সামিনের মৃত্যু ও 'স্কুল বুলিং'

দৈনিক শিক্ষা ডেস্ক |

সন্তান স্কুলে যেতে চাচ্ছে না, কী করবেন? ধরেই নেবেন সন্তানের পড়ালেখায় একদম মন নেই, তাই অজুহাত খুঁজছে স্কুলে না যাওয়ার জন্য? নিজে নিজে একটা ধারণা করে নিয়ে ভুলিয়ে বা বুঝিয়ে কিংবা জোর করে সন্তানকে স্কুলে পাঠিয়ে দেওয়ার আগে কারণ খুঁজে বের করুন। জোর করলে উপকার নয়, ক্ষতিই হতে পারে ভয়াবহ। সোমবার (১২ জুলাই) সমকাল পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়। 

নিবন্ধে আরও জানা যায়, যেমন সামিন, ১৭ বছরের একটি ছেলে তার এসএসসি পরীক্ষার জন্য তৈরি হচ্ছিল। কিন্তু ভাগ্যের নির্মমতা তাকে সেই লক্ষ্যে পৌঁছাতে দেয়নি। গত ২৬ জুন হাসপাতালে হার্ট অ্যাটাকে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে। অত্যন্ত নম্র, ভদ্র ও মেধাবী ছেলেটি শরীরের ওজন বেশি হওয়ার কারণে স্কুলে 'বুলিং' হতো। সেটা সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিল তার বয়ঃসন্ধিকালে। আমরা জানি এই বয়সে প্রত্যেকটা মানুষ একটু বেশি সংবেদনশীল হয়।

সামিনের ওজন বেশি হওয়ার কারণে ক্লাসে তার তেমন বন্ধুও ছিল না। বেশিরভাগ ছাত্রই তাকে 'টিজ' করত। সামিন স্কুলের চাইতে টিউটরের কাছে গিয়ে বরং পড়াশোনা করতে বেশি উৎসাহ পেত, কিন্তু যখনই স্কুলে যাওয়ার সময় হতো, সামিনের ভেতরে উৎকণ্ঠা কাজ করত। বিষয়গুলো লক্ষ্য করার দায়িত্ব বাবা-মায়ের এবং স্কুলের ভেতরে ঘটে যাওয়া বিষয়গুলো লক্ষ্য করার দায়িত্ব ও কর্তব্য শিক্ষকের।

খুব সম্ভবত স্কুলে যাওয়ার সময় ওর মানসিক অবস্থা অনেকটা এমন ছিল- স্কুলের গেট দিয়ে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে হাজারটা চোখ ওকে দেখছে। হয়তো শরীরের চামড়াতেও অনুভব করত সেসব চাহনি। হয়তো পা চলত না। হয়তো খুব ধীর পায়ে প্রচণ্ড অনিচ্ছা সত্ত্বেও ক্লাসের ভেতরে ঢুকত। অথবা দৌড়ে ক্লাসের ভেতরে ঢুকে পড়ত যেন বাইরের বিভীষিকাময় চোখগুলো ক্ষতবিক্ষত করতে না পারে। হয়তো ক্লাসে ঢুকেও নিজেকে গুটিয়ে রাখত যেন কেউ দেখলেই আবার কিছু বলবে! স্কুলে থাকার পুরোটা সময় মানসিক যন্ত্রণা ওকে কুরে কুরে খেত। কল্পনা করুন, কী মানসিক চাপে থাকতে হয়েছে সামিনকে প্রতিদিন। এ ছাড়া মাঝেমধ্যে সামিনের সামাজিক উৎকণ্ঠা হতো তার নিজের ওজনের কারণে, বাইরে কোথাও বেড়াতে যেতেও ওর সংকোচ হতো।

আরও পড়ুন : দৈনিক শিক্ষাডটকম পরিবারের প্রিন্ট পত্রিকা ‘দৈনিক আমাদের বার্তা’

