দুঃখের মাঝেও মানুষ কৌতুক করে। কারণ যে অসংগতি সে দেখছে তা দূর করতে পারে না আবার মেনে নিতেও পারে না, তাই ব্যঙ্গ করে নিজের অসহায়ত্ব লুকাতে চায়। করোনায় স্কুল-কলেজ বন্ধ, নাতি বাসায় বসে থাকে, ঘুমায়, টিভি দেখে। দাদু নাতিকে জিজ্ঞেস করছে, লেখাপড়া কেমন চলছে? নাতি বলছে, ‘লেখাপড়া চলছে, চলতে চলতে এত দূরে চলে গেছে যে আমি আর তার দেখাই পাচ্ছি না।’ বাস্তবেও ঘটছে তাই। শিক্ষক দেখা পাচ্ছে না শিক্ষার্থীর, শিক্ষার্থী নাগাল পাচ্ছে না শিক্ষার। বর্তমান সময়ে তাই দুটো প্রশ্ন ভাবিয়ে তুলছে সব চিন্তাশীল মানুষকে।
২০১৯ সাল থেকে করোনার সঙ্গে লড়াই করতে করতে কী শিক্ষা নিলাম আমরা? আর এই করোনাকালে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের শিক্ষাব্যবস্থাটার বেহাল দশা থেকে মুক্তির পথ কী? প্রশ্ন দুটো সহজ হলেও উত্তর দিতে গিয়ে থমকে যাবেন সবাই। দেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছিল ২০২০ সালের ৮ মার্চ আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল ১৭ মার্চ। তারপর থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। ইউনিসেফের প্রতিবেদন অনুযায়ী জানা যায়, পৃথিবীতে ১৪ টি দেশ করোনাকালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সম্পূর্ণ বন্ধ রেখেছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের এই তালিকায় আছে বাংলাদেশের নাম। পানামা, এল সালভাদর, বলিভিয়া এবং বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি দিন স্কুল ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। বাংলাদেশে অবশ্য এ পর্যন্ত ১৭ বার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েও শেষ পর্যন্ত আর খোলা হয়নি। কিন্তু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান না খুলেও জীবন ও শিক্ষার্থীদের বয়স তো থেমে থাকেনি। শনিবার (২৪ জুলাই) দেশরুপান্তর পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।আরও পড়ুন : দৈনিক শিক্ষাডটকম পরিবারের প্রিন্ট পত্রিকা ‘দৈনিক আমাদের বার্তা
নিবন্ধে আরও জানা যায় প্রথম শ্রেণি থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ স্তর পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ৪ কোটি শিক্ষার্থী আছে বাংলাদেশে। যাদের বয়স ৫ থেকে ২৫ বছর। গড় আয়ু বিবেচনায় যারা আরও ৫০ থেকে ৭০ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকবে, দেশটাকে গড়ে তুলবে। তাই ভালো শিক্ষার মাধ্যমে তাদের জীবনটা সুন্দরভাবে গড়ে তোলা রাষ্ট্রের ও সমাজের প্রধান কর্তব্য হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু শিক্ষা-বাণিজ্যের ফলে ‘টাকা যার শিক্ষা তার’ এই নীতিতে শিক্ষাব্যবস্থা চলার কারণে শিক্ষার আঙিনা থেকে ছিটকে পড়ছিল শিক্ষার্থীদের একটা বড় অংশ। যেমন পঞ্চম শ্রেণির সমাপনী পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করত