দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর ১২ সেপ্টেম্বর থেকে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ক্লাস শুরু হতে যাচ্ছে। এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বেঞ্চ-টেবিলসহ সব আসবাবপত্র ও ক্যাম্পাসে জমে থাকা ময়লা-আবর্জনা পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন করতে এখন সকাল-সন্ধ্যা ব্যস্ত সময় পার করছেন শিক্ষক-কর্মচারীরা। এ নিয়ে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যেও যেন আনন্দের বন্যা বইছে।
গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে সরেজমিনে কয়েকটি স্কুল ও কলেজে গিয়ে শিক্ষক-কর্মচারীদের কর্মব্যস্ত থাকার এসব চিত্র দেখা গেছে। জেলা শহরের রানী বিলাসমনি সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয় ও জয়দেবপুর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে দুপুরে গিয়ে দেখা গেছে শিক্ষার্থীরা-অভিভাবকরা অ্যাসাইনমেন্ট জমা দিচ্ছেন। এ বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী অপরাজিতা ও তানিয়ার সঙ্গেও কথা হয়। দীর্ঘদিন পর স্কুল খুলে দেয়ার ঘোষণায় মহাখুশি তারা। দীর্ঘদিন পরে ক্লাসে একত্রিত হওয়া, নিজেদের মধ্যে লেখাপড়া ছাড়াও বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আনন্দ ভাগাভাগির সুযোগ সৃষ্টিতে তারা যেন আত্মহারা।
অপরাজিতা দৈনিক শিক্ষাডটকমকে জানান, করোনা মহামারিতে গৃহ থেকে মানসিক রোগী হয়ে পড়েছি। স্কুল বন্ধ, প্রাইভেট পড়া বন্ধ। মা-বাবা তাকে ঘরের বাইরে পর্যন্ত বের হতে দেয়নি। টিভিতে আর অনলাইনের ক্লাসে মন ভরছে না। স্যারদের কাছ থেকে ক্লাসে সরসরি শিক্ষা গ্রহণের মজাই আলাদা। অল্পতেই অনেক শিক্ষা হয়ে যায়। কিন্তু করোনার কারণে আমরা তা থেকে বঞ্চিত ছিলাম।
সতীর্থ তানিয়া দৈনিক শিক্ষাডটকমকে জানান, দীর্ঘদিন স্যার-ম্যাডাম ও বন্ধুদের কাছে পাওয়ার আনন্দ যেন বইতে পারছিনা। আল্লাহ যেন সকলকে সুস্থ রাখে এবং আমাদের এ পাওয়ার আনন্দ থেকে আর বঞ্চিত না করেন। করোনা মহামারি থেকে রক্ষা পেতে অবশ্যই আমরা স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলবো।
জয়দেবপুর সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক মো. আবুল বাশার জানান, ১২ সেপ্টেম্বরে ক্লাস শুরুর কয়েক মাস আগে বিদ্যালয় ও ক্লাস পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার নির্দেশনা পাওয়ার পর থেকেই আমরা কাজ সিংহভাগ গুছিয়ে রেখেছিলাম। এখন বাকি কাজ করছি। স্কুলের ঢুকার সময়ে গেইটে শিক্ষার্থীদের তাপমাত্রা মাপার জন্য দুইটি থার্মাল স্ক্যানার কেনা হয়েছে। এছাড়াও তাদের মাস্ক ব্যবহার নিশ্চিত করা হবে। হাত ধোঁয়ার জন্য বেসিন, অতিরিক্ত পানির কল স্থাপন করা হয়েছে। করোনা সংক্রমণ রোধে তাদের হাত ধোঁয়ার জন্য সাবান ছাড়াও প্রয়োজনীয় হ্যান্ড স্যানিটাইজার ও হ্যান্ডরাব কেনা হয়েছে। আইসোলেশন রুম, স্বাস্থ্যবিধি মেনে ক্লাসে আসন বিন্যাস ও রুটিন তৈরি করা হচ্ছে। স্কুলে স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিতকরণ এবং দেখভাল করার জন্য পরিচ্ছন্নতা কমিটিও করে দেওয়া হয়েছে।
