চাঁদপুরে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমি অধিগ্রহণে অনিয়ম নিয়ে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি ও তার পরিবারের সদস্যদের জড়িয়ে অভিযোগ উঠেছে। চাঁবিপ্রবির জন্য জমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া নিয়ে জেলা প্রশাসক অঞ্জনা খান মজলিশ ভূমি মন্ত্রণালয়ে পাঠানো এক প্রতিবেদনে দাবি করেছেন, ‘ওই প্রক্রিয়ায় সরকারের প্রায় ৩৬০ কোটি টাকা লোকসান হচ্ছে’। চাঁদপুরের স্থানীয় কয়েকজন রাজনীতিবিদ এ অনিয়মের সঙ্গে শিক্ষামন্ত্রী ও তার ভাইয়ের সংশ্লিষ্টতার কথা বলেছেন। তবে, এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন শিক্ষামন্ত্রী। তিনি বলেছেন, এ বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ভূমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়ায় তার বা তার পরিবারের কারো আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা নেই। তার রক্তের সম্পর্কের কারো জমি এ বিশ্ববিদ্যালয় প্রকল্পের জন্য অধিগ্রহণ করা হচ্ছে না। এসব অভিযোগ অসত্য ও ভিত্তিহীন বলে দাবি করে শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, এটি উদ্দেশ্য প্রণোদিত হতে পারে।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় রাজধানীর হেয়ার রোডের নিজ বাসায় এক সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষামন্ত্রী এসব কথা বলেন।
শিক্ষামন্ত্রী বলেন, কয়েকটি গণমাধ্যমে বিষয়টি নিয়ে প্রতিবেদন দেখলাম। চাঁদপুরের একজন এমপি একটি কলাম লিখেছেন বিষয়টি নিয়ে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমি অধিগ্রহণে বিষয়ে আমাকে ও আমার ভাইকে জড়িয়ে যে অভিযোগ তোলা হয়েছে তা সত্য নয়। বলা হচ্ছে আমার ভাই এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমি অধিগ্রহণ এর সাথে জড়িত। কিন্তু ওই প্রকল্পের অধিগ্রহণের জন্য নির্ধারিত জায়গায় আমার বা আমার পরিবারের কারো কোনো জমি নেই। ওই স্থানে আমার ভাইয়ের জমি ছিল যে তিনি বৃদ্ধাশ্রম হাসপাতাল নির্মাণের জন্য কিনেছিলেন। যখন ওই জমিটা আমরা চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চাঁবিপ্রবি) জন্য পছন্দ করি, অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া শুরুর পর আমার ভাই তার জমি হস্তান্তর করে দিয়েছেন। তিনি জমিটি বেশ কিছুদিন বিক্রির চেষ্টা করছিলেন। এর বাইরে বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য যে জমি চিহ্নিত আছে, সেখানে আমার বা আমার পরিবারের কারও কোনো জমি নেই। উত্তারধিকার সূত্রে চাঁদপুরে আমি কিছু জমি হয়তো পেয়েছি। কিন্তু ক্রয় সূত্রে চাঁদপুরে আমার কোনো জমি নেই।
বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য নির্ধারিত স্থানে শিক্ষামন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ জাহিদুল ইসলাম রোমান ও সেলিম খানের জমি আছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এ বিষয়ে মন্ত্রী বলেন, তারা আমার রক্তের কেউ নন, আমার রাজনৈতিক পরিবারের সদস্য। জাহিদুল ইসলাম রোমান আমার জ্ঞাতি হিসেবে আত্মীয়। জাহিদুল ইসলাম রোমানের নানা এবং আমার দাদা, তারা কাজিন ছিলেন। সেই অর্থে তিনি আমার ভাই। তার থেকে অনেক বড় সম্পর্ক হলো রাজনৈতিকভাবে আমরা ঘনিষ্ঠ। আমার রাজনৈতিক পরিবার অনেক বড়।
