পদসৃজনে বাধা দেয়া সেই অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে দুদকের মামলা

নিজস্ব প্রতিবেদক |

শিক্ষকদের পদসৃজনের কাজে বাধা দেয়া পাবনার চাটমোহর ডিগ্রি কলেজের বরখাস্তকৃত অধ্যক্ষ মিজানুর রহমানের বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। প্রায় ৬০ লাখ টাকার তথ্য গোপন এবং ৬৪ লাখ টাকা মূল্যের জ্ঞাত আয়ের উৎসবহির্ভূত সম্পদ ভোগদখলের অভিযোগ আনা হয়েছে তার বিরুদ্ধে।

গতকাল সোমবার (১২ এপ্রিল) পাবনা দুর্নীতি দমন কমিশন সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে মামলাটি দায়ের করেন সহকারী পরিচালক মো. আতিকুর রহমান। মামলাটি গতকালই আদালতে উপস্থাপন করা হয়েছে।

আরও পড়ুন: শিক্ষকদের পদসৃজনে বাধা দেয়া সেই অধ্যক্ষ বরখাস্ত

চাটমোহর কলেজ অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা

চাটমোহর সরকারি কলেজে শিক্ষকদের ক্লাস বর্জন অব্যাহত

অধ্যক্ষ মিজানের অপসারণ দাবিতে উত্তাল চাটমোহর

অধ্যক্ষের অপসারণ দাবিতে সরকারিকৃত চাটমোহর কলেজে অচলাবস্থা

সরকারিকৃত চাটমোহর কলেজের অধ্যক্ষের যত অনিয়ম

চাটমোহর সরকারি কলেজশিক্ষক কক্ষ তালাবদ্ধ, অধ্যক্ষের কক্ষের সামনে শিক্ষকদের অবস্থান

এর আগে গতবছরের ৫ ফেব্রুয়ারি অধ্যক্ষ মিজানকে বরখাস্ত করা হয়। দীর্ঘদিন ধরে অধ্যক্ষকে অপসারণ করার দাবি জানাচ্ছেন কলেজের শিক্ষক-কর্মচারীরা।

দুদকের এজাহার সূত্রে জানা গেছে, মিজানুর রহমান সম্প্রতি দুদকের নোটিশের পরিপ্রেক্ষিতে নিজের সম্পদ বিবরণী দাখিল করেন। সেখানে উল্লেখ করা হয়, তিনি আটটি দলিলে ১ দশমিক ০২৫ একর জমির মালিক। চাটমোহরে তিনটি দোকানঘর ও একটি পুরাতন বাড়িসহ এক কোটি ১৬ লাখ ৩১ হাজার ৫৩৩ টাকায় কিনেছেন। তিনি ঈশ্বর্দীর মাজদিয়া মৌজায় কেনা জমিতে বাংলাদেশ ফাইন্যান্স কর্পোরেশন থেকে ৫০ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে ১৫৫০ বর্গফুটের ৪ তলা বিল্ডিং নির্মাণ করেন। দুদক তার এই তথ্য চ্যালেঞ্জ করে গণপূর্তের প্রকৌশলী নিয়ে চার তলা ভবন নির্মাণে প্রকৃত খরচ বের করার চেষ্টা করে। মিজানুর রহমানের উপস্থিতিতেই এই হিসাব করা হয়। এরপর পাবনার গণপূর্তের নির্বাহী প্রকৌশলী দুদককে জানান, ২০১৫-২০১৬ সালে নির্মিত ৫ তলা ফাউন্ডেশন দেওয়া ৪ তলা বাড়ির ঠিকাদারি লভ্যাংশ ও তদারকি ব্যয় বাদ দিয়ে প্রকৃত ব্যয় ১ কোটি ৯ লাখ ৯৪ হাজার ২৮১ টাকা পাওয়া যায়। অর্থাৎ প্রকৌশলীর মতামত অনুযায়ী মিজানুর রহমান দাখিলকৃত সম্পদ বিবরণীতে ৪ তলা বিল্ডিং নির্মাণে ঋণ গ্রহণের ৫০ লাখ টাকার অতিরিক্ত আরও ৫৯ লাখ ৯৪ হাজার ২৮১ টাকা কম প্রদর্শন করেন। দুদক বলছে, তার সম্পদ হচ্ছে এক কোটি ৮০ লাখ ২৭ হাজার টাকা। আর দাখিলকৃত সম্পদ বিবরণীতে প্রদর্শন করেন এক কোটি ১৬ লাখ ৩১ হাজার ৫৩৩ টাকা। অর্থাৎ ৬৪ লাখ ২০ হাজার টাকার কোনো বৈধ দালিলিক রেকর্ডপত্র পায়নি দুদক।

