শিক্ষক নিবন্ধন ও নিয়োগ নিয়ে যা লিখলেন ড. জাফর ইকবাল

নিজস্ব প্রতিবেদক |

আমি আমার দীর্ঘ জীবনে যে কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় শিখেছি তার মাঝে একটা হচ্ছে পৃথিবীর যে কোনো জটিল বিষয় আসলে কমন-সেন্স দিয়ে মোটামুটি বুঝে ফেলা যায়। একেবারে পুরোটা বোঝার জন্য হয়তো বড় বড় বিশেষজ্ঞ দরকার হয়। কিন্তু কাজ চালানোর মতো বোঝার জন্য কমন-সেন্সই যথেষ্ট। বিষয়টা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধই হোক, আর আমাদের ইভিএম মেশিনই হোক। তাই হঠাৎ করে যখন কোনো একটা বিষয় আমরা কমন-সেন্স দিয়ে বুঝতে পারি না, তখন খুব অসহায় বোধ করি। আমার হঠাৎ এ রকম একটা অভিজ্ঞতা হয়েছে। বিষয়টা একটু খোলাসা করে বলি।

আমার ধারণা, মাধ্যমিক পর্যায়ের ৮০-৯০ শতাংশ ছাত্রছাত্রীই এমপিওভুক্ত এবং রেজিস্টার্ড বেসরকারি মাধ্যমিক স্কুলগুলোতে পড়াশোনা করে। আমাদের সেই স্কুলগুলোতে শিক্ষকের বিশাল ঘাটতি আছে। সংখ্যাটি কত হতে পারে তার সঠিক হিসাব আছে কিনা জানা নেই। কিন্তু পত্রপত্রিকায় ৮০ থেকে ৮৫ হাজার এ রকম একটি সংখ্যা দেখেছি। খুব স্বাভাবিকভাবেই শিক্ষকের ঘাটতি পূরণের জন্য সরকার থেকে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, একবারে ৫৪ হাজার শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হবে।

শিক্ষক নেওয়ার প্রক্রিয়াটা যথেষ্ট মানসম্মত। স্নাতক-মাস্টার্স করা তরুণ-তরুণীরা নিয়োগ পরীক্ষা দিয়ে 'নিবন্ধন সনদ' অর্জন করেছে এবং শিক্ষক হিসেবে শুধু তাদেরকেই নিয়োগ দেওয়া হবে। কাজেই শিক্ষক নিয়োগ দেওয়ার কাজটা এখন খুবই স্বচ্ছ এবং সহজ হওয়ার কথা। যাদের সনদ আছে তাদের থেকে ক্রমানুসারে ৫৪ হাজার শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হলে শিক্ষক ঘাটতির একটা বড় অংশই পূরণ হয়ে যেত। তার চাইতে বড় কথা, এ দেশের অসংখ্য যোগ্য মানুষ এই চাকরির জন্য বসে আছে। তাদেরও জীবনে একটা নিশ্চয়তা আসত। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেও রেখেছেন- মুজিববর্ষে কেউ বেকার থাকবে না। কিন্তু মোটামুটি হতবাক হয়ে সবাই আবিস্কার করল- ৫৪ হাজার শিক্ষকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে নতুন শিক্ষক নেওয়া হলো মাত্র ১৪ হাজার; যদিও নিয়োগ দেওয়ার মতো প্রার্থীর কোনো অভাব নেই। তাঁরা রীতিমতো পরীক্ষা দিয়ে 'নিবন্ধন সনদ' অর্জন করে অনেক বছর থেকে অপেক্ষা করে বসে আছেন।

ব্যাপারটা এখানে শেষ হলে একটা কথা ছিল। তার সঙ্গে যেটা হয়েছে সেটা রীতিমতো হৃদয়বিদারক। ৫৪ হাজার পদের ভেতর আরও ২২ হাজার পদে কাগজে-কলমে নিয়োগ দেওয়া হলো। কিন্তু তাঁরা সবাই আগে থেকে চাকরি পেয়ে বসে আছেন। তাঁরা আসলে এক জায়গা থেকে তাঁদের পছন্দসই অন্য জায়গায় বদলি হয়েছেন। এখানেই শেষ নয়; বাকি যাঁরা আছেন তাঁদের নিয়োগ দেওয়া গেল না। কারণ 'উপযুক্ত প্রার্থী পাওয়া যায়নি'।