শিক্ষামন্ত্রী বলেন, যখনই অধিগ্রহণ হয়, সেখানে জমি কেনার একটা প্রবণতা থাকে। কিংবা যাদের জমি আছে, স্থাপনা বানিয়ে ফেলে। এই অনুশীলন বাংলাদেশের সর্বত্র আছে। আমার ওখানেও (চাঁদপুর) সেটা ঘটে থাকতে পারে। সেটা আমি জানি না। কে আমার সঙ্গে রাজনীতি করেন বা করেন না, কে জমি কিনেছেন? ওটা আমার দেখার বিষয় নয়। ওটা দেখার সময়ও নেই আমার। রাজনৈতিক ঘনিষ্ঠ বা আত্মীয়-অনাত্মীয় কেউ জমি কিনলেও আমার কিছু বলার নেই।
তিনি আরও বলেন, আগে যে ডিসি প্রাক্কলন দিয়েছিলেন, এখনো তিনিই আছেন। আগেও প্রশাসনের মাধ্যমে প্রাক্কলন নেয়া হয়েছে। এবারও প্রশাসনের মাধ্যমে হয়েছে। তাদের হিসেবে কেন গড়মিল হচ্ছে সেটিও খতিয়ে দেখা দরকার।
তিনি বলেন, এসব অসত্য ও ভিত্তিহীন, উদ্দেশ্য প্রণোদিতও হতে পারে। এ অভিযোগের সঙ্গে রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার সম্পৃক্ততা আছে কী না জানতে চাইলে দীপু মনি বলেন, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ও প্রতিযোগিতা থাকতেই পারে। তবে, সেটি নিয়ে কাউকে হেয় করে অসত্য তথ্য ছড়ানো উচিত নয়। বিষয়টি অবশ্যই তদন্ত হওয়া দরকার।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমি অধিগ্রহণের অভিযোগ শিক্ষা মন্ত্রণালয় তদন্ত করবে কী-না জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেন, আমি যেহেতু এ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী, সেহেতু মনে হয় শিক্ষা মন্ত্রণালয় এর তদন্ত করলে তার গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন আসতে পারে। তাই ভূমি মন্ত্রণালয় বা সরকারের সংশ্লিষ্ট অন্য কোনো দপ্তর তদন্ত করতে পারে।
সংবাদ সম্মেলনে মন্ত্রী উল্লেখ করেন, চাঁদপুর শহরে ঘণবসতিপূর্ণ। এখানে জমির দাম ৩০ লাখ টাকা শতাংশ। আর হাইমচরে সে দাম প্রায় ৪০ লাখ টাকা প্রতি শতাংশ। শুনতে অবাক মনে হলেও নদীভাঙনের কারণে শহরে ছোট হয়ে যাওয়ায় এমনটি হয়েছে।
তিনি বলেন,আমার নির্বাচনী এলাকায় কোন উন্নয়ন কর্মকাণ্ড শুরু হলেওই তা বাধাগ্রস্ত করা হয়। এর আগে চাঁদপুর মেডিকেল কলেজের জায়গার অধিগ্রহণ নিয়ে এই রকম একটা মহল প্রশ্ন তুলেছে। যখনই কোনো বড় উন্নয়নমূলক কাজের কথা হয়, তখনই এই জমি ভেঙে যাবে, এটা নষ্ট হবে, এরকম নানান কিছু বলা হয়। এই বলে মেডিকেল কলেজের জমি অধিগ্রহণের কাজটাও দীর্ঘায়িত হচ্ছে। হাইমচরে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল হওয়ার কথা, সিদ্ধান্ত হয়ে আছে। সেটার জমি অধিগ্রহণ কাজও হচ্ছে ধীরে। তার কারণ একটা মহল কিছুতেই চাইছে না, ওইখানে (চাঁদপুর-৩) আমার মাধ্যমে এই বড় বড় কাজ হোক।
