিগোচরে থাকে। তেমনিভাবে ভালো ছাত্র-ছাত্রীদের ভালোত্বের অবস্থানও আপেক্ষিক। তবে ভালোর প্রতি মোটা দাগে সবারই ইতিবাচক একটা ধারণা লক্ষ্যণীয়।

সম্প্রতি দেশের দশটি শিক্ষাবোর্ডের এস.এস.সি পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়েছে। ১৯ লাখ ৯৪ হাজার ১শ’ ৩৭ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে ১৭ লাখ ৪৩ হাজার ৬শ’ ১৯ জন পাস করেছে। এদের মধ্যে জিপিএ ৫+ পেয়েছে ২ লাখ ৬৯ হাজার ৬শ’ ২ জন। এসব ভালো ছাত্র-ছাত্রীর কৃতিত্ব, তাদের ধন্যবাদ জ্ঞাপন, তাদের ভবিষ্যৎ ইচ্ছা, বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক, পেশাজীবী এবং ছাত্র সংগঠনের পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা জানানোর খবর বিভিন্ন ইলেক্ট্রোনিক্স ও প্রিন্ট মিডিয়ায় প্রকাশিত হচ্ছে এবং হবে। এ সমস্ত খবর মিডিয়ার পক্ষ থেকে অথবা ভালো ছাত্র-ছাত্রীদের পক্ষ থেকে প্রকাশ করা হয়েছে। গুণের সমাদর না থাকলে সমাজে গুণীজনের সৃষ্টি হয় না। সেদিক থেকে এই প্রচারটা জাতির জন্য সুখবর। ছাত্র-ছাত্রীরা তাদের ভবিষ্যৎ লক্ষ্যের কথা প্রকাশ করেছে-কেউ ডাক্তার হবে, কেউ প্রকৌশলী হবে, কেউ সাংবাদিক এবং ব্যারিস্টার হবে।এগুলো তাদের স্বপ্ন অর্থাৎ ভবিষ্যৎ কাজের আগাম সিদ্ধান্ত। ব্যবস্থাপনার ভাষায় এটাকেই পরিকল্পনা বলে। পরিকল্পনা সভ্য জাতির মাইলফলক। জানি না, ছাত্র-ছাত্রীদের চাওয়া কতটুকু বাস্তবে রূপ নেবে। কারণ চাওয়া ও পাওয়ার মধ্যে দ্বন্দ্ব আজীবনের। সেই কারণেই হয়তো কবি লিখেছেন, ‘যাহা চাই তাহা ভুল করেই চাই/যাহা চাই তাহা পাই না।তবে পাওয়ার জন্য চাওয়াটার লিমিট থাকতে হবে। বিবেচনা করতে হবে চাওয়ার যোগ্যতা, ইচ্ছা, সামর্থ্য এবং সামাজিক সুযোগ- সুবিধাকে। 

দুঃখজনক হলেও সত্য সেই অর্থে ভালো হওয়ার পরিবেশ নেই। শিক্ষার আদর্শিক সঙ্কট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অস্থিতিশীল পরিবেশ, অভিভাবকের আর্থিক সংগতির অভাব, চাকরির ক্ষেত্রে উৎকোচ, দলীয়করণ এবং স্বজনপ্রীতি, এবং উৎকোচ গ্রহণ, পুলিশ ও র‌্যাবের ছিনতাই, ডাকাতি, রাজনীতিক ও ব্যবসায়ীদের অবাধ লুটপাট, পরপর ৫ বার বিশ্বে দুর্নীতিতে প্রথম হওয়ার ঘটনা- সব মিলে এ সমাজ ভালো হওয়ার অনুপ্রেরণা দেয় না, বরং হতাশ করে মানুষকে। ফলে ছাত্র-ছাত্রীর ভালো হওয়া ঝুঁকির মুখে। এই বলে জীবন-সংগ্রামকে থামানো যাবে না। সমস্যা থাকলে সমাধানের পথও আছে। আশা করি, রাষ্ট্রের কর্ণধাররা মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য অনুকূল পরিবেশ নিশ্চিত করবেন। কারণ, এই ছাত্র-ছাত্রীরাই আগামীতে দেশ পরিচালনা করবেন।তবে দু-চারজন যে লুটপাটকারী, ঘুষখোর,নারী নির্যাতক ও যৌতুকলোভী হবেন না, এমন আশা করা যায় না। কারণ, বিদ্যমান বাস্তবতা তাদেরকে স্পর্শ করবে না-এমন নিশ্চয়তা কোথায়? দেখতে দেখতে মানুষ অনেক শেখে। ভালো হওয়ার জন্য ভালো সঙ্গ, পরিবেশ, অনুকরণীয় আদর্শ ব্যক্তিত্ব সামনে থাকতে হয়। কিন্তু এটা কমতে কমতে এখন শূন্যের কোঠায়। যোগ্যতা, সততা-জ্ঞান-গরিমাসম্পন্ন ব্যক্তিত্বদের অন্ধকারে রেখে টাকাওয়ালাদের উপস্থিতি আজকের প্রজন্মের সামনে প্রদর্শিত হচ্ছে।