এ কারণে দুদক মনে করছে, অবৈধ পন্থায় অর্জিত স্থাবর-অস্থাবর সম্পদে বিনিয়োগ করেছেন। বিয়ের সময় শ্বশুর বাড়ি থেকে আসবাবপত্র বাবদ দেড় লাখ টাকা নেয়ার কথাও উল্লেখ করেছেন সম্পদ বিবরণীতে। ৬৪ লাখ ২০ হাজার টাকার স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ অবৈধভাবে ভোগ দখল ও তথ্য গোপন করে মিজানুর রহমান দুর্নীতি দমন কমিশন আইন ২০০৪ এর ২৭(১) ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন।

এদিকে বিভিন্ন অভিযোগের প্রেক্ষিতে ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দে অধ্যক্ষ মিজানুর রহমানের বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্তের নির্দেশ দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর তদন্ত কমিটি গঠন করে। এরমধ্যেই একটি মামলায় গ্রেফতার হন অধ্যক্ষ মিজান। পরে, কমিটি প্রতিবেদন জমা দেয়ার পর অধ্যক্ষ মিজানুর রহমানকে বরখাস্ত করা হয়। 

অধ্যক্ষ মিজানকে সাময়িক বরখাস্ত করে জারি করা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সচিব মাহবুব হোসেন স্বাক্ষরিত আদেশে বলা হয়েছিল, অধ্যক্ষ মিজানুর রহমানের বিরুদ্ধে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্ত করে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর। মিজানুর রহমান তদন্ত কর্মকর্তাদের কোনো রকম সহযোগিতা করেননি, বরং নানাভাবে বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা করেছেন। তদন্ত কমিটির সাথে অধ্যক্ষের এমন ঔদ্ধত্যপূর্ণ অসদাচরণ ও তদন্ত কাজে নানাভাবে বাধা দেয়ার চেষ্টা তার বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্যতা প্রমাণ পেয়েছে। এছাড়া কলেজটি নিয়ে শিক্ষক-কর্মচারী ও অধ্যক্ষের মধ্যে বিভক্তি, এলাকায় অধ্যক্ষের অপকর্ম বিরোধী কর্মসূচি পালন ও উত্তেজনাকর পরিবশের সৃষ্টি হচ্ছে। 

এসব কারণ দেখিয়ে গত বছরের ২৬ জানুয়ারি তারিখ থেকে ভূতাপেক্ষভাবে মিজানুর রহমানকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়। এরপর থেকে তিনি আর কলেজেও যাচ্ছেন না। অধ্যক্ষের কক্ষটি তালাবদ্ধ রয়েছে। ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ আব্দুল মজিদ অন্য আরেকটি কক্ষে অফিস করছেন। কলেজের যাবতীয় নথিপত্র, সরঞ্জামাদি ও অনলাইন পাসওয়ার্ডসহ কোনো কিছুই ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষকে বুঝিয়ে দেয়া হয়নি।

এমনকি শিক্ষক-কর্মচারীদের আত্মীকরণের কাগজপত্র এখনও মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক অধিদপ্তরে পাঠানো হয়নি। ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দে চাটমোহর ডিগ্রি কলেজটি সরকারি হয়। এরপর মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে কয়েক দফা চিঠি দেয়ার পরও সাবেক অধ্যক্ষ মিজানুর রহমান শিক্ষক-কর্মচারীদের ব্যক্তিগত নথি পাঠাননি। এরপর ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ আব্দুল মজিদও গত এক বছরে এ সংক্রান্ত নথিপত্র পাঠাতে ব্যর্থ হয়েছেন। এ অবস্থায় সৃষ্ট সংকট নিয়ে শিক্ষক-কর্মচারীদের মধ্যে চরম হতাশা বিরাজ করছে।