গড়ে ২৯ লাখ শিশু। জেএসসিতে অংশ নিত ২২ লাখ কিশোর, এসএসসিতে ১৮ থেকে ২০ লাখ তরুণ, এইচএসসিতে ১৪ লাখ সদ্য যৌবনপ্রাপ্ত শিক্ষার্থী পরীক্ষা দিয়ে সরকারি-বেসরকারি, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত কলেজ সব মিলে ৬ থেকে ৭ লাখ তরুণ-তরুণী উচ্চশিক্ষার আঙিনায় প্রবেশ করত। ২৯ লাখ থেকে ৭ লাখ, ২২ লাখ শিক্ষার্থী শিক্ষার আঙিনা থেকে ছিটকে পড়ত বিভিন্ন পর্যায়ে। বিভিন্ন প্রতিকূলতা পেরিয়েও যারা শিক্ষার আঙিনায় আছে বা ছিল করোনা তাদের সবার শিক্ষাজীবনকে বিরাট বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিয়েছে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। এর প্রভাব সব শিক্ষার্থীর জীবনে পড়লেও সবার ওপর আঘাতটা একই রকম নয়। ধনী পরিবারগুলো তাদের সন্তানদের বিকল্প নানা পদ্ধতিতে শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত রেখেছে। হতদরিদ্র এবং দরিদ্র পরিবারের সন্তানরা জীবিকার জন্য শিক্ষাকে পরিত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছে। নিম্ন-মধ্যবিত্ত আর মধ্যবিত্ত হাঁসফাঁস করছে, শিক্ষার খরচ জোগাতে। যত কষ্টই হোক পড়াশোনা সন্তানকে করাতেই হবে। কারণ শিক্ষা শেষে একটা চাকরি তাদের জীবনের প্রধান লক্ষ্য এবং একমাত্র অবলম্বন। তাই লেখাপড়া না করলে সন্তান কি করে খাবে এটাই মধ্যবিত্ত পরিবারের বাবা-মায়ের সার্বক্ষণিক দুশ্চিন্তা। ক্লাস হচ্ছে না, পরীক্ষা হবে কি হবে না, বয়স চলে যাচ্ছে, চাকরি পাবে কি না এই সব চিন্তায় সেই সব পরিবারের স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়পড়–য়া শিক্ষার্থীর মানসিক অবস্থা স্বাভাবিক থাকার উপায় নেই।
দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেলটি সাবস্ক্রাইব ও ফেসবুক পেইজটি ফলো করুন
সারা পৃথিবীতেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ধরন পাল্টে যাচ্ছে । শিক্ষা প্রদানের ধরন বিবেচনা করে মোটা দাগে বললে ট্র্যাডিশনাল শিক্ষা, দূর শিক্ষণ, ইলেকট্রনিক লারনিং এবং করোনায় মোবাইল লারনিং পদ্ধতিতে শিক্ষা প্রদান করা হচ্ছে। বাংলাদেশে দূর শিক্ষণ পদ্ধতি ১৯৯২ সালে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর থেকে বিস্তৃত হওয়ার কথা থাকলেও তা প্রধানত ঝরে পড়া ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ছাত্রছাত্রীর জন্যই পরিচালিত হয়ে আসছে। বাংলাদেশে শিক্ষার মূল ধারাটাই ছিল ক্লাসে শিক্ষার্থী-শিক্ষক সম্পর্কের মাধ্যমে পরিচালিত। করোনার ধাক্কায় এই পদ্ধতি একেবারে বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। বাংলাদেশে সরকারি, বেসরকারি, রেজিস্টার্ড, নন রেজিস্টার্ড, এমপিওভুক্ত, নন-এমপিও স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, বিভিন্ন ডিপ্লোমা প্রতিষ্ঠান ও বিশ্ববিদ্যালয় আছে। