পুরনো কারিকুলামে ফেরা

খাজা মোহাম্মদ মুস্তাকিম |

একজন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক, স্কুলের ক্লাসরুমে বসে ১৯৯০ এর দশকের শিক্ষাকালকে স্মরণ করছিলেন। তিনি ভাবছিলেন, কেমন ছিলো সেই সময়ের শিক্ষা, যখন শিক্ষার্থীদের মধ্যে গভীর দেশপ্রেম, নৈতিকতা এবং সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ ছিলো। তখনকার কারিকুলাম শিক্ষার্থীদের মানসিক এবং নৈতিক ভিত্তি মজবুত করতো, যা তাদের জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জনে সহায়ক ছিলো।

বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে সেই শিক্ষকের চিন্তাধারা এবং বিশ্লেষণ আমাদেরকে পূর্বের কারিকুলাম পুনরায় ফিরিয়ে আনার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে চিন্তা করতে উদ্বুদ্ধ করে। আধুনিক সময়ের পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে, আমরা কি পূর্বের সেই মূল্যবান কারিকুলাম থেকে কিছু শিখতে পারি না? কী ছিলো সেই কারিকুলামের বিশেষ দিক যা শিক্ষার্থীদের জীবনকে সমৃদ্ধ করতো?

প্রথমত: পূর্বের কারিকুলাম ভিত্তি মজবুত করার ওপর জোর দিতো। প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীরা মজবুত ভিত্তি তৈরি করতে পারতো, যা তাদের উচ্চতর শিক্ষায় সফল হতে সাহায্য করতো। বর্তমান কারিকুলামে অনেক সময় এই ভিত্তি গড়ে তোলার দিকে সঠিক মনোযোগ দেয়া হয় না, ফলে শিক্ষার্থীরা উচ্চতর স্তরে গিয়ে বিভিন্ন সমস্যায় পড়ে।

দ্বিতীয়ত, পূর্বের কারিকুলামে দেশের সংস্কৃতি, ইতিহাস, এবং ঐতিহ্য সম্পর্কে বিস্তারিত পাঠ্যবিষয় ছিলো। এটি শিক্ষার্থীদের মধ্যে দেশপ্রেম এবং সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ জাগ্রত করতো। বর্তমান কারিকুলামে অনেক সময় এই বিষয়গুলো কম গুরুত্ব পায়, ফলে শিক্ষার্থীরা নিজেদের ইতিহাস এবং সংস্কৃতি সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান অর্জন করতে পারে না।

তৃতীয়ত: নৈতিক শিক্ষার ওপর বিশেষ গুরুত্ব ছিল পূর্বের কারিকুলামে। এতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে নৈতিকতা, সততা, এবং সঠিক আচরণের বিকাশ হতো। বর্তমান কারিকুলামে নৈতিক শিক্ষার দিকে কম মনোযোগ দেয়া হয়, ফলে শিক্ষার্থীরা সঠিক এবং ভুলের পার্থক্য করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে।

চতুর্থত: পূর্বের কারিকুলামে বিভিন্ন বিষয়ে বিস্তৃত পরিধির পাঠ্যবিষয় অন্তর্ভুক্ত ছিলো, যা শিক্ষার্থীদের জ্ঞান ভান্ডারকে সমৃদ্ধ করতো। বর্তমানে শিক্ষার্থীরা মোবাইল এবং ইন্টারনেটের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েছে, যার ফলে তারা পড়াশোনার প্রতি মনোযোগ হারাচ্ছে। মনীষী আলবার্ট আইনস্টাইন বলেছিলেন, ‘শিক্ষা হলো যা স্কুলে শেখার পরও থেকে যায়’। কিন্তু বর্তমান সময়ে, শিক্ষার্থীরা স্কুলের পড়াশোনার চেয়ে মোবাইল গেম এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় সময় বেশি ব্যয় করছেন।

তা ছাড়া, বর্তমান কারিকুলামে শিক্ষার্থীদের মধ্যে গবেষণার প্রতি আগ্রহ এবং বিশ্লেষণী দক্ষতা বৃদ্ধিতে পর্যাপ্ত সুযোগ নেই। পূর্বের কারিকুলামে গবেষণা এবং বিশ্লেষণমূলক শিক্ষার ওপর জোর দেয়া হতো, যা শিক্ষার্থীদের মধ্যে এই দক্ষতা বৃদ্ধিতে সহায়ক ছিলো।

অধিকন্তু, মানবিক গুণাবলী এবং সামাজিক মূল্যবোধের ওপর পূর্বের কারিকুলামে গুরুত্ব দেয়া হতো, যা শিক্ষার্থীদের ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে সাহায্য করতো। বর্তমান কারিকুলামে এই বিষয়গুলোতে মনোযোগ কম দেয়া হয়, ফলে শিক্ষার্থীরা মানবিক গুণাবলী এবং সামাজিক মূল্যবোধ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