একই কথা বলেছেন রানী বিলাসমনি সরকারি বালক উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শাহিনা বেগমও। তিনি জানান, শিক্ষা অধিদপ্তরের নির্দেশনা অনুযায়ী ক্লাস নেওয়ার সব প্রস্ততি নেওয়া হচ্ছে। স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালনের জন্য মনিটরিং টিম গঠন করা হয়েছে। করোনায় পরিবর্তিত পরিস্থিতি নিয়ে ক্লাসের শিক্ষার্থীদের এবং অভিভাবকদের নিয়ে কাউন্সিলিং করা হবে। শিক্ষার্থীদের মাঝে নিজেদের স্কুলের মনোগ্রাম সম্বলিত মাস্ক সরবরাহ করা হবে।
রানী বিলাসমনি সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের বিজ্ঞান বিভাগের এসএসসি পরীক্ষার্থী ইউসুফ আলী দৈনিক শিক্ষাডটকমকে জানান, দীর্ঘদিন স্কুল বন্ধ থাকায় আমরা মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। যতটুকু মানসম্মতভাবে প্রস্তুতি নেওয়া দরকার ছিল ততটা নেওয়া সম্ভব হয়নি। ১২সেপ্টেম্বর আমাদের স্কুল খুলছে ঘোষণায় খুব খুশি লাগছে। তবে চিন্তাও বাড়ছে। সামনে আমরা মাত্র দেড় থেকে দুই মাসের মতো সময় পাবো। সংক্ষিপ্ত সিলেবাস হলেও স্বল্প সময়ে মানসম্মতভাবে সিলেবাস কতটুকু সম্পন্ন করা সম্ভব হবে তা নিয়েও চিন্তায় আছি। করোনা সংক্রমল রোধে মাস্ক-স্যানিটাইজার নিয়ে স্কুলে গেলেও আমরা কতক্ষণ সাবধানতার সঙ্গে তা ব্যবহার করতে পারবো তা নিয়ে শঙ্কা রয়েছে।
গাজীপুর জেলার পূবাইল হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক রুবী আখতার দৈনিক শিক্ষাডটকমকে জানান, অনেকদিন স্কুল বন্ধ থাকার পর ক্লাসরুমে, আসবাবপত্র তথা বেঞ্চে যে ময়লা জমেছে তা পরিস্কার করা হচ্ছে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলে ক্লাসে শিক্ষার্থী বসালে কক্ষ সংকট দেখা দিতে পারে। এ ব্যাপারে বিকল্প চিন্তা করা হচ্ছে। শিক্ষার্থীদের তাপমাত্রা মাপার জন্য থার্মাল স্ক্যানার নেই। আইসোলেশন কক্ষও স্থাপন করা হয়নি। তবে শিক্ষার্থীদের জন্য হাত ধোয়ার পর্যাপ্ত পানির কল রয়েছে। সেখানে সাবান ও হ্যান্ড স্যানিটাইজারের ব্যবস্থা করা হবে।
গাজীপুর সদরের পিরুজালী হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক দৈনিক শিক্ষাডটকমকে জানান, আমাদের স্কুলের আসবাবপত্র, বেঞ্চ-টেবিল সবকিছু ধোঁয়া-মোছার কাজ শেষ।শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের জন্য হ্যান্ড রাব, হ্যান্ড স্যানিটাইজার, মাস্ক, সাবান ইত্যাদি সামগ্রীর ব্যবস্থা করা হয়েছে। ক্লাস নেয়ার কোন সমস্যা নেই। তবে তাপমাত্রা মাপার থার্মাল স্ক্যানার কেনা হয়নি। এটি স্কুলের পরিচালনা কমিটির সভাপতি কিনে দেবেন। তবে এখনও তিনি পর্যন্ত তা কিনে দেননি।
গাজীপুর সদর উপজেলার ভাওয়াল মির্জাপুর কলেজের অধ্যক্ষ মো. এনামুল হক দৈনিক শিক্ষাডটকমকে জানান, আমাদের সকল প্রস্তুতি প্রায় শেষ। কলেজ ভবন,মাঠ, অফিস কক্ষ, ক্লাশ রুম, বেঞ্চ-টেবিলসহ সকল আসবাবপত্র পরিস্কার-করা হয়েছে। থার্মাল স্ক্যানার, হ্যান্ড সেনিটাইজার, হ্যান্ডরাব, সাবানসহ প্রয়োজনীয় উপকরণ কেনা হয়েছে। আইসোলেশন কক্ষ প্রস্তুত করা হয়েছে।