এসব ক্ষেত্রে বাবা-মায়ের দায়িত্ব সন্তানের উৎকণ্ঠার কারণ খুঁজে বের করা এবং সঙ্গে সঙ্গে সমাধানের চেষ্টা করা। ঠিক পড়েছেন- 'সঙ্গে সঙ্গেই' কাজটা করতে হবে। যত তাড়াতাড়ি কাউন্সেলিংয়ে যেতে পারবেন, তত তাড়াতাড়ি সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা বাড়বে। দয়া করে বুঝিয়ে বা জোর করে স্কুলে না পাঠিয়ে আগে ওর উৎকণ্ঠার কারণ জেনে নিন। কাউন্সেলিংয়ে নিয়ে গেলে উৎকণ্ঠা নিয়ন্ত্রণ করতে শিখতে পারবে, সেই সঙ্গে বাড়বে আত্মবিশ্বাস। বুলিং করা ছাত্র এবং শিক্ষকের সঙ্গে কীভাবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে নিজের লক্ষ্যে পৌঁছাতে হয়, সেটা শিখে নিতে পারবে।

সামিনের স্কুলজীবনের আরেক দিনের ঘটনা ছিল আরও বেশি দুঃখজনক, সেদিন ওর শিক্ষক ওকে পুরো ক্লাসের সামনে অপদস্থ করেছে। ফুটবল টিমে যোগ দিতে চেয়েছিল বলে সবার সামনে ওকে হেঁটে দেখাতে বলেছে, কারণ ওর ওজন বেশি। আর সেটা দেখে সমস্ত ক্লাস হেসেছিল। এটা তো হঠাৎ ভুলে একটা ভুল করে ফেলা ঘটনা নয়, রীতিমতো জেনেশুনে সিদ্ধান্ত নিয়ে অপমান করা। একজন শিক্ষক হিসেবে এর চেয়ে দুঃখজনক সিদ্ধান্ত আর কী হতে পারে?

শিক্ষকের কাজ কি শুধু ক্লাসে পড়ানো? চোখের সামনে কী ঘটে যায় তা দেখার দায়িত্বও তো তাকেই নিতে হবে। কারণ, একজন অভিভাবক তার সন্তানকে স্কুলে পাঠান শিক্ষকের ভরসায়। শিক্ষক নিজেই যদি এমন অসুস্থ মানসিকতার হন, তাহলে অভিভাবক যাবে কোথায়? কোথায় অন্যদের ভুল ব্যবহার দেখে বা ছেলেটার মানসিক অবস্থান চিন্তা করে অভিভাবকের সঙ্গে বসে সঠিক ব্যবস্থা গ্রহণ করবে, সেখানে শিক্ষক নিজেই ছেলেটাকে এভাবে অপমান করল!

আমরা ছোটবেলায় শিখেছি- 'কানাকে কানা বলিও না, খোঁড়াকে খোঁড়া বলিও না'। সাদা, কালো, বেঁটে, লম্বা, মোটা, চিকন- যে কোনো ধরনের 'বডি শেইম' নিষিদ্ধ হওয়া উচিত। এটা ঘোরতর অপরাধ, এতে করে মানুষের জীবন বিপন্ন হতে পারে, আত্মহননের শিকার হতে পারে।

দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেলটি সাবস্ক্রাইব ও ফেসবুক পেইজটি ফলো করুন

এরপর প্রায়ই সামিন স্কুলে অনিয়মিত হতে শুরু করল। একপর্যায়ে সে ওজন কমানোর জন্য ইন্টারনেট ঘেঁটে ডায়েট শুরু করে দিল। অতি অল্প সময়ে অর্ধেক ওজন কমিয়েও ফেলল। ওর যেহেতু ওজন বেশি ছিল, সবাই এটাকে 'পজিটিভ' ভেবে খুশি হলো। কিন্তু ততদিনে তার 'ইটিং ডিজঅর্ডার' শুরু হয়ে গেছে। ওজন যতই কমুক না কেন, নিজেকে আয়নায় সে সারাক্ষণ স্থুলই দেখতে পেত। কিছু খেতেও ভয় পেত পাছে ওর ওজন বেড়ে যায়। জোর করে খেলে বমি হয়ে যেত। অনেক ডাক্তার দেখানোর পরে জানা গেল ওর আসলে 'অ্যানোরেক্সিয়া নারভোসা' হয়েছে। এটি মানসিক রোগ থেকে উদ্ভূত শারীরিক অসুস্থতা। আমাদের দেশের জন্য রোগটি পুরোনো হলেও পরিচিত নয়।