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলোতে প্রত্যক্ষ শিক্ষা ছাড়া অন্য কোনো পদ্ধতির শিক্ষা চলবে কি? উত্তর হচ্ছে, না। করোনাকালে এসব প্রতিষ্ঠানের লাখ লাখ শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবন ও দক্ষতা অর্জনের বিষয়টি খুব ভালোভাবে ভাবা হয় নাই। আতঙ্ককে বিবেচনায় নেওয়ার চেয়ে আতঙ্কের বিস্তার ঘটেছে বেশি। অথচ বিজ্ঞান মেনে বিবেচনা নেওয়া হলে সমাজ এসব প্রতিষ্ঠান থেকে শুধু দক্ষ জনশক্তি পেত তা-ই নয়, করোনাকালে মানবিক দায়িত্বপালনে বিশাল এক ভলান্টিয়ার বাহিনী পেত। কিন্তু বাস্তবে আমরা পেলাম এক বিষণ্ন, বিক্ষুব্ধ, জীবনবিমুখ যুবশক্তি। যাদের পাল্টে যাওয়া আচরণ দেখে তাদের ওপর ভরসা করার চেয়ে ভবিষ্যৎ নিয়ে ভয় পেতে হচ্ছে।
অনলাইন ক্লাসের নামে শিক্ষাব্যবস্থা চালু রাখার কথা বলা হলেও দারিদ্র্য, অদক্ষতা এবং অবকাঠামোর দুর্বলতা একে অকার্যকর করে রেখেছে। ক্লাস করার জন্য প্রয়োজনীয় একটা মাঝারি মানের মোবাইল সেট কেনা ৬৫ শতাংশ পরিবারের জন্যই কষ্টকর। প্রতিদিনের জন্য ডেটা কেনা, নেটওয়ার্ক না থাকা, যিনি ক্লাস নেন সেই শিক্ষকের দক্ষতা এবং সাধারণ ক্লাস আর অনলাইন ক্লাস করানোর পার্থক্য বুঝে ক্লাস নিতে পারার ট্রেইনিংয়ের অভাব সবমিলে এক জটিল পরিস্থিতি। শিক্ষার্থী আনন্দ পাচ্ছে না, ক্লাসে মনোযোগ রাখতে পারছে না আর শিক্ষক পারছেন না পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে কীভাবে ক্লাস নিয়ন্ত্রণ করতে হবে তা বুঝতে। যদি প্রথম থেকেই শিক্ষকদের অন্তত এক মাসের একটা কোর্স নেওয়া হতো, কিছু ট্রেইনার তৈরি করে জেলায় জেলায় শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো তাহলে সমস্যার কিছুটা সমাধান করা যেত। কিন্তু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার ক্ষেত্রে ঘন ঘন সিদ্ধান্ত পরিবর্তন পুরো ব্যবস্থাতেই তালগোল পাকিয়ে গেছে।
শিক্ষা হলো এক প্রচণ্ড শক্তিশালী হাতিয়ার। আর শিক্ষিত জনগোষ্ঠী এক বিশাল সম্পদ। প্রাকৃতিক বস্তুকে সম্পদে পরিণত করতে গিয়ে মানুষ যে জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা অর্জন করে তা প্রবাহিত হয় প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে। মানবজাতির ইতিহাস সেই অর্থে নিরবচ্ছিন্ন অভিজ্ঞতা অর্জনের ইতিহাস। প্রকৃতিতে থেকেই প্রকৃতিকে জয় করতে করতে মানবজাতি ক্রমাগত এগিয়ে চলেছে। এই পরিবর্তনশীল বিশ্বজগতে সবকিছুই পরিবর্তিত হচ্ছে অবিরাম। এই পরিবর্তন কখনো খুব ধীরে ধীরে ঘটে আবার কখনো ঘটে দ্রুতগতিতে। দ্রুতগতিতে কোনো পরিবর্তন হলে মানুষ প্রথমে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে কিন্তু হাল ছেড়ে দেয়নি কখনো। যেকোনো পরিবর্তনের নিয়ম জানার চেষ্টা মানুষ করেছে সব সময়ই। যতটুকু জেনেছে সে অভিজ্ঞতার সার সংকলন করে তুলে দিয়েছে পরবর্তী প্রজন্মের হাতে। অতীত অভিজ্ঞতার এই সার সংকলনকেই সাধারণ অর্থে শিক্ষা বলে। শিক্ষার জন্ম সমাজে, শিক্ষার প্রয়োগটাও হয় সমাজে। কিন্তু