জানা গেছে, অধ্যক্ষ মিজানুর রহমান ঈশ্বরদীর দাশুরুরিয়া কলেজে প্রভাষক হিসেবে প্রথম এমপিওভুক্ত হন ১৯৯৪ খ্রিষ্টাব্দের জুলাই মাসে। শেষ এমপিও ২০০৪ খ্রিষ্টাব্দের এপ্রিলে। দাশুরিয়া কলেজের তার চাকরির অভিজ্ঞতা ছিল নয় বছর নয় মাস। দাশুরিয়া কলেজে মাত্র ৯ বছর ৯ মাসের অভিজ্ঞতা নিয়ে ও সহকারী অধ্যাপকের অভিজ্ঞতা না থাকলেও একই বছরের ১৫ আগস্ট নিয়ম বহির্ভূকভাবে পাবনার ফরিদুপরের দিঘুলিয়া এ জেড হাইস্কুল অ্যান্ড কলেজ অধ্যক্ষ হিসেবে যোগদান করেন। সে তারিখ থেকেই এমপিওভুক্ত হন তিনি, যা নিয়ম বহির্ভূত।

গত ২০১১ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ জুলাই চাটমোহর ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে যোগদান করেন তিনি। যোগদানের পরেই ব্যাপক দুর্নীতি শুরু করেন বলে অভিযোগ শিক্ষকদের। অধ্যক্ষ মিজানুর রহমান কলেজ সরকারি হওয়ার আগে পরিচালনা কমিটিকে না জানিয়ে ব্যাক ডেটে রেজুলেশন টেম্পারিং, কাটাকাটি, ঘষামাজা ও কম্পিউটার দ্বারা স্ক্যান করে জনবল কাঠামোর অতিরিক্ত ২১ জন ভুয়া শিক্ষককে নিয়োগ দিয়েছেন বলেও অভিযোগ আছে। নিয়োগের সময় তিনি প্রায় এক কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। 

২০১৮ খ্রিষ্টাব্দের ৮ আগস্ট থেকে সারাদেশের আরও ২৭১টি কলেজের সাথে পাবনার চাটমোহর ডিগ্রি কলেজ সরকারি হয়। পরে ২৭ আগস্ট বেসরকারি আমলে গভর্নিং বডি বিলুপ্ত হয়ে চাটমোহর উপজেলা নির্বাহী অফিসার কলেজ পরিচালনার দায়িত্ব পান। সেই দিন থেকে ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ জানুয়ারি পর্যন্ত অধ্যক্ষ দুই লাখ ৯১ হাজার ৭৯০ টাকার অর্থিক অনিয়ম করেছেন বলে জানা গেছে। 

অভিযোগ রয়েছে, বিজ্ঞান গবেষাণাগারের যন্ত্রাপতি ও দ্রব্যাদি ক্রয়, কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি ও সেমিনার লাইব্রেরির বই কেনা, প্রশংসাপত্র বাবদ বিনা রশিদে জনপ্রতি ৩৪০ টাকা হারে আদায় করেন অধ্যক্ষ। ভর্তি ও ফরম পুরণে সরকারি নির্ধারিত ফিয়ের অতিরিক্ত টাকা আদায় করেন। এ নিয়ে রাবেয়া খাতুন নামের এক শিক্ষার্থী দুদকে অভিযোগ করেন। বিষয়টি এখনও তদন্তাধীন রয়েছে। 

এছাড়া, শিক্ষার্থীদের পরিচয়পত্র দেয়ার নামে বিনা রশিদে জনপ্রতি ১৪০ টাকা হারে আদায় করা হয়। পাঠদানের বিষয় নবায়ন, শিক্ষকদের এমপিওভুক্তকরণ ইত্যাদি ক্ষেত্রে লাখ লাখ টাকা আত্মাসাৎ করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে অধ্যক্ষ মিজানুর রহমানের বিরুদ্ধে।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না - dainik shiksha সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু - dainik shiksha চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় - dainik shiksha প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট - dainik shiksha রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0026309490203857