 

ছেলে-মেয়েদের মধ্যে মুজিব, মণি সিংহ, মোজাফফর আহমেদ, সুকান্ত-নজরুল, রোকেয়া-প্রীতিলতা হতে চাওয়ার সংখ্যা খুবই কম। শিক্ষা, সংস্কৃতি, সাহিত্য, খেলাধুলা, সকল ক্ষেত্রেই বিপথগামী রাজনীতির হস্তক্ষেপ,দলীয়করণের ভূত সৃষ্টিশীলতার পথে অন্তরায় সৃষ্টি করছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে ভালো ফল করার পর ক্ষমতাসীন দল না করার কারণে চাকরি না হয়ে দলীয় আনুগত্যে তুলনামূলক কম মেধাবীর চাকরি হয়। থানা, কোর্ট ও বিচারালয় দলীয় নির্দেশনা আর উৎকোচে যেভাবে প্রভাবিত হচ্ছে,তাতে সাধারণ মানুষের নির্ভরতার জায়গা শেষ হয়ে যাচ্ছে। স্বজনপ্রীতি, লুটপাট, ভোগবিলাস অন্যদিকে অধিকারবঞ্চিত বিশাল মানুষের লাইন, এ অবস্থা বেশি দিন টিকে থাকবে না, অবশ্যই প্রতিরোধ হবে, তবে সময়ের ব্যাপার মাত্র।