বাংলাদেশের নতুন শিক্ষা কারিকুলাম অনেক প্রতিশ্রুতি বহন করলেও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে নানা প্রশ্ন ও বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। বিশেষত স্কুল পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের জন্য কারিকুলামের কার্যকারিতা নিয়ে নানা মতামত ও সমালোচনা উঠে এসেছে। শিক্ষাব্যবস্থায় মৌলিক সমস্যাগুলো সমাধান হচ্ছে না, শিক্ষার্থীরা কেবল পরীক্ষা পাশের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। এটি দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বের জন্য প্রস্তুত করতে ব্যর্থ হচ্ছে। শিক্ষার মান উন্নয়ন, পরীক্ষা পদ্ধতির সংস্কার এবং শিক্ষকদের দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে শিক্ষাব্যবস্থার প্রকৃত উন্নয়ন সম্ভব।

নতুন কারিকুলাম প্রবর্তন সত্ত্বেও, শিক্ষার্থীরা মোবাইল এবং ইন্টারনেটের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েছে, যার ফলে তারা পড়াশোনার প্রতি মনোযোগ হারাচ্ছে। প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা শিক্ষার মূল্যবোধকে ধ্বংস করছে এবং মেধাবী শিক্ষার্থীদের হতাশ করছে। দীর্ঘ সময়ের পরীক্ষার পরিবর্তে নিয়মিত ছোট আকারের মূল্যায়ন চালু করা এবং পরীক্ষা ব্যবস্থায় কঠোর ডিজিটাল নিরাপত্তা নিশ্চিত করা উচিত।

বর্তমান পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য শিক্ষকদের যথাযথ প্রশিক্ষণ প্রদান এবং তাদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য নিয়মিত কর্মশালা ও সেমিনারের আয়োজন করা প্রয়োজন। পরীক্ষা পদ্ধতি সংস্কার করে বাস্তব জীবনের সমস্যার সমাধানে শিক্ষার্থীদের দক্ষতা মূল্যায়ন করা উচিত। এই সমস্ত সমস্যার সমাধান না করা হলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ওপর মারাত্মক প্রভাব পড়বে।

উপসংহারে, বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থার এই সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য এবং শিক্ষার্থীদের মধ্যে সঠিক মূল্যবোধ এবং দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য পূর্বের শিক্ষা কারিকুলাম ফিরিয়ে আনা উচিত। দেশের সার্বিক উন্নয়নের জন্য এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হতে পারে। পূর্বের কারিকুলাম ফিরিয়ে এনে আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে একটি শক্তিশালী ভিত্তি, নৈতিকতা এবং সংস্কৃতি সম্পর্কে গভীর জ্ঞান প্রদান করতে পারি। আমাদের সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায়ই কেবল সম্ভব হবে একটি দক্ষ ও জ্ঞানসমৃদ্ধ প্রজন্ম গড়ে তোলা।

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, হাবীবুল্লাহ বাহার কলেজ, ঢাকা   


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
ইউএনওর ‘মানসিক নির্যাতনে’ শিক্ষকের মৃত্যুর অভিযোগ - dainik shiksha ইউএনওর ‘মানসিক নির্যাতনে’ শিক্ষকের মৃত্যুর অভিযোগ শিক্ষা ক্যাডারে পদোন্নতির সভা ১৮ সেপ্টেম্বর - dainik shiksha শিক্ষা ক্যাডারে পদোন্নতির সভা ১৮ সেপ্টেম্বর সেই অভিযুক্ত রেবেকাই এবার মাউশি ঢাকার ডিডি! - dainik shiksha সেই অভিযুক্ত রেবেকাই এবার মাউশি ঢাকার ডিডি! নাহিদ-দীপুর ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিই মাউশি অধিদপ্তরের ডিজি হচ্ছেন! - dainik shiksha নাহিদ-দীপুর ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিই মাউশি অধিদপ্তরের ডিজি হচ্ছেন! শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ডেঙ্গু প্রতিরোধে কী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে- জানতে চায় অধিদপ্তর - dainik shiksha শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ডেঙ্গু প্রতিরোধে কী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে- জানতে চায় অধিদপ্তর এক ফ্যাসিস্টকে দেশ ছাড়া করেছি অন্যকে সুযোগ দেয়ার জন্য নয়: সারজিস - dainik shiksha এক ফ্যাসিস্টকে দেশ ছাড়া করেছি অন্যকে সুযোগ দেয়ার জন্য নয়: সারজিস কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0043859481811523