যারা এই বিষয়ের প্রক্রিয়াটি তদারকি করে (এনটিআরসিএ), তাদের কাছে নিশ্চয়ই এর কোনো এক ধরনের ব্যাখ্যা আছে। কিন্তু আমি আমার কমন-সেন্স দিয়ে সেটা কিছুতেই বুঝতে পারছি না। স্কুলের শিক্ষকের প্রয়োজন; শিক্ষক হওয়ার যোগ্য তালিকাভুক্ত প্রার্থী এরই মাঝে পরীক্ষা নিয়ে খুঁজে বের করে রাখা হয়েছে; শিক্ষকের অসংখ্য শূন্য পদ আছে, কিন্তু নিয়োগ দেওয়ার বিশাল দক্ষ-যজ্ঞ করার পরও পদগুলো খালি রয়ে যাচ্ছে।

শিক্ষক প্রার্থীরা এ ধরনের বেশ কিছু নির্মম রসিকতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে শাহবাগের কাঠফাটা রোদে বসে গণঅনশন করছেন; কিন্তু কারও দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পেরেছেন বলে মনে হয় না। এই দেশে সবচেয়ে নির্যাতিত প্রজাতি হচ্ছেন শিক্ষকরা। তাঁদের থেকে হতভাগা যদি কেউ থাকেন, তাঁরা হচ্ছেন শিক্ষক হওয়ার যোগ্য সনদ পাওয়া এই প্রার্থীরা।


বিষয়টা যথেষ্ট নির্মম- আমি সেটা জানতে পেরেছি এই প্রার্থীদের সঙ্গে কথা বলে। (আমি তাঁদের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। নিজেদের দুঃখ এবং বঞ্চনার কথা বলতে গিয়ে অনেকেই চোখের পানি ফেলেছেন।) কোনো একটি অত্যন্ত বিচিত্র কারণে চাকরির জন্য প্রার্থীদের আলাদা প্রতিষ্ঠানে আবেদন করতে হয়। যদিও সবচেয়ে সহজ উপায় হচ্ছে তাঁরা একবার আবেদন করবেন; সেই আবেদনের ভিত্তিতে একটা তালিকা করে রাখা হবে এবং যখন যেখানে ফাঁকা হবে তখন সেখানে এই তালিকা থেকে একজনকে নিয়োগ দেওয়া হবে। কম্পিউটারের এই যুগে ডিজিটাল বাংলাদেশ, যেখানে সব মানুষের বায়োমেট্রিক এনআইডি আছে, সেখানে পানির মতো সহজ এ কাজটি করা হয় না। সব প্রার্থীকে সব স্কুলে আবেদন করতে হয়। কাজেই অনেক শিক্ষক পদে প্রার্থীরা চাকরি পাওয়ার জন্য নিজেদের জমি বিক্রি করে একটি নয়, দুটি নয়; এক হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আবেদন করেন! প্রতিটি আবেদনের জন্য যদি ১৫০ টাকা খরচ হয়, তাহলে প্রার্থীর কত টাকা খরচ হয় কেউ সেটা হিসাব করে দেখেছেন? একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের কমন-সেন্সের অভাবের কারণে চাকরিপ্রার্থীদের নিয়ে এই নির্মম রসিকতা করা হচ্ছে, নাকি ইচ্ছা করে চিন্তাভাবনা করে তাঁদেরকে এভাবে নির্যাতন করা হচ্ছে- সেটি কে আমাকে বুঝিয়ে দেবে?

স্বাভাবিকভাবেই বিষয়টি নিয়ে মামলা-মোকদ্দমা হচ্ছে। একেকবার একেকটি পরীক্ষায় প্রার্থীরা একেক নম্বর পান। পদ্ধতির পরিবর্তন হলে মূল্যায়নের সবকিছুই ওলটপালট হয়ে যায়। তাই যদি সবাইকে নিয়ে মেধা তালিকা করা হয় তাহলে কোনো কোনো ব্যাচ লাভবান হবে এবং কোনো কোনো ব্যাচের একেবারে বিনা কারণে সর্বনাশ হয়ে যাবে। সেগুলো সমন্বয় করার বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিও আছে। সেগুলো প্রয়োগ না করে চাকরিপ্রার্থীদের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলা হলে সেটি হবে চূড়ান্ত নিষ্ঠুরতা।