ভালো ছাত্র-ছাত্রীদের ভালো হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় সকল ব্যবস্থা করার দায়িত্ব পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের। এরপর তাদের কাছে জাতি প্রত্যাশা করতে পারে অনেক কিছু। কিছু দেওয়া ছাড়া পাওয়ার আশা করা যুক্তিহীন। সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে সুবিধা পেয়েছে,এমন ভালো ছাত্ররা জাতির জন্য অবদান রাখছেন তাতে প্রত্যাশা করাও আরেক বোকামি। জনতার খাজনা বা ভর্তুকি করের টাকায় ক্ষমতাবানদের সন্তানরা উচ্চশিক্ষিত হওয়ার পর জাতির কথা ভুলে ব্যক্তিগত ভোগ-বিলাস ও ঐশ্বর্যের খোঁজে বিদেশে পাড়ি জমান। তারা যা কিছু করছেন নিতান্তই ব্যক্তিগত স্বার্থে। চিকিৎসা ও শিক্ষার মত মৌলিক অধিকারও মোটা অংকের টাকায় কিনে নিতে হচ্ছে। আজকের রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি সবকিছুই মুষ্টিমেয় রাজনীতিক, সামরিক ও প্রশাসনিক আমলাদের হাতে। সমাজের ১০ লাখ বিত্তশালী পরিবারের ৪০ লাখ মানুষের ভোগ-বিলাসের যোগান দিতে ব্যস্ত রাষ্ট্রীয় যন্ত্র। ৯ কোটি দরিদ্র। যাদের মৌলিক অধিকার পূরণের মত আয় রোজগার বা সম্পদ নেই। প্রাক্তন মেধাবীদের আচরণ থেকে বর্তমান মেধাবীদের প্রতি প্রত্যাশা করতে সন্দিহান করে।তারপরও আশাহত হওয়ার সুযোগ নেই, আশাহতদের আশাবাদী করতে কবি লিখেছেন ,সংসার সাগরে দু:খ-তরঙ্গের খেলা/আশা তার একমাত্র ভেলা।ভালো ছাত্র-ছাত্রীরা জাতির প্রত্যাশার প্রতি শ্রদ্ধা দেখাবেন এটা আমরাও আশা করি।স্বদেশের উপকারে নাই যার মন, কে বলে মানব তারে, পশু সেই জন।আশা করি, সমাজ-জাতিকে বাদ দিয়ে ভোগবাদী ইতর প্রাণির দলভুক্ত এই ভালো ছাত্র-ছাত্রী হবেন না। ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠা, ভোগ-বিলাস আর আরাম-আয়েসের জন্য সবকিছুর মধ্যেই ইতর প্রাণীর বৈশিষ্ট্য প্রতিফলিত হয়। মানুষ হতে প্রয়োজন মানবিকতা, দেশপ্রেম, মানবপ্রেম, সবার সুখ-দুঃখকে ভাগাভাগি করে নেওয়ার মানসিকতা। ছাত্ররা অনেক কিছুই হতে চেয়েছেন, তবে কেউ প্রকাশ করেননি একজন ভালো মানুষ হওয়ার কথা। বিশাল ডিগ্রি  আর পান্ডিত্য দিয়ে ভালো হওয়া যায়, তবে সেই ভালো সমাজের খুব একটা কাজে আসে না। ভালো ছেলে আমরা অনেক পেয়েছি, বৃত্তি পাওয়া ছেলে, টেবিলের ওপর একরাশ বই খোলা, চোখে নিকেলের চশমা, খেলার সময়ও গায়ে আলোয়ান জড়িয়ে বই পড়েন,বছরে বছরে পরীক্ষায় প্রথম হয়ে প্রাইজ পান,পাড়া-প্রতিবেশীর সুখ-দুঃখের সাথে কোনো সম্পর্ক নেই। যথাকালে একান্ত একটি ডিগ্রি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে আসেন,তারপর একজন উকিল অথবা সম্পাদক অথবা প্রফেসর হয়ে মানবজীবনে পরম পুরুষত্ব লাভ করেন। সুন্দরী কনের জন্য তখন অনুসন্ধান চলে। কনের পিতাকে পথে বসিয়ে যথারীতি বিয়ের কাজ সম্পন্ন করা হয়। তারপর সমূহ বিপদকে দূরে রেখে ঢিমে তালে সংসার যাত্রা অগ্রসর হতে থাকে। ছেলের অন্নপ্রাশন, অলঙ্কার নির্মাণ এবং কন্যার বিয়ের মধ্য দিয়ে কবর আর শ্মশানের দিকে বয়সকালের ডাক আসে পরপার থেকে। এইভাবেই তার মানবলীলা সাঙ্গ হয়। সবাই বলে, আহ! লোকটা কত ভালো ছিল। সেরূপ জাতি ভালো ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে ডিগ্রি নয়, মানবিকতা, দেশপ্রেম আর মানবপ্রেম প্রত্যাশা করে।বিভিন্ন ছাত্রসংগঠন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের ব্যানারে কৃতি ছাত্র-ছাত্রীদের দেয়া হচ্ছে সংবর্ধনা । অতএব মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের রাজনীতির সাথে সম্পর্ক থাকবে, ছাত্র-সমাজের দাবি আদায়ের জন্য ভবিষ্যৎ ভালো  রাজনীতিক হওয়ার জন্য, কিন্তু রাজনৈতিক দলের ক্ষমতা দখল আর ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য ভাড়াটিয়া লাঠিয়াল বাহিনী হিসেবে নয়। সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, কালো টাকা উপার্জন আর ধর্ষণনির্ভর রাজনীতি থেকে অবশ্যই তাকে নিরাপদ রাখতে হবে। বাধা আসলেও বিপথগামী হবো না- এমন দৃঢ়তা রাখতে হবে। মানুষের জন্য ভালো কিছু করতে না পারলেও খারাপ করা থেকে বিরত থাকলেও জাতি নিরাশ হবে না, বঞ্চিত হবে না মানুষ তার অধিকার থেকে। ডিগ্রিধারী মানুষের প্রতি খারাপ ধারণা পোষণ করবে না জগতবাসী। ভাল/মেধাবী ছাত্রদের কাছ থেকে জাতি মানবতা আর দেশপ্রেম আশা করে। এই  প্রত্যাশা করা নিশ্চয় কোনো অপরাধ নয়।

লেখক : আকমল হোসেন, যুগ্ম-সম্পাদক, বাংলাদেশ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি (বাকবিশিস)


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না - dainik shiksha সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু - dainik shiksha চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় - dainik shiksha প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট - dainik shiksha রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0048189163208008