শিক্ষামন্ত্রী বলেন, বলা হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য নির্ধারিত এলাকা ভাঙণপ্রবণ। কিন্তু এটি ১৯ কিলোমিটার স্থায়ী শহর রক্ষা বাধের ভেতরে অবস্থিত।
জেলা প্রশাসকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ‘চাঁদপুর সদর উপজেলার ১১৫ নম্বর লক্ষ্মীপুর সাব-রেজিস্ট্রার অফিসের নির্ধারিত বাজারমূল্য অনুযায়ী নাল, বাড়ি/বাগান, পুকুর/ডোবা ও ভিটি শ্রেণির মূল্য পর্যায়ক্রমে ১৩ হাজার ৮০২ টাকা, ২৩ হাজার ৯৬৬, ৩৮ হাজার ৯৫৬ এবং ৩৩ হাজার ২৯৪ টাকা ধরে প্রকল্প প্রাক্কলন দাঁড়ায় ১৯৩ কোটি ৯০ লাখ ৬৫ হাজার ৫০৭ টাকা। কিন্তু দেখা যায়, সর্বশেষ নির্ধারিত মৌজা মূল্যের তুলনায় অধিগ্রহণের নিমিত্ত সংগৃহীত দরপত্র চরম অস্বাভাবিক।’ অর্থাৎ আগে সেটির প্রাক্কলন মূল দেখানো হয়েছিল ৫৫৩ কোটি টাকা। যাতে সরকারের ৩৫৯ কোটি ১৬ লাখ ৬১ হাজার ৭৮২ টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়।
চাঁদপুর-৪ আসনের সরকারদলীয় সংসদ সদস্য (এমপি) মুহাম্মদ শফিকুর রহমান সেখানে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে কলাম লিখেছেন। তিনি দাবি করেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ভূমি অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে ৫০০-৬০০ কোটি টাকার বাণিজ্য হচ্ছিল অবাধে। এর পেছনে যেহেতু খোদ শিক্ষামন্ত্রীর ক্ষমতা ও তার ভাইয়েরা জড়িত, তাই কেউ মুখ খুলছিল না। চাঁদপুরের সচেতন নাগরিকরা অতি সঙ্গোপনে গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে সরকারের দৃষ্টিতে বিষয়টি আনলে একটি জরিপ করা হয়। জরিপে কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে আসতে শুরু করে। দেখা যায় অধিগ্রহণের জন্য চিহ্নিত জমির প্রতি শতাংশের মূল্য স্থানীয়ভাবে ১৪ থেকে ১৫ হাজার টাকা, ভিটি বাড়ি হলে প্রতি শতাংশ ৩২ থেকে ৩৩ হাজার টাকা। প্রভাবশালী মহল এই জমি প্রকারভেদে ২ লাখ ৫০ হাজার থেকে ৩ লাখ টাকা দলিলে লিখিয়ে কিনে নেয়। ১৪-১৫ হাজার টাকা শতাংশ জমি আড়াই থেকে তিন লাখ টাকার দলিল করে সরকারের কাছ থেকে ২০ গুণ বেশি দাম পকেটস্থ করার ফন্দি আঁটা হয়েছিল।
এমপি শফিকুর রহমানের দাবি, বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য স্থান নির্ধারণই হয়েছে আত্মঘাতী। যেটি খরস্রোতা মেঘনা পাড়ে। ভাঙনপ্রবণ মেঘনা পাড় থেকে ৫০০-৬০০ মিটার ভেতরে চাঁদপুর থানার লক্ষ্মীপুর ইউনিয়ন পরিষদ এলাকা। এই ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. সেলিম খান। তিনি শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি এবং তার ভাই ডা. টিপুর অত্যন্ত কাছের লোক এবং তাদের ছত্রচ্ছায়ায় মেঘনায় শত শত ড্রেজার দিয়ে বালু তুলে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন, এখনো চলছে বালু-বাণিজ্য, তাদের শত শত কোটি টাকার বাণিজ্যের ছোবলে মেঘনার তলদেশের ভাঙন চাঁদপুর শহরকেও ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে। চাঁদপুরবাসীর ধারণা, সেখানে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হলে মেঘনা গর্ভে বিলীন হতে বেশি সময় লাগবে না।