পুঁজিবাদে সবকিছুর মতো শিক্ষাও একটি পণ্য। তাই ‘ফেল কড়ি মাখ তেল’ এই নিয়মে টাকা দাও শিক্ষা নাও এই নীতিতে চলছে শিক্ষার বেচাকেনা। তার ওপর করোনার আঘাতে ল-ভ- হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়ে গেছে পুরো শিক্ষাব্যবস্থা। সমাজের দায় গ্রহণ আর রাষ্ট্রের দায়িত্ব পালন ছাড়া শিক্ষাব্যবস্থাকে সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে রাখা সম্ভব হবে না। সমাজে অল্প কিছু মানুষের হাতে প্রচুর সম্পদ যেমন জমা হচ্ছে, তেমনি অল্প কিছু সামর্থ্যবান মানুষের সন্তান পাবে ব্যয়বহুল উন্নত শিক্ষা আর বাকি বিপুল অংশ পাবে কোনোমতে কাজ চালানোর শিক্ষা। করোনা এই শিক্ষাবৈষম্য আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
করোনা শুধু আমাদের বর্তমানকে বিপর্যস্ত করে দিয়েছে তা-ই নয়। আমরা শেষ করে ফেলছি আমাদের অতীতের সঞ্চয় আর হারিয়ে যাচ্ছে ভবিষ্যতের স্বপ্ন। বিশ্বের এত সমৃদ্ধি, এত জৌলুশ, এত চোখ ধাঁধানো অগ্রগতি যে একটা দুর্বল অর্থনৈতিক কাঠামোর ওপর ভর করে দাঁড়িয়ে আছে করোনার এক ধাক্কায় তা প্রকাশিত হয়ে গেল। উচ্চস্বরে গাওয়া গান, উচ্চশব্দের হাসির আড়ালে যে অসহায় কান্না ছিল করোনা যেন এক লহমায় তা দেখিয়ে দিল। এ থেকে শিক্ষা নিয়ে শিক্ষাব্যবস্থাকে কাঠামোগতভাবে শক্তিশালী এবং মূল্যবোধে উন্নত করতে হলে বৈজ্ঞানিক যুক্তি এবং বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষার বিকল্প নেই। ডিজিটাল ব্যবস্থা গড়ে তোলার গর্বের কথা যত প্রচার করা হয় বাস্তবে ততটা শক্তিশালী ডিজিটাল ব্যবস্থা যে শিক্ষার ক্ষেত্রে নেই, করোনা তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। নেপাল, শ্রীলঙ্কা, ভারত, পাকিস্তান, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন, মালয়েশিয়ায় ডিজিটালব্যবস্থা নিয়ে ক্ষমতাসীনরা গর্ব করে কি না, তা শোনা যায় না, তবে তারা যে করোনাকালে বাংলাদেশের চেয়ে শিক্ষাকে অনেক বেশি ডিজিটালনির্ভর করতে পেরেছে তা দেখা যাচ্ছে। ফলে তৃপ্তির ঢেকুর তোলা নয়, শিক্ষায় দুই বছরের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে কত বছর লাগবে তার একটা রোডম্যাপ করা খুবই জরুরি। বরাদ্দ বাড়ানো, দুর্নীতির ছিদ্র বন্ধ করা, শিক্ষা সহায়তা চালু এবং বাড়ানো, গবেষণায় মনোযোগ বাড়ানো আর শিক্ষকদের প্রতি বিশেষ মনোযোগ দিয়ে করোনায় শিক্ষার ক্ষত নিরাময় করা সম্ভব। এটা আমাদের করতেই হবে কারণ বর্তমানের অর্জন দ্বারা নিরাপদ ভবিষ্যৎ গড়তে হলে ছাত্র-যুবকরাই তো একমাত্র ভরসা। করোনায় স্বাস্থ্য সংকট, অর্থনৈতিক সংকট একটু চেষ্টা করলেই কাটিয়ে ওঠা যাবে। কিন্তু শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংস হলে তা একটা প্রজন্মকে পিছিয়ে দেবে বহু দূর। তাই শিক্ষায় বাণিজ্য বা ব্যবসা নয়, প্রয়োজন সামাজিক দায় ও দায়িত্ব।
লেখক : রাজেকুজ্জামান রতন, রাজনৈতিক সংগঠক ও কলামনিস্ট