কলেজের বিজ্ঞান বিভাগের এইচএসসি পরীক্ষার্থী মো. আব্দুল আল নোমান দৈনিক শিক্ষাডটকমকে জানান, ১২ সেপ্টেম্বরে কলেজ খূলছে ঘোষণায় আমরা খুব খুশি। দীর্ঘদিন কলেজ বন্ধ থাকায় আমরা লেখাপড়ায় অনেক পিছিয়ে পড়েছি। কলেজে ক্লাসে যোগ দিয়ে আমরা আমার পূর্ণ মনোবল নিয়ে আমাদের স্যারদের সহযোগীতায় পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে পরবো।
নোমানের বাবা আব্দুল বাতেন দৈনিক শিক্ষাডটকমকে বলেন, দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে। অনলাইনে মোবাইল ব্যবহার করে তারা ক্লাস করলেও ক্লাসের নামে তারা সময়ও অপচয় করেছে। লেখা পড়া তেমন হয়নি। অনলাইনে তাদের লেখাপড়ার অগ্রগতি সশরীরে ক্লাস রুমে শিক্ষালাভের সমান নয়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ায় সরকারকে ধন্যবাদ জানাই। এখন আমাদের প্রধান কাজ হলো শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যবিধি মেনে ক্লাসে পাঠানো।
খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে শহরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গাজীপুর সরকারি মহিলা কলেজ, ভাওয়াল বদরে আলম সরকারি কলেজ, ভাওয়াল মির্জাপুর কলেজ, কোনা বাড়ি ডিগ্রি কলেজ, মুক্তিযোদ্ধা কলেজের মতো নামকরা কলেজগুলোতে সব প্রস্তুতি ভালো থাকলেও মফস্বল এলাকার শিক্ষা বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠান যেমন-পোড়াবাড়ি শাহ সুফি ফসি উদ্দিন হাইস্কুল, মনিপুর মোস্তফা দাখিল মাদরাসা,পূবাইল হাইস্কুল, পিরুজালী হাইস্কুলে প্রস্তুতি এখনও দূর্বল।
জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা রেবেকা সুলতানা দৈনিক শিক্ষডটকমকে জানান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা সংক্রান্ত যাবতীয় নির্দেশনা সম্বলিত পরিপত্র সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এসব বাস্তবায়নের লক্ষ্যে উপজেলাওয়ারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধানদের নিয়ে মতবিনিময় করা হচ্ছে। এ সপ্তাহের শুক্র ও প্রতিষ্ঠান খোলা রেখে শনিবারের মধ্যে সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করতে হবে নো মাস্ক, নো সার্ভিস মেনে শিক্ষার্থীদের তিন ফুট দুরত্বে বসাতে হবে। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য সুরক্ষার সকল বিধান মেনে চলতে হবে। তাপমাত্রা মাপার যন্ত্র, আইসোলেশন কক্ষ স্থাপন, পর্যাপ্ত পানির কল ও বেসিন স্থাপনসহ বিশেষ ক্লাস রুটিন ও ডিজির নির্দেশনা বাস্তবায়ন নিয়ে প্রতিষ্ঠান প্রধানদের সঙ্গে আলোচনা হচ্ছে। সশরীরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সমূহে গিয়ে প্রস্তুতি পর্যবেক্ষণ করছি। এছাড়া যে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আবাসিক হোস্টেল আছে তা বন্ধ থাকবে।