আমি আরও একটি বিষয় এখনও পুরোপুরি জানতে পারিনি। সেটা হচ্ছে শিক্ষকের চাকরির জন্য সব নিবন্ধন পরীক্ষা মিলিয়ে সনদ পাওয়া প্রার্থীর প্রকৃত সংখ্যা কত? যেহেতু একজন এক হাজার স্কুলে আবেদন করে ফেলেন; আবার অনেকেই একাধিক সনদ অর্জন করতে পারেন; অনেকেই অন্য কোথাও চাকরি পেয়ে চলে গেছেন; অনেকে হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দিয়েছেন। তাই আবেদনের সংখ্যা থেকে প্রকৃত সংখ্যা বের করা কঠিন। (ডিজিটাল বাংলাদেশে সেটা বের করা পানির মতো সোজা হওয়ার কথা; কিন্তু কেন এটা গোপন রাখা হচ্ছে, সে এক রহস্য)। যাঁরা বিষয়টি নিয়ে চিন্তাভাবনা করেছেন তাঁদের ধারণা, প্রার্থীর সংখ্যা বিভিন্ন স্কুলে শিক্ষকের যে কয়টি পদ ফাঁকা আছে সে সংখ্যা থেকে খুব বেশি হবে না। যার অর্থ, ঠিকভাবে এ প্রক্রিয়াটি শেষ করা হলে এটি একটি জাতীয় হতাশা এবং ক্ষোভের ব্যাপার না হয়ে স্কুলে স্কুলে নতুন শিক্ষক পাওয়া এবং অসংখ্য তরুণ-তরুণীর চাকরি পাওয়ার মতো আনন্দময় একটা ব্যাপার হতে পারত! সরকারের বিড়ম্বনাময় ব্যর্থ ইতিহাস না হয়ে এটি সরকারের সাফল্যগাথা হতে পারত।

২.

তবে সেটি নাও হতে পারে। তার কারণ আমাকে বলা হয়েছে, এনটিআরসিএ নিজেই জানিয়েছে, দেশে নাকি ৬০ হাজার 'জাল নিবন্ধন সনদধারী' আছেন এবং এর মধ্যে এক হাজারের চেয়েও বেশি জাল সনদধারী চাকরি পাওয়া শিক্ষককে তাঁদের বেতনের টাকা ফেরত দিতে আদেশ দেওয়া হয়েছে।

ডিজিটাল বাংলাদেশ; যেখানে সবার বায়োমেট্রিক এনআইডি আছে সেখানে জাল সনদ বের করা রীতিমতো অসম্ভব একটা কাজ। তারপরও দুর্বৃত্তদের যে বিশাল প্রতিভাবান দল সবাইকে নিয়ে অসম্ভব একটি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে এই অসাধ্য সাধন করেছে, তাদেরকে 'অভিনন্দন'!

তবে যে শিক্ষকরা জাল সনদ নিয়ে ছাত্রছাত্রীদের পড়াচ্ছেন, তাঁরা ক্লাসে চুরি-ডাকাতি-প্রতারণা করানোর বাইরে আর কী পড়ান- আমার জানার খুব কৌতূহল।

মুহম্মদ জাফর ইকবাল: শিক্ষাবিদ ও লেখক

[এই মতামতের দায় দৈনিক শিক্ষাডটকম ও দৈনিক আমাদের বার্তার সম্পাদকের নয়।] 


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
ষষ্ঠ-নবম শ্রেণিতে ষাণ্মাসিক সামষ্টিক মূল্যায়নের সূচি - dainik shiksha ষষ্ঠ-নবম শ্রেণিতে ষাণ্মাসিক সামষ্টিক মূল্যায়নের সূচি শিক্ষার্থীদের জন্য পাঠ্যবইয়ের সংশোধনী প্রকাশ - dainik shiksha শিক্ষার্থীদের জন্য পাঠ্যবইয়ের সংশোধনী প্রকাশ অষ্টম পর্যন্ত অবৈতনিক শিক্ষায় সরকারকে সহযোগিতা করবে ইউএনএফপিএ - dainik shiksha অষ্টম পর্যন্ত অবৈতনিক শিক্ষায় সরকারকে সহযোগিতা করবে ইউএনএফপিএ ইসরায়েলকে বোমা পাঠানো বন্ধ রাখছে যুক্তরাষ্ট্র - dainik shiksha ইসরায়েলকে বোমা পাঠানো বন্ধ রাখছে যুক্তরাষ্ট্র ভুইফোঁড় শিক্ষক সমিতি নেতাদের এমপিও বাতিল হতে পারে - dainik shiksha ভুইফোঁড় শিক্ষক সমিতি নেতাদের এমপিও বাতিল হতে পারে শিক্ষার্থীদের জন্য পাঠ্যবইয়ের সংশোধনী প্রকাশ - dainik shiksha শিক্ষার্থীদের জন্য পাঠ্যবইয়ের সংশোধনী প্রকাশ ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের জাপান টিকিট ৩০ লাখ! - dainik shiksha ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের জাপান টিকিট ৩০ লাখ! জাল সনদধারী শিক্ষকের এমপিও বাতিল - dainik shiksha জাল সনদধারী শিক্ষকের এমপিও বাতিল কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0024209022521973