জানা গেল, ভারতের ব্যাঙ্গালুরুতে এর চিকিৎসা সম্ভব। কিন্তু করোনার কারণে যাওয়ার উপায় ছিল না। তাই দেশেই চিকিৎসা চলছিল; কিন্তু ধীরে ধীরে ছেলেটির এক একটি অর্গান ক্ষয়ে যেতে শুরু করল। কিডনি, লিভার, লাং, হার্ট ইত্যাদি।

এই অসুখের লক্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে অনাহারে থাকা বা অত্যধিক ব্যায়ামের মাধ্যমে ওজন কমানোর আপ্রাণ চেষ্টা। এদের স্বাভাবিক ওজন পুনরুদ্ধারের জন্য চিকিৎসার প্রয়োজন। সেই সঙ্গে কাউন্সেলিং বা টক থেরাপি, যা দিয়ে তারা তাদের আত্মবিশ্বাস ফিরে পেতে পারে এবং আচরণগত পরিবর্তন আনতে পারে।

আসুন আমরা সামিনের এই দুর্বিষহ পরিণতি সামনে রেখে সঠিক পথ বেছে নেওয়ার পরিকল্পনা তৈরি করি। যেন আর কোনো সামিনকে জীবন দিতে না হয়। ওর বয়সের ছেলেমেয়েরা নিজেরাই হয়তো জানে না তারা বুলিং করছে এবং তাদের এই আচরণের কারণে আরেকজন মানুষের জীবন বিপন্ন হতে পারে। অনেক মানুষ বুলিংয়ের কারণে মানসিক রোগে আক্রান্ত হয়, আবার অনেকে আত্মহত্যাও করে ফেলে। আমরা তার অনেক দৃষ্টান্ত দেখেছি। তাই স্কুলজীবন থেকেই শুরু হোক বুলিং বন্ধ করার এই শিক্ষা।

প্রত্যেকটা স্কুল অ্যাসেমব্লিতে সামিনের গল্পটা বলা হোক, যেন প্রত্যেক শিক্ষক এবং ছাত্র বুলিংয়ের অপকারিতা বুঝতে পারে। প্রতিদিন মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য প্রত্যেকটি স্কুলের মূল অফিসের দেয়ালে বড় করে পোস্টার থাকুক, বুলিং সহ্য করা হবে না।

 লেখক : শিল্পী রহমান, কাউন্সেলর, অস্ট্রেলিয়া


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
নিবন্ধিত শিক্ষক নিয়োগে এনটিআরসির নতুন নির্দেশনা - dainik shiksha নিবন্ধিত শিক্ষক নিয়োগে এনটিআরসির নতুন নির্দেশনা জাল সনদে চাকরি করছে কয়েক হাজার হেলথ টেকনোলজিস্ট - dainik shiksha জাল সনদে চাকরি করছে কয়েক হাজার হেলথ টেকনোলজিস্ট কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী ফের আন্দোলনের হুশিয়ারি চুয়েট শিক্ষার্থীদের - dainik shiksha ফের আন্দোলনের হুশিয়ারি চুয়েট শিক্ষার্থীদের আইনি লড়াইয়ে যাচ্ছেন শিক্ষক নেতা কাওছার শেখ - dainik shiksha আইনি লড়াইয়ে যাচ্ছেন শিক্ষক নেতা কাওছার শেখ দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না - dainik shiksha সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় - dainik shiksha প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট - dainik shiksha রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0025169849395752